×

মুক্তচিন্তা

মঞ্চ-ঐক্যের ভূত-ভবিষ্যৎ

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৭:২৪ পিএম

কথিত ওই ঐক্যের ‘মুখে শেখ ফরিদ আর বগলে ইট’ রাখার কৌশলের বিপক্ষে তাদের দাঁড়ানো সময়ের দাবি। সংবিধানের ভিত্তিতে সুষ্ঠু অবাধ নিরপেক্ষ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হোক, ঐক্য প্রক্রিয়া নির্বাচনকালীন সরকার কেমন চায় সেই ইস্যুসহ কর্মসূচি সামনে রাখুক, সরকারি জোটও কি চায় তা অঙ্গীকার করুক, জনগণ সংবিধান ও গণতন্ত্রের মালিক হোক; এটাই নির্বাচন সামনে রেখে জনগণের একান্ত কামনা।

আন্দোলন নাকি নির্বাচন? কোনটা সামনে রেখে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সমাবেশ মঞ্চে অর্ধশত রাজনৈতিক দলের ঐক্য সৃষ্টি হয়েছে, এই প্রশ্ন নিয়ে শুরু থেকেই ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে। এই ধোঁয়াশা সৃষ্টি সরকারপক্ষ কিংবা মিডিয়া করেনি। নিজেরাই নিজেদের অস্পষ্ট ও কুশায়াচ্ছন্ন করে দিয়েছেন। মঞ্চ থেকে ঘোষণায় বলা হয়েছে, ‘সরকার ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বর্তমান সংসদ ভেঙে দিতে হবে। এমন দাবি পূরণ না হলে পহেলা অক্টোবর থেকে দেশব্যাপী ঐক্যবদ্ধভাবে সভা-সমাবেশ করা হবে। সরকারকে বাধ্য করা হবে জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিতে।’ এ ঘোষণা থেকে সুস্পষ্ট, সরকারকে নির্বাচনী পরিবেশের দাবি মানতে ‘বাধ্য’ করতে আন্দোলনের জন্য ঐক্য করা হয়েছে।

কিন্তু পরদিনই বিবিসির সাক্ষাৎকারে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার প্রধান ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘তার দল বর্তমান সংবিধান অনুসারেই নির্বাচনে যেতে রাজি। ...তাদের জোট নির্বাচনবিরোধী জোট নয়। এটি কেবল একটি নির্বাচনী প্লাটফর্ম।’ তিনি আরো বলেন, ‘এটা তার দলের সিদ্ধান্ত। জোটের সঙ্গে বর্তমান সংবিধানের ভিত্তিতে নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি।’ প্রশ্ন হলো উল্লিখিত জোট কি সরকারকে সুষ্ঠু নির্বাচনে ‘বাধ্য’ করার জন্য আন্দোলনের প্লাটফর্ম নাকি ‘নির্বাচনী প্লাটফর্ম’? যদি নির্বাচনী প্লাটফর্ম হয়, তবে ‘দাবি’ আদায় করার পরই কেবল ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনে যাওয়া হবে বলে সমাবেশ মঞ্চ থেকে সুস্পষ্ট ঘোষণা দেয়া হলো না কেন? সংবিধানের ভিত্তিতে নির্বাচন হলে নির্বাচন বয়কট করার কথা বলা হলো না কেন?

