×

জাতীয়

কোন্দলে অস্থির তৃণমূল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১২:২২ পিএম

কোন্দলে অস্থির তৃণমূল
জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রকট হতে শুরু করেছে আওয়ামী লীগের মাঠপর্যায়ের কোন্দল। আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশীদের পারস্পরিক হানাহানি, অভিযোগ-পাল্টাঅভিযোগ ও বিষোদ্গারে কেন্দ্রের নানা উদ্যোগ কাজে আসছে না তেমন। মাঠপর্যায়ের এসব সমস্যা নিরসনে বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকরা তীক্ষ্ন নজর রাখছেন। অনেক ক্ষেত্রে তৃণমূল নেতাদের ঢাকায় ডেকে বিরোধ মিটিয়েও দেয়া হচ্ছে। সম্প্রতি তিন জেলায় এমপিদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা। যা দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। ভাবিয়ে তোলে দলীয় হাইকমান্ডকে। গত ৬ সেপ্টেম্বর গণভবনে দলটির কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকেও মূল আলোচনায় ছিল তৃণমূল নেতাদের এই বিভেদ-কোন্দলের বিষয়টি। বৈঠক থেকে তিন সংসদ সদস্যসহ কয়েকজন নেতাকে শোকজের সিদ্ধান্ত হয়। গত সোমবার ১৪ জনকে কুরিয়ারযোগে শোকজ নোটিস পাঠায় কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কর্নেল (অব.) ফারুক খান এ প্রসঙ্গে ভোরের কাগজকে বলেন, বড় দলে ছোটখাটো কিছু সমস্যা থাকে। তবে নির্বাচনের আগে তৃণমূলে মনোনয়নকে কেন্দ্র করে প্রার্থী ও নেতাকর্মীদের মধ্যে যেন কোনো প্রকার বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়, সে ব্যাপারে দলীয় হাইকমান্ড সতর্ক রয়েছে। মনোনয়ন ঘোষণা হলেই সবাই নৌকার পক্ষে কাজ করবে এটা বরাবরই হয়ে থাকে। তারপরও কেউ বিশৃঙ্খলা করে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণের চেষ্টা করলে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এদিকে দিনাজপুর, বরগুনা ও রাজশাহীর ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণার পরও বরিশাল-৪ (হিজলা-মেহেন্দীগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ দেবনাথের বিরুদ্ধে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করেন ওই এলাকার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের একটি অংশ। সংবাদ সম্মেলনে তার বিরুদ্ধে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ, হত্যা, চোরাচালান, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা ও নৈরাজ্যসহ নানা অপকর্মের অভিযোগ এনে আগামী নির্বাচনে তাকে দলীয় মনোনয়ন না দেয়ার দাবি জানানো হয়। কুমিল্লা-৯ আসনের সংসদ সদস্য তাজুল ইসলামের মনোনয়ন ঠেকাতে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ হচ্ছেন। তার বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও স্বোচ্চার হয়েছে দলের একটি গ্রুপ। ১৫ আগস্ট রাতে শোক দিবসের একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য চলাকালীন নীলফামারী-৩ (জলঢাকা) আসনের সংসদ সদস্য অধ্যাপক গোলাম মোস্তফাকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা আখ্যা দিয়ে তাকে বক্তব্য দিতে বাধা দেন উপজেলা যুবলীগের সাবেক বহিষ্কৃত সভাপতি আবদুল ওয়াহেদ বাহাদুর। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে উভয়পক্ষের সমর্থকদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে বাহাদুরকে গ্রেপ্তারের দাবিতে সমর্থকদের নিয়ে শহরের জিরো পয়েন্টে অবস্থান নেন এমপি নিজেই। ৩ ঘণ্টা পর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানকের হস্তক্ষেপে অবরোধ তুলে নেন এমপি। পরবর্তীতে সেই ঘটনার কোনো সুরাহা হয়নি। ফলে যে কোনো সময় বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে ওই এলাকায়। নোয়াখালী-৬ (হাতিয়া) আসনের সংসদ সদস্য আয়েশা ফেরদৌস। তার স্বামী সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে নানা অপকর্ম, বিএনপি-জামায়াত প্রীতি, জমি দখল, সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ও নিজ দলের কয়েকজন নেতাকর্মীকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। ফলে ওই এলাকার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ। আয়েশা ফেরদৌস সংসদ সদস্য হলেও ওই এলাকার সকল কর্মকান্ড পরিচালনা করেন তার স্বামী মোহাম্মদ আলী। এলাকাবাসীর চাপে তিন বছর ধরে মোহাম্মদ আলী এলাকায় যেতে পারেন না। তার বিরুদ্ধে রয়েছে বেশ কয়েকটি মামলা। জেলা আওয়ামী লীগের নেতারাও তার প্রতি চরম ক্ষুব্ধ। অভিযোগ আছে ঢাকায় থেকেই এলাকার রাজনীতি ও অন্যান্য কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণ করছেন তিনি। তার রয়েছে নিজস্ব সন্ত্রাসী ও ডাকাত বাহিনী। আগামী নির্বাচনে মোহাম্মদ আলী বা তার স্ত্রীকে মনোনয়ন দেয়া হলে কোনোভাবেই মানবেন না দলীয় নেতাকর্মীরা। প্রয়োজনে ঢাকায় এসেও