×

মুক্তচিন্তা

কৃষির অগ্রগতি বনাম খাদ্য নিরাপত্তা

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৮:৫২ পিএম

লক্ষ্য বাস্তবায়নের কৃষি জমি পানি এবং কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন মেধাশক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে হবে। সে জন্য কৃষির উদ্ভাবিত সব প্রযুক্তিকে মাঠ পর্যায়ে নেয়ার জন্য বিজ্ঞানমনস্ক উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসতে হবে। বর্তমানে উচ্চশিক্ষিত বেকারদের জন্য কৃষি হতে পারে একটি উল্লেখযোগ্য কর্মক্ষেত্র।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি আইবির ৬ষ্ঠ জাতীয় কনভেনশন এবং এ উপলক্ষে আয়োজিত আন্তর্জাতিক সেমিনার উদ্বোধনকালে বলেন, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে এবং খাদ্যের জন্য যেন আর কোনোদিন দেশকে কারো কাছে হাত পাততে না হয়। তিনি আরো বলেন, দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং এর জন্য প্রধানমন্ত্রী দেশের কৃষি বিজ্ঞানীসহ কৃষিবিদ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি আরো বলেন, কৃষি পণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণের দিকে মনোযোগ দিতে হবে, বহুমুখী ফসলের চাষাবাদের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে, কৃষি পণ্যের ভ্যালুঅ্যাভ করতে হবে, প্রক্রিয়াজাত করতে হবে এবং বিদেশে কৃষি পণ্যের রপ্তানি বাড়াতে হবে। দুহাজার একুশ সালের মধ্যে ডেল্টা প্ল্যান প্রণয়নের কাজ চলছে যেখানে কৃষি, পানি ও ব্রু ইকোনমি সংযুক্ত রয়েছে। এ ছাড়াও সরকার প্রথম প্রেক্ষিতে পরিকল্পনা (২০১০-২১), সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০১৬-২০) এবং সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল (২০১৫-২০২৫) বাস্তবায়নের কাজ চলছে। জাতীয় কৃষিনীতি ২০১৮ এ ধারায় তৃতীয় সংস্করণ যা মন্ত্রিসভা সম্প্রতি অনুমোদন দিয়েছে যার মূল লক্ষ্য কৃষিজাত উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্যে নিরাপত্তা অর্জন, লাভজনক টেকসই প্রবৃদ্ধি, কৃষি গবেষণা, শিক্ষা সম্প্রসারণ ও আধুনিকীকরণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিকমানের দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা, কৃষি যান্ত্রিকীকরণে উৎসাহিত করে কায়িক শ্রম হ্রাস ও সাশ্রয়ী কৃষি ব্যবস্থার প্রচলন করা।

প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অবশ্য কৃষিক্ষেত্রে আরো গতিশীলতাকে ত্বরান্বিত করবে যা মনে রাখার মতো। এখন আলোচনা আসে বর্তমান সরকারের বিগত প্রায় দশ বছর শাসনামলে কৃষির বিভিন্ন ক্ষেত্রের সাফল্যগুলো কি হয়েছে এবং আরো কি কি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। আমাদের চাল উৎপাদন বর্তমানে ৩৩৮.১৩ লাখ টনে দাঁড়িয়েছে। স্বাধীনতার পর বিগত ৪৭ বছরে ধান উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে ৪ গুণ। শাক-সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয়। প্রাকৃতিক উৎস থেকে আসা মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের তৃতীয় যা চীন-ভারতের পরপরই রয়েছে এবং প্রাণিসম্পদ বিশেষত পোল্ট্রি শিল্প দেশে গার্মেন্টসের পরই কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত হিসেবে বিবেচিত। কৃষি বিজ্ঞানীরা পাটের ওপর গবেষণা করে এই ফসলের জীবন রহস্য উদ্ভাবন করে যা এক যুগান্তকারী ঘটনা।

আবার মৎস্য বিজ্ঞানীরা ইলিশ মাছের ওপর এই প্রজাতির জীবন রহস্য উদ্ভাবন আরো একটি যুগান্তকারী ঘটনা। ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ এবং তার প্রজনন, উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ইত্যাদিতে সরকার যথেষ্ট সক্রিয় রয়েছে। বিশেষত আন্তর্জাতিক বাজারে যেখানে বাংলাদেশের ইলিশের সুনাম পৃথিবীব্যাপী কৃষি গবেষণা ও প্রযুক্তিতে দেশের অগ্রগতি লক্ষণীয়। স্বাস্থ্য ও পুষ্টিমানের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে এখন জৈব কৃষি ও তার সঙ্গে প্রযুক্তি ব্যাপক বিস্তারে পথে রয়েছে। বিজ্ঞানীরা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে কাক্সিক্ষত বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী জিন বা জিনগুলোকে আবিষ্কার করে তা অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভিদের জিনোমে ঢুকিয়ে নতুন ক্ষমতাসম্পন ফসল উদ্ভিদ তৈরি করে চলছে।