এই প্রশ্নের গভীরে গেলেই বুঝা যাবে, এই ঐক্যে ফাঁক কোথায়? প্রসঙ্গত, ড. কামাল দুটি সংগঠনের প্রধান। একটি রাজনৈতিক দল গণফোরাম। আর একটি জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া। এক টকশোতে শুনলাম, নাগরিক ঐক্য প্রধান মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, ‘ড. কামালের ভাষ্য অনুযায়ী জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া একটি সামাজিক সংগঠন।’ তাই বলা যায়, সামাজিক সংগঠনের ব্যানারে রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনৈতিক দাবি আদায়ের জন্য ঐক্য হয়েছে। বলতেই হয় এটা অদ্ভুত! কিন্তু প্রশ্ন হলো- ড. কামাল দলে সিদ্ধান্ত নিলেন, সংবিধানের ভিত্তিতে নির্বাচন করবেন। আর এমন একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি তার ‘নির্বাচনী প্লাটফর্ম’-এ আলোচনা করলেন না কেন? মানুষকে এত বোকা ভাবা ঠিক নয়। বিবিসিকে ড. কামাল যা-ই বলুন না কেন, নির্বাচনের আছে মাত্র ৩ মাস। যখন কোনো আন্দোলন নেই, তখন বর্তমান সংবিধানের ভিত্তিতে নির্বাচনে যাওয়া নিয়ে আলোচনা হয়নি, এই কথা দেশবাসী বিশ্বাস করে না। পুরো জীবনের মতো বর্তমান পর্যায়েও অবিশ্বাস দিয়েই কাজ শুরু করলেন ড. কামাল।

অবস্থা পর্যবেক্ষণে এটা সুস্পষ্ট, ‘মুখে শেখ ফরিদ আর বগলে ইট’- এই কৌশল নিয়ে নবরূপপ্রাপ্ত ঐক্য প্রক্রিয়া অগ্রসর হতে চাইছে। দাবি আদায়ের জন্য সরকারকে চাপ দিতে আন্দোলন কথাটা তারা সামনে রাখবেন। আন্দোলনের নামে মাঠে নামলে সব ধরনের ‘এন্টি আওয়ামী লীগ’ মনোভাবের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হবে। যেমন হয়েছেন ব্যারিস্টার মইনুল ও ডা. জাফরউল্লাহর মতো সুপরিচিত ও সুচিহ্নিত ব্যক্তিরা! এই জগাখিচুড়ি ঐক্যের ছায়াতলে বিধ্বস্ত বিএনপি ও নীরবে থাকা নিবন্ধন না পাওয়া জামায়াত তৃণমূলে জেগে উঠবে। যদি সত্যিই জেগে ওঠে তবে দুটো অপশন সৃষ্টি হবে। জেগে ওঠা শক্তি নিয়ে নির্বাচনে যাওয়া কিংবা আন্দোলনকে আরো অগ্রসর করে নেয়া। ড. কামালের দল গণফোরাম যেহেতু সংবিধানের ভিত্তিতে নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে এবং যেহেতু ওই দল অনেক আসন এবং প্রধানমন্ত্রীর পদও পেতে পারেন, তাই তারা তখন হয়তো থাকবেন নির্বাচনের দিকে।

কিন্তু ওই ঐক্যে যারা ড. কামালকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মানবেন না কিংবা আসন দিতে চাইবেন না, তারা কোন দিকে থাকবেন? নিঃসন্দেহে পক্ষের জাগরণকে আরো অগ্রসর করে নিতে চাইবেন। আওয়ামী লীগের মতো গণসমর্থনপুষ্ট দলকে ‘বাধ্য’ করা সহজ হবে না। তখন তারা ওই আন্দোলনকে অরাজকতার দিকে নিয়ে গিয়ে নির্বাচন ভণ্ডুল করার দিকে নিয়ে যেতে চাইবেন। শক্তি কার বেশি ড. কামালের গণফোরামের নাকি যারা ড. কামালকে প্রধানমন্ত্রী চাইবেন না বা নির্বাচন ভণ্ডুল করতে চাইবেন তাদের? নিঃসন্দেহে দ্বিতীয় পক্ষের থাকবে বেশি। তাই নির্বাচন ভণ্ডুল হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি থাকবে। আর নির্বাচন ভণ্ডুল মানেই তো সাংবিধানিক ছেদ, অনির্বাচিত ও অবৈধ শক্তি ক্ষমতায় আসা। বাস্তবে এই ঐক্যের মধ্যে যারা যড়যন্ত্র-চক্রান্ত দেখেন না তাদের এই দিকটা আড়াল না করে সামনে আনতে এবং ভেবে দেখতে বলি। আর যারাই ভাববেন, তারাই বলবেন এই ঐক্য গণতন্ত্রের নাম মুখে এনে মাঠ গরম করতে চাইলেও যদি এই ঐক্য অগ্রসর হয়, তবে তা গণতন্ত্রের জন্য চরম ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। দেশ আবারো পড়বে সেই অগণতান্ত্রিক অবৈধ শক্তির হাতে।

