×

মুক্তচিন্তা

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি নিয়ে ভেবে দেখা দরকার

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ অক্টোবর ২০১৮, ০৭:৫২ পিএম

বর্তমান সময়ের আলোচ্য আইনটি নিয়ে পূর্বাহ্নেই সাংবাদিক সংস্থা থেকে বিষয়টি পাস করার বিপক্ষে মত প্রকাশ করেছিলেন। মুসলিম লীগ আমলের একাধিক কালাকানুনের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ লড়াই করে এসেছে। তাদের হাত দিয়ে তথ্য জানা বা পাওয়ার অধিকার সঙ্কুচিত করবে এমন আইন বিধিবদ্ধ করার আগে পুনর্বিবেচনা তথা ভেবে দেখার পরামর্শ দিয়েছেন সবাই।

এ দেশে এমন এক সময় ছিল যখন এক গ্রাম থেকে কয়েক মাইল দূরের গ্রামে জরুরি খবর পৌঁছাতে দিন কয় কাবার হয়ে যেত। তার ফলে কখনো অঘটনের সম্ভাবনাও দেখা গেছে। বিশ শতকের বিজ্ঞান প্রযুক্তির অভানীয় উন্নতি, আবিষ্কার ইত্যাদির কারণে তথ্যপ্রবাহ ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে গেছে।

উপনিবেশ ও পশ্চাৎপদ ভূখণ্ড হিসেবে ভারতীয় উমহাদেশে এসব খাতে উন্নয়ন ঘটেছে দেরিতে ও ধীরগতিতে। ডাক বিভাগের পোস্টকার্ড, এনভেলপ, মানিঅর্ডার ইত্যাদি পার হয়ে টেলিগ্রাম, টেলিফোন ব্যবস্থা তথ্য যোগাযোগ ও সংশ্লিষ্ট সুবিধা তৈরিতে দীর্ঘকাল রাজত্ব করেছে। এগুলোর অভাবে যোগাযোগ তো বটেই, বিশেষ ক্ষেত্রে বন্ধুর কাছে মনের কথা পাঠাতে না পারার বেদনার কথা সঙ্গীতশিল্পী পাপিয়া সারোয়ারের কণ্ঠে দেহাতি গানটিতে খুবই সরস কথকথায় উঠে এসেছে।

আধুনিকতার ক্রম উন্নয়নের ধারায় এখন বহু কথিত প্রবাদ বাক্য বিশে^ এখন প্রত্যেকের দরজায় অবস্থান করছে। যতদিন যাচ্ছে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি আমাদের একের পর এক আশীর্বাদী উপহার দিয়ে চলেছে নানা খাতে। তার মধ্যে যোগাযোগ বিশেষ করে অবাধ তথ্যপ্রবাহ এক যুগান্তর সৃষ্টির পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে- এক কথায় কম্পিউটার থেকে শুরু করে বিচিত্র যত ইলেট্রনিক ডিভাইস।

এখন গাইবান্ধার রিকশাচালক আসাদ তার কাজকর্মের মধ্যেই সেলফোনে কানে চেপে দিব্যি ঘর-গেরস্থালির খবর নিতে পারে, তাকে টেনশনে থাকতে হয় না এই ভেবে যে কি হচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত সংসারে। আর সবচেয়ে বিপ্লবাত্মক ব্যবস্থা আপাতত ব্লগ, ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদি। চিন্তা-মতামত, মনের কোণের গহীন গাঙের অনুভূতি প্রকাশে এগুলোর অবদান তুলনাবিহীন। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশেও এখন পিছিয়ে নেই।

দুই. আধুনিকতা শব্দটি পরম আকাক্সিক্ষত হয়েও এর ব্যাপক ইতিবাচকতার পাশাপাশি কিছু নেতিবাচক দিক অনেক সময় সমস্যা সংকট তৈরি করে থাকে, তাতে বিপদের আশঙ্কাও কম থাকে না। রাজধানী ঢাকা এগুলোতে আচ্ছন্ন- মূলত তারুণ্য, কিন্তু পিছিয়ে নেই অন্য বয়সীরা, এমনকি শিক্ষা সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনে মানুষ, বিশেষত পেশাজীবীদের প্রায় সবাই, ব্যতিক্রম অতি সামান্য। অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, বিশেষত মহানগর রাজধানী ঢাকায় ফেসবুক ও মাদক-ইয়াবার মধ্যে কোনটা অধিক আসক্তিকর তা নির্ধারণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে তরুণ শিক্ষার্থী সমাজ ব্যাপকভাবে এদিক থেকে নেশাক্রান্ত। তরুণ সমাজের একাংশে এদিক থেকে স্থূল, অরুচিকর, অসুস্থ পথে পা বাড়ানোর আশঙ্কা লক্ষ করা যাচ্ছে। কখনো তা অন্যায় বা অপরাধের দিকনির্দেশের প্রবণতা তৈরি করছে। গুজব, রটনা ইত্যাদি কখনো ব্যাপক, সামাজিক বা রাজনৈতিক সমস্যা তৈরির দিকে পা বাড়িয়ে থাকে। আর এসব নিয়ে চলে বিতর্ক, রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রতিশোধ স্পৃহা পূরণ, যা প্রায়শ সঠিক পথ ধরে না। ইদানীং একাধিক আন্দোলন ঘিরে অনভিপ্রেত ঘটনাও প্রকাশ পেয়েছে। সে ক্ষেত্রে শক্তিরই জয়। কখনো নিরপরাধ ব্যক্তি অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির নেতিবাচক দিকটি একদিক বিচারে কখনো অনিবার্য ও অবাঞ্ছিত সত্য হয়ে দাঁড়ায়।

