×

জাতীয়

দখলবাজদের স্বর্গরাজ্য তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ অক্টোবর ২০১৮, ১১:৪৯ এএম

দখলবাজদের স্বর্গরাজ্য তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল
রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের বেশির ভাগ সড়কের ফুটপাতজুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে রিকশার গ্যারেজ, গ্রিল-ভাঙারি দোকান, কাঠ, ল্যাপ-তোষকের দোকান, খাবার হোটেল, চায়ের টঙঘর, সেলুন, কাঁচাবাজারসহ হরেক রকম দোকানপাট। আছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ও। আবার কোনো কোনো এলাকায় ফুটপাতের পাশাপাশি সড়কের একাংশজুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে রিকশার গ্যারেজ। যার ফলে অধিকাংশ সড়কই হয়ে পড়েছে সঙ্কুচিত। ফুটপাত দখল হয়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়েই পথচারীরা রাস্তার মাঝখান দিয়ে চলাচল করছেন। এতে প্রায়ই ঘটছে নানা দুর্ঘটনা। অন্যদিকে রাত গড়ালেই এসব সড়ক মাদকসেবীদের আখড়ায় পরিণত হয়। যার কারণে সন্ধ্যার পর চরম আতঙ্ক নিয়ে চলাচল করতে হয় বলে অভিযোগ করেন স্থানীয়রা। সরেজমিন ঘুরে বিজি প্রেস কোয়ার্টারের বিপরীত পাশে বেগুনবাড়ী সড়কের শুরু থেকে বেগুনবাড়ী মোড়, পলিটেকনিক ল্যাবরেটরি স্কুল মোড় হয়ে লাভ রোড, চীনা ফ্যাক্টরি মোড়, পদ্মা গার্মেন্টস মোড়, রুলিং মিলস মোড়, বটতলা মোড়, এসিআই মোড়, বলাকা মোড়, প্রগতি মোড়, নাবিস্কো মোড়, পেপসি রোডসহ আশপাশের সড়ক ও ফুটপাতে দখলের মহোৎসব বেশি চোখে পড়ে। এসব এলাকায় অসংখ্য রিকশার গ্যারেজসহ প্রায় ১০ সহস্রাধিক দোকানপাট রয়েছে। এসব রিকশার গ্যারেজ ও দোকানপাটে অবৈধভাবে বিদুৎ সংযোগ দিয়ে চাঁদা তোলা হয়। স্থানীয় লোকজন ও ফুটপাতের দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকার ফুটপাত ও সড়ক দখল করে রমরমা চাঁদা বাণিজ্য করছে একটি চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটে রয়েছে স্থানীয় মাস্তান, রাজনৈতিক দলের পাতি নেতা ও কতিপয় অসাধু পুলিশ কর্মকর্তা। দৈনিক ও সপ্তাহভিত্তিক চাঁদার পাশাপাশি নতুন দোকান নিতে এককালীন ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত মাশোয়ারা গুণতে হয় ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের। এলাকা ভেদে নির্দিষ্ট লাইনম্যান প্রতিদিন সন্ধ্যায় এসে নির্দিষ্ট হারে চাঁদা নিয়ে যায়। এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, সিটি করপোরেশনের উচ্ছেদ একটি চলমান প্রক্রিয়া। আমরা সড়ক ও ফুটপাত থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করার কিছুদিন পর আবার বেদখল হয়ে যায়। এর সঙ্গে বিভিন্ন মহল সম্পৃক্ত আছে। যার কারণে বারবার উচ্ছেদের পরও আবার বেদখল হয়ে যাচ্ছে। এরপরও আমাদের উচ্ছেদ অভিযান অব্যাহত থাকবে। বেগুনবাড়ী রাস্তার শুরুতেই ফুটপাত ও সড়কের বিশাল জায়গা দখল করে ভাঙারির দোকান দিয়েছেন জাতীয় পার্টির শিল্পাঞ্চল থানার সাধারণ সম্পাদক সোহেল পাটোয়ারী। ফুটপাত ও সড়ক দখল করে দোকান দেয়া অন্যায় কি না জানতে চাইলে তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, এটা অপরাধ। তবে সবাই ফুটপাত দখল করেছে, তাই আমিও করেছি। এই রাস্তায় লোক চলাচল কম, তাই কোনো সমস্যা হয় না। বেগুনবাড়ি মোড় পর্যন্ত এই সড়কের ফুটপাতে প্রায় শতাধিক দোকান রয়েছে। লাইনম্যান আবুল হোসেন এসব দোকান থেকে চাঁদা আদায় করেন। নাম প্রকাশে অনেচ্ছুক এক চা দোকানি জানান, দোকানপ্রতি প্রতিদিন ৫০ টাকা আর সপ্তাহে ১ হাজার টাকাসহ সাড়ে ৪ হাজার টাকা লাইনম্যানকে দিতে হয়। এর সঙ্গে আছে প্রতিদিনের বিদ্যুৎ বিল বাবদ আরো ৫০ টাকা। রুলিং মিলস মোড়ে ফুটপাতের ওপর গড়ে তোলা হয়েছে গ্রিলের দোকান। দোকানের