বাস্তবে এখন গণফোরাম ও ঐক্য প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ড. কামাল সংবিধানের ভিত্তিতে নির্বাচন প্রশ্নে যে ফাঁক রাখছেন, সেই ফাঁকই এক সময় গণতন্ত্রের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। বলাই বাহুল্য এই ফাঁক আরো ফাঁকের জন্ম দিয়ে মূল ফাঁককে বাড়িয়ে দিবে। সৃষ্টি করবে সংবিধান ও গণতন্ত্রের বিপদ। ইতোমধ্যে দেখা যাচ্ছে সমাবেশ মঞ্চে যে ঐক্য হয়েছে, তাতেই এখন দেশবাসীর মনে নানা ধোঁয়াশার জন্ম দিচ্ছে। ড. কামাল বলেছিলেন, জামায়াতের সঙ্গে কোনো ঐক্য হবে না। ড. বদরুদ্দোজা চৌধুরীও বলেছেন একই কথা। কিন্তু বিএনপি তো এখনো রয়েছে জামায়াতের সঙ্গে ২০ দলীয় জোটে। অর্থাৎ প্রত্যক্ষ না হোক পরোক্ষ ঐক্য তো রয়েই গেছে। প্রশ্ন হলো, বিএনপি কি এই দুই ঐক্যই রাখবে?

ড. কামাল যদি গণফোরাম ও জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া তথা দুই সাইনবোর্ড এবং দুই সিদ্ধান্ত রাখতে পারেন, তবে বিএনপি পারবে না কেন? বিএনপির তুলনায় ড. কামালের শক্তি হচ্ছে বিন্দুবৎ। তাই ‘বৃহত্তর ঐক্যের’ পাল্লা থাকবে সব সময়ই বিএনপির দিকে সর্বৈবভাবে ঝুঁকে। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তির প্রশ্নে ড. কামাল তো প্রথমেই মাথানত করে দিয়েছেন। ওই নত মাথা তিনি আর তুলতে পারবেন বলে মনে করার কোনো কারণ নেই।

কথা ও কাজের ফাঁক রেখে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো যায় না। ফাঁক যে আরো কত রয়েছে! গুনে শেষ করা যাবে না। মঞ্চের ঐক্য কি আসলে কোনো ঐক্যজোট? কমবেশি ৫০টি দল। ভাবুন তো পাঠকরা, বিএনপির আছে ২০ দলীয় জোট। ড. কামালের দুই সংগঠন। ডা. বদরুদ্দোজা, আ স ম রব, মাহমুদুর রহমান মান্না প্রমুখের দল রয়েছে আবার যুক্তফ্রন্টও রয়েছে। এত দল আর এত দিক সামলানোর সাধ্য আছে কার? মঞ্চ-ঐক্য আর অন্দোলনের ঐক্য বা নির্বাচনী ঐক্যের ফারাক আকাশ-পাতাল। এই সমালোচনার দিকটি সামনে এনে রাজনৈতিক এক সহকর্মী গতকাল রাজনৈতিক আড্ডায় মহানগর নাট্যমঞ্চের তিন ঘুমন্ত নেতার ছবি ফেসবুক থেকে বের করে দেখালেন। এত দিক সামলাতে তারা কি পারবেন এই বয়সে? কে হবেন নেতা? ইতোমধ্যে পত্রপত্রিকায় ডক্টর ও ডাক্তারের অবস্থান কি হবে তা নিয়ে নানা মুখরোচক খবর বের হচ্ছে। বিএনপি ডা. বদরুদ্দোজার বাসায় গিয়ে মান ভাঙিয়ে নাট্যমঞ্চের সমাবেশে এনেছে। মাহি চৌধুরীর আওয়ামী লীগ কানেকশন নিয়ে নানা কথা এখন মানুষের মুখে মুখে। বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে ডা. বদরুদ্দোজাকে ভরসা করা যায় না। আর ড. কামাল আওয়ামী লীগ ঘরানার, তাই বিশ্বাস করা কঠিন। কথিত এই ঐক্যের সাংগঠনিক রূপ দিতে গেলেই বাধবে বিপত্তি। কর্নেল অলি ও জেনারেল ইব্রাহীম মঞ্চ-ঐক্যে যোগ দেননি। আর যৌথ নেতৃত্ব! কোনো দল বা জোট পরিচালনায় এমন নেতৃত্ব কখনো কার্যকর হয় না। আন্দোলন কিংবা নির্বাচন, যা-ই করতে যাওয়া হোক না কেন, সামনে রাখতে হবে প্রধান নেতা। এটাই মূল সমস্যা কথিত এই জোটের। আর এমন জগাখিচুড়ি ঐক্য ও নেতৃত্ব থাকলে নির্বাচনের আসন বণ্টন করতে গেলে কি হবে অবস্থা তা ভাবলে এই ঐক্যের ভবিষ্যৎ যে অশ^ডিম্ব প্রসব তা এখনই স্পষ্ট।