বাংলাদেশে, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চ উপলক্ষে সেই যে মৌলবাদী জঙ্গিদের হাতে বøগার হত্যার অনেক শোকাবহ ঘটনা দেখা গিয়েছিল, তা আপাতত বন্ধ হলেও ভিন্ন ধারায় এসবের অনভিপ্রেত প্রকাশও ঘটছে। সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলন উপলক্ষেও আমরা দেখেছি ফেসবুক তথ্যাদি উপলক্ষে অনুরূপ অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা।

সব কিছু মিলে তথ্য ও যোগাযোগ মাধ্যম, সংবাদ ও গণমাধ্যম নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা, গ্রেপ্তার ইত্যাদি রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির জন্ম দিচ্ছে। বলা বাহুল্য এ প্রবণতা যেমন সুস্থ নয়, তেমনি সমাজ ও রাষ্ট্রের পক্ষে শুভ বা মঙ্গলদায়কও নয়। কিন্তু আমরা এগুলোকে যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করছি না।

তিন. দীর্ঘদিন থেকে আওয়ামী লীগ সরকার, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার প্রত্যয় প্রকাশ করেছেন এবং সে উদ্দেশ্যে কাজ করে চলেছেন। এতে কেউ বিরূপতা প্রকাশ করেছেন, এমনটি নয়; যদিও সেক্ষেত্রে গঠনমূলক সমালেচানার প্রকাশ দেখা গেছে। সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সুফল রাষ্ট্রের উন্নয়নে যুক্ত হোক, এটাতো সবারই কাম্য।

কিন্তু হঠাৎ করে সম্প্রতি জাতীয় সংসদে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ শীর্ষক যে বিলটি পাস হয়েছে তা নিয়ে আইন বিশেষজ্ঞ এবং আইন সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন সব শ্রেণির মানুষই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে চলেছেন। বিশেষ করে সর্বাধিক বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছে গণমাধ্যম তথা সাংবাদিক সমাজ। কারণ তাদের কাজই হলো তথ্য সংগ্রহ এবং তা প্রকাশ করা।

আমরা আইনজ্ঞ বা আইনজীবী নই, তবু এ আইনের যা বয়ান তা সাধারণ বিচারে সবারই বোধগম্য। এতে যে কঠোর বিধিবিধান ও নির্দেশনামা রয়েছে তা শুধু গণমাধ্যম তথা সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের পেশাগত কর্মে সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করবে তাই নয়, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মানুষের ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা ব্যাহত করার কথা। তাই বিষয়টি নিয়ে সংবাদপত্রে লেখালেখি শুরু হয়ে গেছে।

এমনকি ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের শুভানুধ্যায়ীদের কেউ কেউ এ আইন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তেমন একটি নিবন্ধের শিরোনাম ‘মিডিয়াবান্ধব প্রধানমন্ত্রী এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে উদ্বেগ’। নিবন্ধকার এই সাংবাদিক লিখেছেন : ‘আইন তো হবে দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থে। সরকার নিজেদের সুরক্ষার স্বার্থে কোনো আইন করতে পারে না। যদি তা-ই করা হয়, তাহলে বুঝতে হবে সেখানে কোনো দুরভিসন্ধি আছে।’

এ প্রসঙ্গে তিনি অবশ্য ব্লগ, ফেসবুক ও টুইটারসহ সামাজিক মাধ্যমে অরুচিকর মন্তব্য ও ছবি প্রকাশ গ্রহণযোগ্য মনে করেন না, তা বন্ধ করতে আইনের প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন। তা সত্ত্বেও বর্তমান আইনটিকে সমর্থন করতে পারছেন না। এর কারণ অবশ্য খুবই স্পষ্ট। অর্থাৎ এ আইনে অপব্যবহারের সুযোগ রয়েছে এবং তা নিশ্চিতভাবে দেশের নাগরিকদের বাকস্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করবে, সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের তো বটেই। বাংলাদেশের সংবিধানে গণতন্ত্র মৌলিক চার স্তরের একটি এবং এ ক্ষেত্রে নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার ও নিরাপত্তার পক্ষে সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে। তা সত্ত্বেও দেশের নাগরিক ও সংবাদপত্রসেবী সাংবাদিকদের পেশাগত স্বাধীনতা ক্ষু্ণ্ণ করতে পারে এ আইন এবং তা নির্ভর করবে প্রশাসকদের মর্জির ওপর।

