×

মুক্তচিন্তা

আওয়ামী লীগ বিপদে পড়লে বিপদগ্রস্ত হবে দেশ

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৭:৩৮ পিএম

আওয়ামী লীগের সঙ্গে রয়েছে এদেশের মানুষের নাড়ির সম্পর্ক। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিকে এক পাল্লায় মাপার প্রবণতা ব্যর্থ বামদের ভ্রান্ত তত্ত্বচর্চারই একটি নমুনা। তারা বুঝতে পারেন না যে, আওয়ামী লীগ শুধু একটি রাজনৈতিক দলের নাম নয়, আওয়ামী লীগ একটি জাতিসত্তার নাম, বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার নাম। এই চেতনার নাম হিন্দু-মুসলমান নয়। আওয়ামী লীগের স্খলন-পতন অবশ্যই আছে, কিন্তু তাই বলে এটা বিএনপি নয়।

বদরুদ্দীন উমর বলেছেন, ‘যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন হলেও আওয়ামী লীগের অবস্থা মালদ্বীপের চেয়ে কঠিন হবে। তারা আরো বেশি বিপদের মধ্যে পড়বে। আর আওয়ামী লীগ একবার বিদায় হলে জীবনেও আর ফিরে আসতে পারবে না’।

বদরুদ্দীন উমর একজন খ্যাতিমান বাম বুদ্ধিজীবী। একসময় চীনপন্থি তাত্ত্বিক ছিলেন। চীন সমাজতন্ত্রের পথ ছেড়েছে, বদরুদ্দীন উমর ছাড়েননি। তিনি অটলবিশ্বাসী বাম এবং অত্যন্ত নিষ্ঠাবান আওয়ামী লীগবিরোধী। তাকে অনেকেই একজন রাজনৈতিক পণ্ডিত এবং বিজ্ঞজন মনে করে থাকেন। তার বয়স হয়েছে। তাই শ্রদ্ধেয়। আমিও ব্যক্তিগতভাবে তার পঠন-পাঠনের গভীরতায় শ্রদ্ধাশীল। তিনি কয়েকটি বই লিখেছেন। অসংখ্য রাজনৈতিক কলাম লিখেছেন। প্রথম দিকে লেখা দুচারটা বইয়ে তার চিন্তা ও মননের যে পরিচয় পাওয়া গেছে, পরবর্তী সময়ে তিনি তা ধরে রাখতে পেরেছেন বলে মনে হয় না।

তিনি নিয়মিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কলাম লেখেন। রাজনৈতিক ভবিষ্যদ্বাণী করেন। কতজন পাঠক তার লেখা পছন্দ করেন জানি না। তবে বাজার চাহিদা আছে বলেই হয়তো তার লেখা ছাপা হয়। অথবা সরকারবিরোধী একজন নামকরা লেখকের লেখা কাগজের অলঙ্কার হিসেবেও দেখা হতে পারে। শুনেছি, তার সম্মানী নাকি অন্য সব কলাম লেখকদের চেয়ে বেশি। হতেই পারে। গাছপাকা ফলের কদর আলাদা। তার মতো গাছপাকা লেখক তো দেশে খুব বেশি নেই। তার নাম শুনলে শ্রদ্ধায় কারো কারো মাথা নত হয়ে আসে।

আমি গত প্রায় তিন দশক ধরে তার রাজনৈতিক লেখাগুলো পড়ার চেষ্টা করি। তিনি পাঠকদের উদ্দেশে ঠিক কি বার্তা দেন তা সবসময় বুঝে উঠতে পারি না। অবশ্য তার মতো বহুদর্শী ও জ্ঞানী মানুষের লেখার মাহাত্ম্য কথা আমার মতো মূর্খজনের বোঝারও কথা নয়। তিনি অনেক কিছু দেখেছেন। অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। তাই তার লেখার বা দেখার ব্যাপ্তি ও গভীরতাই আলাদা। তবে তিনি জীবনভর যেসব রাজনৈতিক ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, তার একটিও কি সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে? একজন জনবিচ্ছিন্ন, কল্পনাবিলাসী এবং কথা-কাজে অমিল রাজনীতি বিশ্লেষকের বিশ্লেষণ নিষ্ফল শব্দ ঝংকারই হওয়ার কথা। হচ্ছেও তাই। তিনি আওয়ামী লীগ সম্পর্কে বা আগামী নির্বাচন সম্পর্কে যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, তা একেবারেই বাজারচলতি কথা। তিনি যে আওয়ামী লীগ বিদ্বেষী তা নিয়ে বিতর্ক করার কোনো সুযোগ নেই। উমর সাহেব রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। তার বাবা আবুল হাশিম মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের নেতা ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহকর্মী ছিলেন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে আবুল হাশিমের প্রসঙ্গ একাধিকবার এসেছে।