মানববন্ধন বা অনশন কর্মসূচি পালন করতে পারেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা। এদিকে মনোনয়ন ঘোষণার দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, মাঠপর্যায়ে দলীয় এমপি ও মনোনয়নপ্রত্যাশী অন্য প্রার্থীদের মধ্যকার বিরোধ ততই প্রকট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। দিনাজপুর, বরগুনা ও রাজশাহীর মতো অবাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা আরো ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। মাঠপর্যায়ে এই যখন অবস্থা তখন তৃণমূলের এ বিরোধকে কোন্দল বলতে রাজি নন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, মাঠপর্যায়ে আমাদের নেতাকর্মীদের মধ্যে কোনো কোন্দল নেই, প্রতিযোগিতা আছে। যা নোংরামীর পথে যাচ্ছিল। নির্বাচনের আগে তা প্রকাশ্য হতে শুরু করে। দলের পক্ষ থেকে আমরা কঠোর নজরদারি করছি। যেখানে বিশৃঙ্খলা, সেখানেই তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। কি ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে ১৪ জনকে শোকজ নোটিশ পাঠানো হয়েছে। কোথাও বিশৃঙ্খলা দেখা দিলেই দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। এর আগে দুর্নীতি, মাদক বাণিজ্য, অপরাজনীতি, বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে সখ্যতা এবং মিথ্যা মামলায় দলীয় কর্মীদের হয়রানির অভিযোগ এনে বরগুনা-১ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ধীরেন্দ্রনাথ শম্ভুু, দিনাজপুর-১ (বীরগঞ্জ-কাহারোল) আসনের সংসদ সদস্য মনোরঞ্জন শীল গোপাল ও রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর) আসনের সংসদ সদস্য আবদুল ওয়াদুদ দারাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। দাবি তোলা হয় আগামী নির্বাচনে তাদের দলীয় মনোনয়ন না দেয়ার। এ ছাড়া দ্ব›দ্ব রয়েছে শেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জাতীয় সংসদের হুইপ আতিউর রহমান আতিকের সঙ্গে নকলা-নালিতাবাড়ি আসনের এমপি ও কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর। গত মে মাসে মতিয়া চৌধুরীকে এবার মনোনয়ন না দিতে মনোনয়ন বোর্ডের প্রতি সুপারিশ জানায় জেলা আওয়ামী লীগ। কয়েকমাস পূর্বে নাটোরের গুরুদাসপুর-বড়াইগ্রাম আসনের এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল কুদ্দুসকে বয়কটের ঘোষণা দেয় দলের একটি অংশ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে নির্বাচনের পূর্বে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা যেভাবে বিতর্কিত ও অবাঞ্ছিত হচ্ছেন, তাতে জনমনে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। কেন্দ্রীয় নেতাদের কড়া বার্তাও খুব একটা কাজে আসছে না। দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার সরাসরি হস্তক্ষেপ ছাড়া এ পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণ সম্ভব নয় সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। দলের আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা চর্চার কথা মুখে বললেও বেশিরভাগ নেতাকর্মীরা বাস্তবে তা না মানার প্রবণতা এবং তৃণমূলে দল এবং সহযোগী ও ভাতৃপ্রতীম সংগঠনগুলোর নিয়মিত সম্মেলন না হওয়াকেও এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী করছেন তারা। এ ছাড়া সব ধরনের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও যোগ্য জায়গায় আসীন হতে না পারার বেদনা থেকেও অনেক নেতা নিজেকে বঞ্চিত মনে করে নিজেরা নানা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছেন। ঢাকা বিশ্ব্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. শান্তনু মজুমদার বলেন, যেভাবে আওয়ামী লীগের এমপিরা একের পর এক অবাঞ্ছিত হচ্ছেন তাতে মনে হচ্ছে নির্বাচনের পূর্বে এ ধরনের ঘটনা আরো ঘটতে পারে। দলের শীর্ষ নেতারা সমস্যা সমাধানে চেষ্টা করছেন ঠিকই, তাতে সুফল মিলছে না। দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ ছাড়া এ সমস্যা নিসরন হবে না। কারণ, মনোনয়ন প্রত্যাশীরা প্রত্যেকেই নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে চান। মাঠে কর্মীদের নিয়ে তারা বিভিন্ন গ্রুপ-উপগ্রুপ সৃষ্টি করেন। এলাকায় মহড়া দেন, মিছিল-সমাবেশ করেন। পরস্পর-পরস্পরকে কালিমা লিপ্ত করছেন। অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল ও নিজেকে যোগ্য মনে করে প্রত্যেকেই এমপি হতে চান। আর এখানেই যত সমস্যা। বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা না গেলে অনেক আসনেই আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীও দাঁড়িয়ে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা এই রাজনৈতিক বিশ্লেষকের।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App