×

মুক্তচিন্তা

তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ : একটি বিশ্লেষণ

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ অক্টোবর ২০১৮, ০৭:৪৫ পিএম

তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ : একটি বিশ্লেষণ
তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ : একটি বিশ্লেষণ

২৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক তথ্য অধিকার দিবস পালিত হয়েছে। অবাধ তথ্যপ্রবাহ এবং তথ্যে সর্বজনীন প্রবেশাধিকার নিশ্চিতকরণের জন্য দিবসটি পালিত হয়। বিশ্ববাসীর সঙ্গে আমরাও তা পালন করেছি। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল “Good laws and Practices for open Societies: Powering Sustainable Development with Access to Information” বাংলায় আমরা বলছি :

‘মুক্ত সমাজের জন্য উত্তম আইন : টেকসই উন্নয়নে তথ্যে অভিগমন।’

তথ্য অধিকার আইন-২০০৯ নিঃসন্দেহে একটি উত্তম আইন। এহেন আইন প্রণয়ন বাংলাদেশের জন্য একটি যুগান্তকারী ঘটনা। জনগণের ক্ষমতায়নে মাইলফলক।

বিশ্বব্যাপী টেকসই উন্নয়নের সব পদক্ষেপে অবাধ তথ্যপ্রবাহ ও তথ্যে অভিগম্যতার গুরুত্ব বিশেষভাবে প্রতিভাত হচ্ছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। জাতিসংঘ ঘোষিত সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) অর্জনে বাংলাদেশ প্রশংসনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। এটি বলা অত্যুক্তি হবে না যে দারিদ্র্য বিলোপ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নারী উন্নয়নে, জেন্ডার সমতা অর্জনে, খাদ্য নিরাপত্তা, শিশুমৃত্যু, মাতৃমৃত্যুর হার কমানো ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে তথ্যের অবাধ প্রবাহ, জনগণের তথ্যে প্রবেশাধিকার তথা তথ্য অধিকার আইন-২০০৯ সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।

জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ‘২০৩০ এজেন্ডা’, কাউকে পেছনে ফেলে নয়, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন, সমাজের সর্বক্ষেত্রে অসমতা নিরসন। বৃদ্ধ, অসহায়, হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর ক্ষুধা ও দারিদ্র্য নির্মূল করে তাদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করা। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি কমানোসহ সম্পদের টেকসই ব্যবহার, সুশাসন ও গণতন্ত্র সুুসংহতকরণ, টেকসই উন্নয়নের জন্য শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ ব্যবস্থার প্রচলন, সবার জন্য ন্যায় বিচার প্রাপ্তির পথ সুগম করা এবং সব স্তরে কার্যকর জবাবদিহিতাপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান বিনির্মাণ- এগুলোই টেকসই উন্নয়নের অভীষ্ট লক্ষ্য। অন্যদিকে মুক্ত সমাজ বলতে যেখানে জনসাধারণের মৌলিক স্বাধীনতা (যেমন : চিন্তা, বিবেক, বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা, প্রেসের স্বাধীনতা ইত্যাদি), মানব সত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার, আইনের আইন, সমতা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায় বিচার, ভোটাধিকার ইত্যাদি নিশ্চিত হবে। এসব লক্ষ্য অর্জনে সর্বাগ্রে বিবেচ্য তথ্যে অভিগম্যতা। শহর, গ্রাম, বস্তি, হাওর, পাহাড়, উপক‚ল নির্বিশেষে সর্বত্রই, সব ঝুঁকিপূর্ণ শ্রেণির নিরাপত্তা সুরক্ষা প্রদানের মাধ্যমে তাদের জীবনমান উন্নয়ন নিশ্চিতকরণ এবং সর্বত্র অসমতা, বৈষম্য ও বঞ্চনার অবসানকল্পে তথ্য অধিকার আইনের প্রয়োগ ও অনুশীলন হবে একটি বিশেষ হাতিয়ার। আইনটির একটি সর্বজনীন রূপ রয়েছে যা টেকসই উন্নয়নের পরিপূরক।

জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের ১৬.১০ লক্ষ্যমাত্রাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ‘জাতীয় আইন ও আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুযায়ী জনসাধারণের তথ্য অধিকার নিশ্চিত করা ও মৌলিক স্বাধীনতার সুরক্ষাদান।’ এ লক্ষ্যমাত্রার কর্মসম্পাদন পরিমাপকল্পে প্রস্তাবিত বৈশ্বিক সূচক (১৬.১০.২) হলো জনসাধারণের তথ্যে অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সাংবিধানিক এবং/অথবা নিশ্চয়তামূলক নীতিমালা গ্রহণ ও বাস্তবায়নকারী দেশের সংখ্যা। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বৈশ্বিক সূচকের নিরিখে বাংলাদেশের অবস্থান সমপর্যায়ের অনেক দেশের তুলনায় অগ্রগামী। আমাদের সংবিধান জনসাধারণের তথ্য অধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার সুরক্ষা দানে একটি বিশাল রক্ষাকবচ। সংবিধানের এই চেতনায় ঋদ্ধ আমাদের তথ্য অধিকার আইন। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের ১৬.১০ লক্ষ্যমাত্রা পূরণের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এটি শুধু এসডিজি ১৬.১০-এর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়ক নয়, এসডিজির অন্য সব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য প্রাসঙ্গিক, সহায়ক ও অপরিহার্য বললে ভুল হবে না। এ আইন প্রয়োগের মাধ্যমে সরকার, গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজ প্রতিষ্ঠানসমূহ শক্তিশালী হবে এবং টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের সব লক্ষ্যমাত্রা পূরণে অত্যন্ত নিবিড়ভাবে মনিটর করতে পারবে।

বাংলাদেশে ‘তথ্য অধিকার আইন’ প্রণয়ন করে জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র (UDHR) এবং নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক চুক্তি (ICPPR) অনুযায়ী জনসাধারণের তথ্য অধিকার নিশ্চিত করেছে এবং মৌলিক স্বাধীনতার সুরক্ষা দান করেছে যা আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে এবং ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে।

তথ্যের অবাধ প্রবাহ এবং জনগণের তথ্য অধিকার নিশ্চিতকরণে সরকারি প্রচেষ্টা বা উদ্যোগ প্রশংসনীয়। ২০০৯ সালে এ আইন প্রণয়নের সঙ্গে সঙ্গে এর বাস্তবায়নকল্পে স্বাধীন ও শক্তিশালী তথ্য কমিশন গঠিত হয়েছে এবং তথ্য অধিকার বাস্তবায়ন নিশ্চিতকরণে কৌশলপত্র প্রণয়নসহ অনেক পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। আইনের বাস্তবায়ন মনিটরিং ও পরিবীক্ষণের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কেন্দ্র থেকে উপজেলা পর্যন্ত চার স্তরে শক্তিশালী কমিটি গঠন করেছে। তথ্য অধিকার আইন প্রণয়নোত্তর সময়ে আমাদের গণমাধ্যম অবাধ, বিস্তৃত ও কর্মচঞ্চল হয়েছে। জনশিক্ষা, জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ইত্যাদি মানব উন্নয়নের সব ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য ইন্টারনেটে অভিগম্যতা ও মোবাইল ফোন অপরিহার্য। বর্তমানে বাংলাদেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৫ কোটির বেশি, বিটিআরসিতে প্রকাশিত তথ্যমতে গত ৩১ জুলাই পর্যন্ত ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৮৮.৬৮৭ মিলিয়ন অর্থাৎ প্রায় ৯ কোটির কাছাকাছি চলে আসছে। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নকল্পে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই প্রকল্প সারাদেশে প্রায় ৪৫০০+ ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার (One stop digital centre) গড়ে তুলেছে।

তথ্য অধিকার আইনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো অবাধ তথ্যপ্রবাহ ও তথ্য অধিকার নিশ্চিতকল্পে তথ্য সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা এবং স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশ ও প্রচার। আইনের আওতায় তথ্য অধিকার (তথ্য সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা) প্রবিধানমালা ২০১২ ও তথ্য অধিকার (তথ্য প্রকাশ ও প্রচার) প্রবিধানমালা ২০১০ প্রণীত হয়েছে। এ ছাড়াও তথ্য প্রাপ্তি, অভিযোগ দায়ের, নিষ্পত্তি ইত্যাদি সংক্রান্ত পৃথক পৃথক বিধি, প্রবিধি ও সহায়িকা প্রণীত হয়েছে। জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন-২০১১ প্রণয়ন এবং জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) বিধিমালা ২০১৭ জারি করা হয়েছে। আইনের আওতায় মন্ত্রণালয়, বিভাগও সংস্থার ওয়েবসাইট তৈরি করা হয়েছে, পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ওয়েবপোর্টাল (২৫,০০০ ওয়েবসাইট সংবলিত) এখন বাংলাদেশের। সরকার সম্প্রতি তথ্য কমিশনের জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত একটি ১৩ তলা নিজস্ব ভবন তৈরির জন্য ৮০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। অতি শিগগিরই এর কাজ শুরু হবে।

