×

জাতীয়

নড়িয়ায় কিস্তি আতঙ্ক

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১২:১৭ পিএম

নড়িয়ায় কিস্তি আতঙ্ক
রাক্ষসী পদ্মার তীব্র ভাঙন শুধু নড়িয়ার হাজার হাজার মানুষকেই নিঃস্ব করেনি, ফাটল ধরিয়েছে স্থানীয় অর্থনীতিতেও। এলাকার বড়, মাঝারি কিংবা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সবারই এখন মাথায় হাত। যেসব জমি দেখিয়ে তারা বিভিন্ন সময় ব্যাংক ঋণ নিয়েছিলেন কিংবা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে যেসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছিলেন; সেগুলো এখন পদ্মার গর্ভে চলে গেছে। ব্যাংকের কিস্তির টাকা পরিশোধ এখন সর্বস্ব হারানো মানুষগুলোর জন্য ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’। ফার্নিচার ব্যবসায়ী মো. আমান খানের দোকান ছিল মুলফৎগঞ্জ বাজারে। মেসার্স মায়ের দোয়া ফার্নিচার নামের যে দোকানটি মর্গেজ দিয়ে তিনি অগ্রণী ব্যাংক থেকে চার লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন, সেটি এখন পদ্মার গর্ভে। ঋণের কিস্তি কীভাবে পরিশোধ করবেন সেই দুর্ভাবনায় দিন কাটে আমান খানের। তিনি বলেন, ‘খাই আর না খাই ব্যাংকের টাকা তো শোধ করতে হইব। এ থেইকা তো মাফ নাই। কিন্তু এত টাকা পামু কই? সুদের টাকা ছয় মাস মওকুফের জন্য মৌখিকভাবে ব্যাংকের ম্যানেজারের কাছে আবেদন করছিলাম। তিনি কিছু জানাননি।’ পদ্মায় বসতভিটা বিলীন হওয়ার পর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে উত্তর কেদারপুরে আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছেন নিরাশা মন্ডল (৫০) ও সরস্বতী রানী দাস (৫২)। তারা দুজনেই গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ৫০ হাজার টাকা করে ঋণ নিয়েছিলেন। প্রতি সপ্তাহে সেই ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হয় এক হাজার ৫০ টাকা। কিন্তু এখন তাদের যে অবস্থা তাতে কিস্তির টাকা শোধ তো দূরে থাক, নুন আনতেই পান্তা ফুরায়। হতাশ কণ্ঠে নিরাশা মন্ডল বলেন, ‘ব্যাংক থেইকা লোন নিয়া পোলাডারে বাজারে একটি সেলুনের দোকান দিয়া দিছিলাম। দোকান ভালোই চলতেছিল। কিন্তু নদী সব সুখ কাইরা নিছে। কিস্তি নিতে ব্যাংকের লোক আসে কদিন পরপরই। এখন খামু না কিস্তির টাকা শোধ দিমু?’ মুলফৎগঞ্জ বাজারের ইজারাদার মো. শাহেদ ব্যাপারি বলেন, ‘গত তিন বছর ধইরা এই বাজার ইজারা নিই আমি। এ বছর ৩০ শতাংশ সরকারি ভ্যাটসহ ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা দিয়া এক বছরের জন্য বাজারের ইজারা পাইছি। গত বৈশাখ মাসে ইজারা পাওয়ার পর ৭০ হাজার টাকাও তুলতে পারি নাই। বাজারের অর্ধেক অংশই নদীভাঙনে তলায়ে গেছে। গ্রামীণ ব্যাংক থেকে লোন নিছিলাম ৫০ হাজার টাকা। প্রতি সপ্তাহে কিস্তি দিতে হয় ১৪শ’ টাকা। ১১ মাসের কিস্তির মধ্যে মাত্র দুই মাস কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে পারছি। বাকি কিস্তির টাকা কেমনে শোধ দিমু ভাইবা পাই না।’ ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত নড়িয়া উপজেলার কেদারপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ইমাম হোসেন দেওয়ান বলেন, ‘পদ্মার এবারের ভাঙনে যা ক্ষতি হইছে তা সারা জীবনেও পুষাইয়া উঠতে পারমু না। শুধু আমার না, এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত প্রত্যেকটা মানুষ জীবনেও এ ক্ষতি পূরণ করতে পারব না। আমাদের দেওয়ান ক্লিনিকের তিনতলা ভবন, বেগম রওশন আরা শপিংমল, স্টিলের আলমারির কারখানা সবই গিলে খেয়েছে রাক্ষসী পদ্মা।’ মুলফৎগঞ্জ বাজার বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলম হোসেন লস্কর জানান, চারশ’ বছরের পুরনো এই বাজারে এক সময় সবই ছিল। কিন্তু আজকে আছে শুধু আতঙ্ক। বাজারের একাংশ এখন পদ্মার পেটে। পূর্ব নড়িয়া থেকে সাধুর বাজার পর্যন্ত তিন শতাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ বহুতল ভবন নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। যার আনুমানিক মূল্য কয়েক শত কোটি টাকা। নদীভাঙনের ফলে ব্যাংকগুলোও এসব এলাকা থেকে তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে অন্যত্র চলে গেছে। ক্ষুদ্র ঋণদাতা সংস্থাগুলোও বিনিয়োগ কমিয়ে দিয়েছে। বলা যায়, প্রায় বন্ধই করে দিয়েছে। ব্যবসায়ীরা মূলধন সংকটে পড়েছে। যার বিরূপ প্রভাব পড়ছে এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App