বদরুদ্দীন উমর পিতার পথ অনুসরণ না করে বিপ্লবী পথ ধরেছেন। মুসলিম লীগ ধর্মাশ্রয়ী সাম্প্রদায়িক দল। নব্য শিক্ষিত বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্তের একাংশ মুসলিম লীগ করাটা অগৌরবের মনে করতেন। আবার পারিবারিক ঐতিহ্য ছিল চিন্তাচেতনায়। আওয়ামী লীগকে তারা মুসলমানের কাছের দল মনে করতেন না। তারা বামপন্থার দিকে ঝুঁঁকে পড়াটাকেই সম্মানজনক মনে করতেন। বামপন্থিদের একাংশ যখন আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্য ও সমঝোতার কৌশল গ্রহণ করল, অন্য অংশ তখন স্বাভাবিক আওয়ামী লীগবিরোধিতার ধারায় চীনপন্থি হয়ে গেল। এই ধারার একজন যোগ্য প্রতিনিধি উমর সাহেব। তিনি বামপন্থি কিন্তু মনে মনে পুষে আছেন সাম্প্রদায়িকতা। আমাদের দেশে ভারতবিরোধিতাও সাম্প্রদায়িক চেতনাজাত রাজনীতিরই ফল। যারা ভারতবিরোধী রাজনীতি করেন তারা সবাই বাংলাদেশের স্বার্থের প্রহরী হয়ে সেটা করেন না, সাম্প্রদায়িক ভাবনা থেকেও করেন। আমার এক ফেসবুক ফ্রেন্ড শ্যামল রায় চমৎকারভাবে লিখেছেন, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, তিনি বাঙালি তরুণদের বিশ্বাস করেন না। কারণ যৌবনে এরা প্রচণ্ড রকম বিপ্লবী এবং শেষ বয়সে সবাই ধর্মান্ধতার রোগী। বদরুদ্দীন উমর যৌবনে যে বিপ্লবের পথ ধরেছেন, এখনো তা ধরে আছেন। তিনি সরাসরি সাম্প্রদায়িক এবং ‘ধর্মান্ধতার’ রোগী হয়েছেন, সেটা হয়তো নয়। কিন্তু তার লেখালেখির সরাসরি বেনিফিশিয়ারি সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ গোষ্ঠী। আওয়ামী লীগবিরোধিতার নামে তারা দেশে পরোক্ষভাবে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিরই পৃষ্ঠপোষকতা করেন। বদরুদ্দীন উমর এবং তার মতো অনেকেই, এমনকি সিপিবি নেতাদের কেউ কেউ শেখ হাসিনার সরকারকে স্বৈরাচারী সরকার বলে থাকেন। কোনো স্বৈরশাসকই জোর করে ক্ষমতায় থাকতে পারে না, আইয়ুব-ইয়াহিয়া-জিয়া-এরশাদের প্রসঙ্গ তুলে বলা হয়, তাদের যে পরিণতি হয়েছে, শেখ হাসিনারও তাই হবে। বাম ঘরানার তাত্তি¡ক নেতাদের এসব বক্তৃতা বিএনপিকে উৎসাহিত করে। সেজন্য আওয়ামী লীগবিরোধী একটি বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার স্বপ্নে বিভোর আছে বিএনপি।

আমাদের তত্ত্ববাগিশ নেতারা তত্ত্ব সব মিলিয়ে দিতে পারেন। এরা বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধকে ‘দুই কুকুরের লড়াই’ আখ্যা দিয়ে নিজেরা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভ‚মিকা পালন করতে পারেন। আরেক অংশ তত্ত্ব জালে জড়িয়ে বাকশালে যোগদান করতে পারেন। আবার জিয়ার খাল কাটা কর্মসূচিও সমর্থন করতে পারেন। কিন্তু তারা শুধু বুঝতে পারেন না যে, শেখ হাসিনা আর আইয়ুব-ইয়াহিয়া-জিয়া-এরশাদ এক নন এবং সামরিক স্বৈরশাসকদের পথে শেখ হাসিনার বিদায়ও হবে না। সামরিক শাসকদের ক্ষমতা গ্রহণ বা ক্ষমতাসীন হওয়ার প্রক্রিয়া আর শেখ হাসিনার ক্ষমতাসীন হওয়ার প্রক্রিয়া এক নয়। আর আওয়ামী লীগও বিএনপি-জাতীয় পার্টির ধারায় গড়ে ওঠা দল নয়।

আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগের দার্শনিক চেতনার মধ্যে পার্থক্য হয়তো কিছুটা বেনোজল ঢুকেছে কিন্তু দলটি এখনো জনবিচ্ছিন্ন দলে পরিণত হয়নি। যারা আজ আওয়ামী লীগের বা শেখ হাসিনার সরকারের পতনকে জরুরি মনে করছেন, তারা কাকে ক্ষমতায় আনতে চান? যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেয়া হয় যে, দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপি জিতবে, তাহলে আমাদের উল্লসিত হওয়ার কি আছে? আওয়ামী লীগের চেয়ে ভালো শাসন উপহার দেবে বিএনপি? শেখ হাসিনার চেয়ে যোগ্য প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া? সবচেয়ে বড় কথা বিএনপি ক্ষমতায় এলে বাস্তবে ক্ষমতায় আসবে জামায়াতে ইসলামী। যে যাই বলুক না কেন, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বিএনপি এখন দিল্লির দরবারে যতই হাজিরা দিক না কেন, ক্ষমতায় গিয়ে বিএনপি কি করে সেটা আমরা যেমন জানি, তেমনি জানে দিল্লিও।

ড. কামাল হোসেন এবং ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে সামনে রেখে আজ যারা জাতীয় ঐক্যের স্বপ্ন দেখছেন তাদেরও স্বপ্নভঙ্গ হতে বেশি সময় লাগবে না। বিভিন্ন দূতাবাসে ধরনা দিয়ে কিংবা বিদেশিদের কাছে দেশবিরোধী বই-কিতাব পাঠিয়ে আর যাই হোক ক্ষমতায় যাওয়ার পথ সুগম হবে না। বিদেশিদের কেউ কেউ হয়তো বাংলাদেশে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চাইছে কিন্তু এমন সরকার কি চাইছে যারা দেশে জঙ্গিবাদের জন্য নরম ভূমি তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে?

গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে যারা উদ্বিগ্ন, বিচলিত তারা ভুলে যান যে এগুলো বিমূর্ত কোনো বিষয় নয়। আমি গণতন্ত্র চাই, কিন্তু জঙ্গিবাদ প্রসারের গণতন্ত্র চাই না। ইউরোপ যে গণতন্ত্রের পূজারী, তারা কি তাদের দেশে ফ্যাসিবাদ প্রচারের সুযোগ দেয়? হিটলার গণতন্ত্রের সুযোগ নিয়েই গণতন্ত্র বিনাশের পথ নিয়েছিল। আমাদের দেশে এমন কিছু মানুষ আছেন যারা শেখ হাসিনাকে হিটলার বলতেও দ্বিধা করেন না। মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে যা খুশি তাই বলা কোনো সভ্য রাষ্ট্রেই চলে না। গণতন্ত্র কি দেশের মধ্যে নৈরাজ্য সৃষ্টি, দেশের সম্পদ ধ্বংস করা, পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করা সমর্থন করে? গ্রেনেড হামলা চালিয়ে আপনি আমাকে হত্যা করতে চাইবেন, আর আমি ফুলের মালা দিয়ে আপনাকে বরণ করে বুকে টেনে নেব এতটা উদারতা আমি যদি দেখাতে না পারি, সেটাকে আমার ত্রুটি বলে আপনার মনে হতে পারে। কিন্তু আত্মরক্ষার অধিকার আমার অবশ্যই আছে। এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, আমাদের এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য বদরুদ্দীন উমরদের অসাম্প্রদায়িক চেতনা আমাদের উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করেছিল কিন্তু রাষ্ট্রটি এখন মূলত উমরের পিতা আবুল হাশিমের চেতনা দ্বারা আচ্ছন্ন হওয়ার বিপদ তৈরি হলো কেন- এই প্রশ্নের জবাব আমাদের খুঁজতেই হবে। এর দায় কি শুধু আওয়ামী লীগের একার?

আওয়ামী লীগ আর ক্ষমতায় ফিরে না আসুক- এটা পাকিমনাদের একান্ত বাসনা। আওয়ামী লীগ বিপদে পড়ুক সেটাও অনেকেই চান। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে আওয়ামী লীগ বিপদে পড়লে গোটা দেশই বিপদগ্রস্ত হবে। আওয়ামী লীগকে রাহুমুক্ত করতে হবে ঠিকই, কিন্তু সেটা তাকে বিপদাপন্ন করে নয়।

বিভুরঞ্জন সরকার : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App