এসব বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, আদৌ নির্বাচনের লক্ষ্য নিয়ে নয়, আন্দোলনের ঘোষণা দিয়ে মাঠে নেমে নির্বাচন ভণ্ডুল করাটাই এই জোটের মূল কাজ হয়ে দাঁড়াবে। এটা তো জানাই আছে যে, ড. কামালসহ নিরপেক্ষ দাবিদার বুদ্ধিজীবীরা ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা কার্যকর করার জন্য ১/১১-এর জরুরি আইনের সরকারের সময় মাঠে নেমেছিলেন। আসলে এটা এখনো রয়েছে তাদের নীলনকশায়। বাস্তবে আদালত খালেদা জিয়াকে অনেকটাই মাইনাস করে দিয়েছে। যদি আন্দোলনের ধুয়া তুলে অবৈধ শক্তিকে ক্ষমতায় আনা যায়, তবে হাসিনাকে মাইনাস করা যাবে। এই নীলনকশার মধ্যেই রয়েছে ‘মুখে শেখ ফরিদ আর বগলে ইট’ রাখা কৌশলের আসল রহস্য।

এখনকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বলা যায় যে, কথিত এই জোট যদি সারা দেশে সভা সমাবেশ করতে মাঠে নামে এবং জামায়াতের লোকজন কিংবা নির্বাচনবিরোধী অরাজকতার শক্তি যদি এই জোটের ছাতার নিচে জমায়েত হয়ে ঘটনা ঘটাতে থাকে, তবে সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নামতে বাধ্য হবে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলীয় জোটও তখন বসে থাকবে না। তখন কি হবে? আবারো ২০১৩-১৪ সালের মতো রাস্তায় অরাজক, অস্থিতিশীল পরিস্থিতি কি সৃষ্টি হবে না? অশুভ অবৈধ অগণতান্ত্রিক অন্ধকারের শক্তি কি তখন বিগত দুবারের মতো বসে থাকবে? গণতন্ত্রের শেষ রক্ষাকবচ সংবিধান কোথায় যাবে? কোথায় যাবে গণতন্ত্র? এ কারণেই যেসব দল, শক্তি, গোষ্ঠী, মহল, ব্যক্তি সংবিধান ও গণতন্ত্র চান তারা হতাশ হবেন। কথিত ওই ঐক্যের ‘মুখে শেখ ফরিদ আর বগলে ইট’ রাখার কৌশলের বিপক্ষে তাদের দাঁড়ানো সময়ের দাবি। সংবিধানের ভিত্তিতে সুষ্ঠু অবাধ নিরপেক্ষ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হোক, ঐক্য প্রক্রিয়া নির্বাচনকালীন সরকার কেমন চায় সেই ইস্যুসহ কর্মসূচি সামনে রাখুক, সরকারি জোটও কি চায় তা অঙ্গীকার করুক, জনগণ সংবিধান ও গণতন্ত্রের মালিক হোক; এটাই নির্বাচন সামনে রেখে জনগণের একান্ত কামনা।

শেখর দত্ত : রাজনীতিক ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App