এবারকার প্রণীত কৃষি নীতির নতুন সংযোজন হলো ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহার যা বাংলাদেশে খুবই পরিচিত নয়। এটা হলো পদার্থের ক্ষুদ্রতম ব্যবহার যা পদার্থকে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর পর্যায়ে রূপান্তরের পর তা নিয়ন্ত্রণের কৌশল। এই প্রযুক্তি পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞানকে সমন্বয় করে এক সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। যা ব্যবহৃত হয় ওষুধ তৈরি, রোগ শনাক্তকরণ, শিল্প ও কৃষি উপকরণ তৈরিতে। বিশেষত বাসায়নিক সার ও কীটনাশক উৎপাদনে, মাটির গুণগত বৃদ্ধি পানি পরিশোধনে, কৌলিতত্ত¡ প্রজনন ও শনাক্তকরণে। এ বিষয়ে ভারতে ব্যাপক গবেষণা চলছে এবং বাংলাদেশে এর নতুন সংযোজন সূচনা হয়েছে যা একটি শুভ লক্ষণ মাত্র।

প্রাথমিক পর্যায়ে ফসলের রোগ নির্ণয়, জাতিভিত্তিক পুষ্টি চাহিদা নির্ণয়, পুষ্টি আহরণের ক্ষমতা বৃদ্ধি, ভারী ধাতুর উপস্থিতি শনাক্তকরণ, বালাইনাশক উদ্ভাবন ইত্যাদিতে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। বিগত কয়েক দশকে কৃষিতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হলেও ভরণপোষণের কৃষি থেকে বেরিয়ে আসতে আমাদের আরো অনেক সময় লেগে যেতে পারে। কারণ আমাদের কৃষি শ্রমিকের একটা বড় অংশ অদক্ষ। যদিও কৃষি যন্ত্রীকীকরণের প্রক্রিয়া ধীর গতিতে চলছে যার জন্য দক্ষ শ্রমশক্তি অপরিহার্য। আমাদের কৃষি নীতিতে বরাবরই কৃষি ভর্তুকির কথা উল্লেখ থাকলেও তার পরিমাণ নির্ধারিত হয়নি। যার ফলে কৃষি ভর্তুকি সব সময়ই অবহেলিত থেকে যাচ্ছে। যেমন ২০১১-২০১২ অর্থবছরে কৃষি ভর্তুকিতে বরাদ্দ ছিল মূল বাজেটের প্রায় ৭ শতাংশ যা বর্তমানে নেমে এসেছে ২ শতাংশ। ফলে কৃষি খাতে বিনিয়োগ হ্রাস পাচ্ছে তার সঙ্গে হ্রাস পাচ্ছে প্রবৃদ্ধির হার, কৃষি পণ্যেও ন্যায্যমূল্য ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য। সে যাই হোক না কেন প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণের মাধ্যমে জাতিকে যে স্বপ্ন দেখিয়েছেন তার বাস্তবায়নে আসন্ন চ্যালেঞ্জগুলোকে মনে রাখতে হবে।

২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশের উন্নীত হওয়ার প্রক্রিয়ায় কৃষি খাতের গুরুত্ব অপরিসীম এবং বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্য জোগান দিতে হলে কমপক্ষে ৪.৫ শতাংশ হারে কৃষিখাতে প্রবৃদ্ধির প্রয়োজন। আবার বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে (২০১৪) সার বীজ সেচ কৃষি উপকরণের ইত্যাদির কথা বলা আছে এবং দরিদ্র মানুষের খাদ্য নিশ্চিতকরণ, পরিবেশবান্ধব কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন, কৃষি জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, শস্য প্রাণিসম্পদের জীববৈচিত্র্য অক্ষুণ্ণ রাখা ইত্যাদি সরকারের লক্ষ্য। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের কৃষি জমি পানি এবং কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন মেধাশক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে হবে। সে জন্য কৃষির উদ্ভাবিত সব প্রযুক্তিকে মাঠ পর্যায়ে নেয়ার জন্য বিজ্ঞানমনস্ক উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসতে হবে। বর্তমানে উচ্চশিক্ষিত বেকারদের জন্য কৃষি হতে পারে একটি উল্লেখযোগ্য কর্মক্ষেত্র।

ড. মিহির কুমার রায় : অধ্যাপক, সিটি ইউনিভর্সিটি, ঢাকা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App