×

মুক্তচিন্তা

মানবিক মূল্যবোধ আর মানবাধিকার

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৭:২৮ পিএম

মানুষের জন্যই রাজনীতি, মানুষের জন্যই ধর্ম, ধর্মের জন্য বা রাজনীতির জন্য মানুষ নয়, এ সত্যটি যতদিন আমরা উপলব্ধি করতে না পারব, ততদিন সমাজ থেকে হানাহানি-নৈরাজ্য দূর হবে না। কীভাবে আমরা ভুলে যাই, এই বাংলাদেশ প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে লাখো প্রাণের এক নদী রক্ত আর সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জন করেছে নতুন এ মানচিত্র, অর্জন করেছে জাতীয় সঙ্গীত আর লাল-সবুজের পতাকা। যদি আমার স্বাধীনতা বিপন্ন হয়, তাহলে মানবাধিকার বলি, সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলি, সবই সুদূরপরাহত হয়ে যায়।

মানুষ তার সম্মান নিয়ে বাঁচবে, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যা তার প্রাপ্য, তা পাওয়ার অধিকার থেকে সে বঞ্চিত হবে কেন? সমাজের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে এটুকুই তো তার দাবি, কিন্তু মানুষ কি তার প্রাপ্য পাচ্ছে তার পরিপার্শ্বের কাছে? সমাজের কাছে অথবা রাষ্ট্রের কাছে? উত্তর যদি হয় ‘না’, সঙ্গত কারণেই তখন প্রশ্ন আসে, কেন? কোন অপরাধে মানুষ তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে? মানুষকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে কে? সাদা চোখে তাকিয়ে বললেও বলা যায়, মানুষের এ বঞ্চনার জন্য দায়ী মানুষই। মানুষের লোভ, হিংসা, স্বার্থান্ধতা, অসহিষ্ণুতাই বঞ্চিত করছে মানুষকে। আমার স্বার্থান্ধতার কারণে আজ যিনি বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন, আগামীকাল হয়তোবা তার ঈর্ষার কারণে বঞ্চিত হবো আমিও।

আমরা মানবাধিকারের কথা বলে চিৎকার করি, মানবাধিকার দিবস উদযাপন করি, বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা করি, সভা-সমাবেশ, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম-বৈঠক করি; আবার আমরা নিজেরাই মানবাধিকার লঙ্ঘনে ভ‚মিকা রাখি। আমার জমির ধান কেটে ‘সে’ আমার অধিকার হরণ করে, তা যেমন মানবাধিকার লঙ্ঘন, তেমনি ‘তার’ পথ খুঁড়ে আমি তার চলাচলে বিঘ্ন ঘটাই তখনো তা মানবাধিকার লঙ্ঘনই হয়। জন্মগতভাবেই আমি মানুষ ‘স্বার্থপর’, সেটা আমার অপরাধ নয়, কিন্তু আমি যখন স্বার্থান্ধ, সংকট দেখা দেয় তখন। ‘স্বার্থপর’ নিজের স্বার্থ বোঝে, অন্যের স্বার্থও বিবেচনা করে, কিন্তু ‘স্বার্থান্ধ’ কেবল নিজেরটাই বুঝে নিতে চায় আঠারো আনা। বুড়িগঙ্গার জল যারা দূষণ করে, বর্জ্য-আবর্জনা দিয়ে যারা নদ-নদী-খাল-বিল ভরাট করে তারা কি মানবাধিকার লঙ্ঘন করে না? সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারে যে ঘটনা ঘটে গেল, যে ঘটনার জের ধরে লাখ লাখ মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে দেশান্তরিত হয়ে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হলো, সেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানবাধিকারের বিষয়টি আমাদের যতটা আন্দোলিত করল; সে বিবেচনায় বিশ্ববিবেক কি আন্দোলিত হলো, সোচ্চার হলো? বাংলাদেশের নারীরা তাদের প্রাত্যহিকতায়, তাদের ঘরে, চলায়-বলায়-শিক্ষায়-কর্মক্ষেত্রে প্রতি মুহূর্তে যেভাবে বিপন্ন হচ্ছে, আমরা কি তাদের অধিকারের বিষয়টিকে আমলে আনছি? সমাজে রাজনৈতিক-সামাজিক কারণে প্রতিনিয়ত যখন একজন অন্যকে বিপন্ন করছি, হত্যা-লুণ্ঠন-নিগ্রহের মতো অপকর্মে লিপ্ত হচ্ছে, তা থেকে পরিত্রাণের প্রয়াশ কি চালাচ্ছি? জীবনে আমাদের প্রেম এবং বিশ্বাসের ঘাটতি এতটাই প্রবল হয়ে উঠেছে, মোহান্ধতা, লোভ, ব্যক্তি-গোষ্ঠীর স্বার্থান্ধতা, ধর্মীয় কূপমণ্ডূকতা এমন এক স্তরে পৌঁছেছে, যখন আমরা সহিষ্ণুতার ধারণাটি জীবন থেকে মুছে ফেলতে চাইছি। আমাদের এ বিপর্যয় উচ্চপর্যায় থেকে নিম্নপর্যায় পর্যন্ত পৌঁছেছে, সামাজের ‘বিবেক’ বলে খ্যাত বুদ্ধিজীবী থেকে ব্রাত্যজনকে পর্যন্ত গ্রাস করেছে। আমরা যেন মানবিক হওয়া থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। ১৯৮৮ সালে কবি নির্মলেন্দু গুণকে লেখা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার অসাধারণ একটি চিঠি থেকে সামান্য উদ্ধৃতি দিচ্ছি-