প্রসঙ্গত এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই যে, সংবিধান স্বীকৃত গণতন্ত্রকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে ব্যাপক বাকস্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করবে এমন আইন প্রণয়ন করা চলে না। এ আইনের সবচেয়ে আপত্তিকর দিক হলো এতে উপনিবেশবাদী বিদেশি শাসনের কালাকানুন ‘অফিসিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্ট’ যুক্ত করা। উপনিবেশবাদী শাসক তাদের অনাচারী কর্মকাণ্ড সুরক্ষার স্বার্থে নিরাপত্তার নামে এ জাতীয় একাধিক আইন প্রণয়ন করেছে, বাস্তবে তা প্রয়োগও করেছে। যে জন্য কুখ্যাত রাউলাট আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে কণ্ঠরোধ বিরোধী প্রবন্ধ লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

উল্লেখ্য, বর্তমান সময়ের আলোচ্য আইনটি নিয়ে পূর্বাহ্নেই সাংবাদিক সংস্থা থেকে বিষয়টি পাস করার বিপক্ষে মত প্রকাশ করেছিলেন। মুসলিম লীগ আমলের একাধিক কালাকানুনের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ লড়াই করে এসেছে। তাদের হাত দিয়ে তথ্য জানা বা পাওয়ার অধিকার সঙ্কুচিত করবে এমন আইন বিধিবদ্ধ করার আগে পুনর্বিবেচনা তথা ভেবে দেখার পরামর্শ দিয়েছেন সবাই।

বিশেষ করে একাধিক সূত্রে উল্লেখ করা হয়েছে ২০০৯ সালে এই দলীয় সরকারের শাসনামলে যে তথ্য অধিকার আইন, তার লক্ষ্য ছিল সাংবাদিকদের জন্য তথ্য সংক্রান্ত মুক্ত অধিকারের ব্যবস্থা। অথচ প্রায় এক দশক পর সেই দলের শাসনেই এর ঠিক বিপরীত চরিত্রের তথ্যগত আইন উঠে এল ডিজিটাল নিরাপত্তার নামে। আইনটির বিস্তারিত বিধিবিধান ইতোমধ্যে প্রায় সব সংবাদপত্রেই প্রকাশ পেয়েছে বিধায় পুনরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। এ সম্পর্কে বিশদ বিশ্লেষণ বাদেই বুঝতে পারা যায় এ আইনের সীমাবদ্ধতা এবং জনমত প্রকাশবিরোধী চরিত্র। আর সে কারণে দেশের সব সংবাদ মাধ্যম ও সাংবাদিক সংস্থা এবং দেশি-বিদেশি মানবাধিকার কমিশন আইনটির বিরুদ্ধে মতামত প্রকাশ করেছে। চাইছে, এ আইন বলবৎ না হোক।

দেশীয় সাংবাদিকদের এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে আহ্বান এটি পুনর্বিবেচনার। আমরা মনে করি ফেসবুক, বøগ ইত্যাদিতে প্রকাশিত আপত্তিকর, অশ্লীল মন্তব্য নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রেখেও এ আইনকে জনস্বার্থনির্ভর বা জনবান্ধব আইনে পরিণত করা সম্ভব। বিষয়টি সরকার এমন আলোকে পুনর্বিবেচনা করে এর সংশোধন ঘটাবেন এমনটাই আমাদের দাবি ও প্রত্যাশা।

আমাদের বিশ্বাস সংবাদপত্র ভুবন এবং লেখকদের কাছ থেকে একচেটিয়া সমর্থন আদায় বা সব প্রকার বিরোধিতার অবসান ঘটাতে আইনটিকে এতটা কড়া পাকে তৈরি করা হয়েছে। এতে কতটা জনসমর্থন আছে শিক্ষিত সমাজে তা গণভোটে দিয়েও পরীক্ষা করে নেয়া যেতে পারে।

আশা করি জনমত ও জনস্বার্থ বিবেচনায় সরকার আলোচ্য আইনটিকে বিধিবদ্ধ করার আগে আরেকবার ভেবে দেখবেন সংশোধনের পক্ষে। আরো ভেবে দেখার বিষয় নির্বাচনের আগে এ ধরনের একটি আইন প্রণয়ন কতটা তাদের পক্ষে যাবে।

আহমদ রফিক : ভাষাসংগ্রামী, প্রাবন্ধিক ও গবেষক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App