×

অর্থনীতি

মামলায় আটকে আছে ৬২ হাজার কোটি টাকা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১১:০৬ এএম

মামলায় আটকে আছে ৬২ হাজার কোটি টাকা
ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করার প্রবণতা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৯ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে উচ্চ আদালতে দায়ের করা বিভিন্ন রিট মামলায় আটকে আছে ৬২ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ। এর মধ্যে অর্থঋণ সংক্রান্ত ৩ হাজার ৫৬৭টি রিট মামলায় ২৫ হাজার কোটি টাকা ও ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো (সিআইবি) সংক্রান্ত ৫১১টি রিট মামলায় আটকে থাকা অর্থের পরিমাণ ২৬ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া অন্যান্য ১ হাজার ৭৯০টি রিট মামলায় ১১ হাজার কোটি টাকা আটকে আছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, দেশি-বিদেশি ৬৩টি ব্যাংক ও ২৯টি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান মিলে দেশের আর্থিক বাজার আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেকগুণ বড়। খেলাপি ঋণগ্রহীতা এবং এ সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা বাড়ছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত হিসাবে শুধু হাইকোর্টেই অনিষ্পন্ন রিট মামলার সংখ্যা ৬ হাজারের কাছাকাছি, যাতে জড়িত টাকার পরিমাণ ৬০ হাজার কোটিরও বেশি। এসব মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি হলে খেলাপি ঋণ আদায়ের পাশাপাশি বিনিয়োগ ও উৎপাদনবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। ব্যাংকসংশ্লিষ্টরা জানান, ঋণখেলাপিরা ঋণ পরিশোধ না করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে বিভিন্ন অজুহাতে হাইকোর্টে রিট মামলা দায়ের করেন। এ ছাড়া দেশের জেলা পর্যায়ের আদালতের বিভিন্ন প্রকারের মামলায় দেয়া আদেশের বিরুদ্ধেও আপিল করেন তারা। উপরন্তু খেলাপি গ্রাহকরা এক ব্যাংকে খেলাপি থাকা অবস্থায় অন্য আরেক ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার জন্য খেলাপি ঋণের বিষয়টি যাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি তথ্যভান্ডারে অন্তর্ভুক্ত না হয় সে জন্য উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দায়ের করেন। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, অর্থঋণ আদালতের রায়ের ৯০ ভাগ ব্যাংকের পক্ষে আসে। কিন্তু আইনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ঋণখেলাপিরা ইচ্ছাকৃতভাবে নানা কৌশলে ঋণ পরিশোধ বিলম্বিতের জন্য রিট মামলা দায়ের করেন। আর্থিক খাতসংক্রান্ত রিট মামলাগুলোর নিষ্পত্তি ত্বরান্বিতের জন্য হাইকোর্ট বিভাগে দুটি পৃথক বেঞ্চ গঠনের উদ্যোগ নিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। জানা গেছে, অনিয়ম-দুর্নীতি ও লুটপাট থেকে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতকে রক্ষায় ১৯৯৮ সালে তিনটি সুপারিশ করে বিশ^ব্যাংক। এগুলো হলো কঠোর নিয়ন্ত্রণমূলক পদ্ধতি, দক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং কার্যকর আদালত ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এগুলো নিশ্চিত করা না হলে আমানতের সুরক্ষা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে ঋণ বিতরণ সম্ভব হবে না। গত ২০ বছরে ব্যাংক খাতে ওই তিন প্রস্তাবের কোনোটিই বাস্তবায়ন হয়নি। ২০০৩ সালে বাংলাদেশের আর্থিক খাত নিয়ে পর্যালোচনা করে টেকসই ব্যাংক খাত গড়ে তুলতে বেশকিছু সুপারিশ করে বিশ^ব্যাংক ও আইএমএফ (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল)। অর্থঋণ আদালত আইন সংশোধন করে খেলাপি অর্থ আদায়ে ব্যাংকের ক্ষমতা বাড়ানোর সুপারিশ করেছিল সংস্থা দুটি। ঋণখেলাপিরা যাতে উচ্চ আদালত থেকে সাদা হয়ে এসে আবার নতুন করে ঋণ নিতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করতেও বলা হয়েছিল। সেগুলোও বাস্তবায়ন হয়নি। ওই সময় সংস্থা দুটি বলেছিল, ব্যাংক খাতের বেশির ভাগ অনিয়মই চিহ্নিত করতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে সেগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে না। এদিকে, উচ্চ আদালতের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে আলাদা বেঞ্চ গঠনের অনুরোধ জানিয়ে বেশ কিছুদিন আগে দুদফা এবং সম্প্রতি একবার মোট তিন দফা আইনমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। চিঠিতে তিনি অর্থঋণ সংক্রান্ত রিটে ব্যাংক খাত ক্ষতিগ্রস্তের চিত্র তুলে ধরেন। কিন্তু এরপরও কোনো কাজ হয়নি। এ ছাড়া অর্থঋণ আদালত আইন সংশোধনের সুপারিশ করে আইন কমিশন। তাদের সুপারিশ সত্ত্বেও অর্থঋণ আদালত আইন সংশোধনের জন্য কোনো অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি। আইন কমিশনের মতে, আর্থিক ঋণের সংজ্ঞায় রয়েছে দুর্বলতা। বিদ্যমান আইনের দুর্বলতার কারণে মামলা নিষ্পত্তির হার কম। ঋণ আদায়ে বিবাদীদের প্রতি সমন জারির প্রক্রিয়াও দুর্বল। এসব কারণে অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত অপরাধীর বিচার করা সম্ভব হচ্ছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একতরফা ডিক্রি জারির পরেও বিবাদীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পুনরায় বিচারকাজ শুরু হওয়ার সুযোগ থাকছে। জানা যায়, খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক পারফরমেন্স খারাপ হচ্ছে। ব্যাংকগুলো শ্রেণিকৃত ঋণ আদায় করতে অর্থঋণ আদালতে মামলা করে। সেখানে রায় হওয়ার পরও উচ্চ আদালতে রিট করে স্থগিতাদেশের মাধ্যমে সেই অর্থ বছরের পর বছর আটকে রাখে। ফলে কিছু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান মূলধন সংকটেও পড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ইব্রাহিম খালেদ বলেন, এ বিষয়ে আমরা আগেই বেশকিছু সুপারিশ দিয়ে এসেছিলাম। প্রথমত, হাইকোর্টে খেলাপি ঋণসংক্রান্ত রিট মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পন্ন করতে একটি বা দুটো পৃথক বেঞ্চ গঠন করতে হবে। দ্বিতীয়ত, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী আইনজীবী নিয়োগ দিতে হবে। কিন্তু সেই সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ নেই।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App