‘আপনার অনুরোধে কিছু ছবি পাঠালাম। তবে আমার একটা অনুরোধ রাখবেন। ত্রাণ বিতরণ করছি এ ধরনের কোনো ছবি কবিতার বইয়ে ছাপাবেন না। মানুষের দুর্দশার ছবি যত পারেন ছাপান। আমার ধারণা এ ধরনের অর্থাৎ ত্রাণ বিতরণের ছবি টেলিভিশন ও খবরের কাগজে দেখে দেখে মানুষ বীতশ্রদ্ধ হয়ে গেছে। ওরা গরিব, কিন্তু সেটা কি ওদের অপরাধ? একশ্রেণি যদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ আহরণ না করত তাহলে এরা কি গরিব হতো? কার ধন কাকে বিলাচ্ছে? যা কিছু আছে সবাই মিলে ভাগ করে ভোগ করলে একের কাছে অপরের হাত পাতার প্রয়োজন হতো না।

ওদেরই সম্পদ লুট করে সম্পদশালী হয়ে আবার ওদেরই দুর্দশার সুযোগ নিয়ে সাহায্যদানের নামে হাতে তুলে দিয়ে ছবি ছাপিয়ে ব্যক্তিগত ইমেজ অথবা প্রতিষ্ঠা লাভের প্রয়াস আমি মানসিকভাবে কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। আমার বিবেকে বাধে। তবুও অনেক সময় পারিপার্শ্বিক চাপে পড়ে অনেক কিছুই করতে হয়। আমিও করি। বিবেকের টুঁটি চেপে ধরে অনেক সময় সমাজ রক্ষার তাগিদে, সাথীদের অনুরোধ বা অপরের মান রক্ষার জন্য এ ধরনের কাজ বা ছবি তুলতে হয় বৈকি। তবে যে যাই দান করুক না কেন, বিলি করুক না কেন, এটা তো ওই গরিব মানুষগুলোর অধিকার, তাদেরই প্রাপ্য। ক্ষমতার দাপটে কেড়ে নেয়া ওদেরই সম্পদ অথবা ওদের পেটের ক্ষুধা দেখিয়ে দেশ-বিদেশ থেকে ভিক্ষে এনে এদের দান করা। এখানে ক্রেডিট নেয়ার সুযোগ কোথায়?’