কর্মচারী আবদুর রব জানান, তাদের প্রতিদিন ৫০০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। লাইনম্যান স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা খোকন ও শাহীন। তাদের কেউ একজন এসে এই টাকা নিয়ে যান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাশের চা দোকানি জানান, লাইনম্যানকে প্রতিদিন ২০০ টাকা এবং বিদ্যুৎ বিলবাবদ আরো ৫০ টাকা দিতে হয়। আর নতুন দোকানের জায়গা ভেদে এককালীন ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত গুণতে হয়। এই টাকা স্থানীয় মাস্তান, রাজনৈতিক দলের পাতি নেতা ও অসাধু পুলিশ সদস্যের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা হয়। এসিআই মোড় থেকে বটতলা মোড় পর্যন্ত ফুটপাতের লাইনম্যান রিপন। ফল ব্যবসায়ী আবুল হোসেন বলেন, লাইনম্যান রিপন ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে জড়িত। টাকা না দিলে ব্যবসা করতে দেয় না। আমি সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বটতলায় ব্যবসা করি। আর বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত নাবিস্কো মোড়ে ব্যবসা করি। বটতলায় লাইনম্যানকে ৫০ টাকা আর নাবিস্কো মোড়ে টহল পুলিশকে ৫০ টাকা দিই। চীনা ফ্যাক্টরি মোড়ের উত্তর-পশ্চিম পাশের ফুটপাত ও সড়ক দখল করে রিকশার গ্যারেজ দিয়েছেন কালু মহাজন। প্লাস্টিকের ছাউনি দিয়ে রাতে রিকশা চালকদের ঘুমানোর ব্যবস্থাও করা হয়েছে ফুটপাতের ওপর। এই গ্যারেজে প্রায় ২০০ রিকশা রয়েছে। ফুটপাত ও রাস্তা দখল করে রিকশার গ্যারেজ করা অপরাধ কি না জানতে চাইলে কালু মহাজন বলেন, এটা অপরাধ, তবে শিল্পাঞ্চল থানার ওসির অনুমতি নিয়েই এখানে গ্যারেজ করেছি। এই রাস্তা দিয়ে লোকজনের চলাচল কম, তাই কোনো সমস্যা হয় না। এ বিষয়ে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার ওসি আবদুর রশীদ ভোরের কাগজকে বলেন, শিল্পাঞ্চল এলাকার ফুটপাত থেকে রিকশার গ্যারেজ ও দোকানপাট উচ্ছেদে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। আগে লাভ রোড থেকে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর পর্যন্ত রিকশার গ্যারেজ ছিল। সেগুলো উচ্ছেদ করা হয়েছে। অন্যান্য সড়কে আমাদের উচ্ছেদ অভিযান চলছে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চীনা ফ্যাক্টরি মোড়ের কালু মহাজনের রিকশার গ্যারেজ ৩ বার ভেঙে ফেলা হয়। কিন্তু আবারো গ্যারেজ বসিয়েছে। আমার অনুমতি নিয়ে ফুটপাতে গ্যারেজ করার প্রশ্নই ওঠে না। এ ছাড়া ফুটপাত থেকে পুলিশ কোনো টাকা নেয় না বলেও দাবি করেন তিনি। পলিটেকনিক ল্যাবরেটরি স্কুলছাত্র সুমন আহমেদ, রুবেল ও রাকিব বলেন, ফুটপাতে রিকশার গ্যারেজ, দোকানপাট থাকায় আমরা হাঁটতে পারি না। রাস্তা সঙ্কুচিত হওয়ায় চলাচলেও সমস্যা হয়, অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটে। রুবিনা ও মেহজাবিন নামের স্থানীয় দুই গৃহবধূ জানান, ফুটপাত ও সড়কে রিকশার গ্যারেজ ও দোকানপাটের কারণে রাতে এসব সড়ক মাদকসেবীদের আখড়ায় পরিণত হয়। সন্ধ্যার পরে আমাদের আতঙ্ক নিয়ে চলাচল করতে হয়। এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) বিপ্লব কুমার ভোরের কাগজকে বলেন, রাজধানীর সড়ক ও ফুটপাত দখলমুক্ত রাখার দায়িত্ব ঢাকা সিটি করপোরেশনের। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় সড়ক ও ফুটপাত দখল থাকলে সিটি করপোরেশন তাদের উঠিয়ে দিক। আমাদের কাছে সহযোগিতা চাইলে আমরা সিটি করপোরেশনকে সহযোগিতা করব। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার জানা মতে, কোনো পুলিশ সদস্য ফুটপাতের দোকান ও রিকশার গ্যারেজ থেকে টাকা নেয় না। যদি কেউ নিয়ে থাকে, প্রমাণ পেলে তার বিরুদ্ধে নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App