তথ্য কমিশন তথ্য অধিকার বাস্তবায়নে জনসচেতনতামূলক বিশেষ কার্যক্রম, তথ্য প্রদানকারীদের দক্ষতা উন্নয়নে নিয়মিত অনলাইন ও অফলাইন প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ছাড়াও সুশীল সমাজের অনেকেই দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। এবার সারা দেশে কেন্দ্রে, জেলায়, উপজেলায় আন্তর্জাতিক তথ্য অধিকার দিবস ২০১৮ উদযাপনের জন্য নানাবিধ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। তথ্য কমিশন জনগণের তথ্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারাবদ্ধ। এ সব উদ্যোগের ফলে তথ্য অধিকারে বিভিন্ন ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে, স্বচ্ছতা, গতিশীলতা বাড়ছে। সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো শত বছরের গোপনীয়তার সংস্কৃতির কঠিন বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসছে। এখানেই আইনটির উপযোগিতা ও উৎকর্ষতা প্রতিভাত হচ্ছে।

এত কিছুর পরও প্রশ্ন থেকে যায়, এহেন একটি উত্তম আইনের প্রয়োগ কাক্সিক্ষত মাত্রায় হচ্ছে কি? জনগণ কি প্রয়োজনীয় সব ক্ষেত্রে তা অনুশীলন করছে বা করতে পারছে? আইনটি চর্চায় কর্তৃপক্ষের কি কাক্সিক্ষত মাত্রায় সংবেদনশীলতা, দক্ষতা বা প্রস্তুতি রয়েছে? আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে, তথ্যের বিশাল চাহিদার তুলনায় তথ্য প্রাপ্তির আবেদন এখনো অনেক কম। নিরক্ষরতা, দারিদ্র্য, অজ্ঞতা, অসচেতনতা, প্রশাসনিক পদ্ধতি সম্পর্কে অনভিজ্ঞতা এর মূল কারণ।

অন্যদিকে কর্তৃপক্ষের অনেকেই এখনো তথ্য প্রদানে বা তথ্যের সহজলভ্যতা আনয়নে ইতিবাচক ভ‚মিকা বা দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শনে সক্ষম হচ্ছেন না। কেউ কেউ আইনটি সম্পর্কে এখনো ওয়াকিবহাল নন, কারো কারো ক্ষেত্রে আইনটি প্রয়োগে সংবেদনশীলতার পরিবর্তে অনীহার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। কমিশনে শুনানিকালে এ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবেদনকারীর তথ্যটি তার কাছে মজুদ থাকা সত্ত্বেও এবং তথ্যটি দেয়ার বাধ্যবাধকতা অনুধাবন করে সরবরাহ করতে প্রস্তুত থাকা সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষের অনীহা বা অসহযোগিতার কারণে আইন প্রয়োগ করতে পারছে না মর্মে শুনানিতে উপস্থাপিত তথ্য ও দলিলপত্রে প্রতীয়মান হচ্ছে। আইনের আওতায় কর্তৃপক্ষের সংখ্যা নির্ধারণ, প্রয়োজনীয় সংখ্যক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, বিকল্প কর্মকর্তা, আপিল কর্মকর্তা নিয়োগ এখনো হয়নি। তথ্য সহজলভ্যকরণ, সংরক্ষণ ও শ্রেণিবিন্যাস, ব্যবস্থাপনা; প্রকাশ ও প্রচার এবং বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশের সুনির্দিষ্ট বিধান ও তা পালনে বাধ্যবাধকতা আইনে থাকা সত্ত্বেও এবং উপর্যুপরি পত্র যোগাযোগ সত্ত্বেও তা অনুসরণ করছেন না। এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করে জনস্বার্থে আইনের ব্যাপক চর্চা/প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। একদিকে তথ্যের চাহিদাকারী সর্বসাধারণকে উৎসাহিত ও উজ্জীবিত করতে হবে, অন্যদিকে তথ্যের যোগানদাতাদের দক্ষ ও প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে। দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটাতে হবে। এ মহৎ দায়িত্ব পালনে দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। এতেই সমাজে নিশ্চিত হবে একটি উত্তম আইনের প্রকৃত সুফল প্রাপ্তি।

মরতুজা আহমদ : প্রধান তথ্য কমিশনার ও সাবেক তথ্যসচিব।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App