চিঠিতে যে সত্য উচ্চারিত হয়েছে, সেই সত্যকে আমরা কি মেনে চলছি? যদি সবাই আমরা মানবিক হয়ে উঠতে পারতাম, হয়তো তাহলে চর্চায় আনার সুযোগ হতো।

মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার কথা যখনই বলি, তখনই আমাদের মনে রাখা চাই সবার মত-প্রকাশের স্বাধীনতার কথা; ভিন্নমতের প্রতি সহিষ্ণুতা প্রদর্শনের সংস্কৃতি মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত। কিন্তু লক্ষ করি, আমাদের সমাজে ভিন্নমত প্রকাশের জন্য তার প্রতি প্রায়শ নৃশংসতা প্রদর্শন করা হয়, তখনই তো লঙ্ঘিত হয় মানবাধিকার। আলোচনার প্রয়োজনে কয়েকদিন আগে পাবনায় ঘটে যাওয়া একটি নৃশংসতার কথা সামনে নিয়ে আসছি।

বেসরকারি টেলিভিশন আনন্দ টিভির পাবনা প্রতিনিধি, দৈনিক জাগ্রত বাংলা নামের একটি অনলাইন পোর্টালের সম্পাদক ও প্রকাশক সুবর্ণা নদীকে ২৮ আগস্ট ২০১৮ মঙ্গলবার রাত ১০টায় মোটরবাইকযোগে বাড়িতে এসে কুপিয়ে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা! লিখেছিলেন, ‘জীবনে যদি কিছু করে দেখাতে চাও, তাহলে একলা কীভাবে লড়তে হয়, তা শিখে নাও...।’ সুবর্ণা নদীর মৃত্যু কি প্রমাণ করে না আমাদের সমাজ কতটা অসহিষ্ণু আজ? কতটা নৃশংস হয়ে উঠেছে? আমরা কি তবে সাহস ও সত্যকে প্রযত্ন দিতে অক্ষম? আমরা কি সমাজের প্রাগ্রসর মানুষের কাছে প্রত্যাশা করতে পারি না সুবর্ণা নদীর লড়াইটি জারি রাখতে তারা উদ্যোগী হবেন? ব্যক্তির জয়-পরাজয় আছে, এ কথা যেমন সত্য; ‘স্বপ্ন চিরবিজয়ী’ সে কথাও তো মিথ্যে নয়! অল্প ক’দিন আগে ময়মনসিংহে রাজনৈতিক দলের বিভাজনে গ্রুপ বদল করায় নির্মমভাবে মরতে হলো ‘আজাদ’ নামের একজন কর্মীকে, যা নিয়ে আজো বিরাজ করছে উত্তেজনা। মানুষের স্বপ্নকে বিজয়ী করতে আমরা কি নিজেরা নিজেদের মানবিক করে তুলতে পারি না? মানবাধিকারের কথা উচ্চারণের আগে আসুন আমরা ব্রতী হই নিজের ভেতর মানবিক গুণাবলিকে জাগিয়ে তুলতে।

মানুষের জন্যই রাজনীতি, মানুষের জন্যই ধর্ম, ধর্মের জন্য বা রাজনীতির জন্য মানুষ নয়, এ সত্যটি যতদিন আমরা উপলব্ধি করতে না পারব, ততদিন সমাজ থেকে হানাহানি-নৈরাজ্য দূর হবে না। কীভাবে আমরা ভুলে যাই, এই বাংলাদেশ প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে লাখো প্রাণের এক নদী রক্ত আর সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জন করেছে নতুন এ মানচিত্র, অর্জন করেছে জাতীয় সঙ্গীত আর লাল-সবুজের পতাকা। যদি আমার স্বাধীনতা বিপন্ন হয়, তাহলে মানবাধিকার বলি, সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলি, সবই সুদূরপরাহত হয়ে যায়। দেশমাতৃকার অপরিশোধ্য ঋণের কথা কি আমরা ব্যক্তিগত-গোষ্ঠীগত হানাহানি, স্বার্থান্ধতা-ধর্মীয় কূপমণ্ডূকতার ঊর্ধ্বে স্থান দিতে পারি না? দুর্নীতিতে বিশ্বসেরা হলে, তা যে পরোক্ষে জাতির মানবাধিকারকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে; সে বোধোদয় কবে হবে আমাদের?

ফরিদ আহমদ দুলাল : কবি ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App