পার্বত্যাঞ্চলে শান্তি যেন সোনার হরিণ
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৩:৩০ পিএম
পার্বত্যাঞ্চলে শান্তি যেন এক সোনার হরিণ। সরকার এবং আঞ্চলিক দল এবং উপদলগুলোর মধ্যে বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলে দিন দিন পাহাড়ের অশান্তির আগুন জ্বলছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাহাড়ের শান্তি প্রতিষ্ঠায় চুক্তি বাস্তবায়নের পর থেকে ক্রমান্বয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। অন্যদিকে চুক্তি বাস্তবায়নে দেরি হওয়ার অজুহাতে আঞ্চলিক দলগুলো আবারো নিজেদের মাঝে দ্ব›দ্ব-সংঘাত জড়িয়ে পড়ছে।
আঞ্চলিক দলগুলোর কারণে পাহাড়ের মানুষ দিন দিন নির্যাতিত হচ্ছে। আঞ্চলিক দলগুলো নিজেদের মাঝে যেমন দ্ব›দ্ব সংঘাতে জড়াচ্ছে তেমনি অপহরণ, খুন, চাঁদাবাজি, ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের ফলে পাহাড়ি জনপদ এখন রক্তাক্ত।
পাহাড়ে যারা বসবাস করছেন তাদের অধিকাংশের মনে শান্তি নেই। প্রতিনিয়ত পাহাড়ের মানুষ পাহাড়ি বাঙালি সবাই আতঙ্ক উৎকণ্ঠায় কাটে তাদের দিন-রজনী। পাহাড়ে যেন এখনো বিভীষিকাময় পরিস্থিতি বিরাজমান।
পার্বত্যাঞ্চলের শহর অঞ্চলের মানুষ কিছুটা নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারলেও শহরের বাইরের মানুষের হাঁফ ছাড়ে সূর্য উঠার পর। কিন্তু সূর্যাস্তের পর যাওয়ার পর রাতের যেন শেষ হয় না। রাত যত গভীর হয় তত বাড়ে আতঙ্ক।
পাহাড়ে অনেকেই মনে করেন সন্তু লারমা গ্রুপ শান্তি চুক্তির পর রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা নিলেও পাহাড়ে শান্তি রক্ষার বদলে পর্দার আড়াল থেকে অশান্তি সৃষ্টিতে তৎপর। পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সরকার তৎপর হলেও দেশের কিছু ব্যক্তি ও কিছু বিদেশি এনজিও অর্থ খরচ করে অশান্তির আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছে।
রাতে চিৎকার শুনলেই অজানা আতঙ্কে আঁতকে উঠেন পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসকারী সাধারণ পাহাড়ি-বাঙালিরা। কেউ বুঝি প্রাণ হারালো পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের হাতে। আবারো বুঝি ধর্ষণের শিকার হলো কোনো নিরীহ নারী-শিশু।
চাঁদা না দেয়ায় হয়তো পুড়ে গেল কোনো পরিবারের কপাল। দিনের আলোয় কিছুটা সাহস জোগালেও সূর্য অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকারে মিলিয়ে যায় মনের সাহসটুকু। দেশের ৬১ জেলায় সাধারণ মানুষ তার ঘরে ঘুমালেও পাহাড়ে বসবাসকারীরা (বাঙালি ও নিরীহ পাহাড়িরা) স্বাভাবিকভাবে ঘুমাতে পারেন না। কেউ জানে না কাকে কখন কুপিয়ে-গুলি করে হত্যা করা হবে।
এ এক অরাজক পরিস্থিতি। সন্তু লারমার বাহিনীর সঙ্গে সরকারের শান্তি চুক্তি হলেও শান্তি নেই পার্বত্য তিন জেলার মানুষের মনে। দিন যতই যাচ্ছে ততই যেন অশান্ত হয়ে উঠছে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল। পর্যটনে বিপুল সম্ভাবনার পাহাড়ে গড়ে উঠছে অবৈধ অস্ত্রের ভান্ডার আর সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য। সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে অবাধে ঢুকছে এসব অস্ত্র।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেখেনি এমন অত্যাধুনিক অস্ত্রেরও মজুদ রয়েছে তাদের হাতে। সন্ত্রাসের মূল লক্ষ্য বাঙালি অধিবাসীরা হলেও ছাড় পাচ্ছেন না নিরীহ ক্ষুদ্র নৃ-তাত্তি¡ক গোষ্ঠী এবং প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের নেতারাও (উপজাতি)। সন্ত্রাসী এই কর্মকান্ডের মূল অভিযোগ জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), জেএসএস সংস্কার ও ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ), গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফের বিরুদ্ধে।
চলতি বছরের ৩ মে পার্বত্যাঞ্চল বড় ধাক্কা খেয়েছে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর উচ্চ শিক্ষিত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি সংস্কার গ্রুপের নেতা নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এডভোকেট শক্তিমান চাকমা হত্যাকান্ডের পর। শক্তিমান চাকমার রক্তের দাগ শুকাতে না শুকাতেই ৪ মে পাহাড়রে ৪ নম্বর আঞ্চলিক দল গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ নেতা জ্যোতিময় চাকমা বর্মাসহ ৫ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় আবারো প্রমাণ করে পাহাড়ের রক্তের হলি খেলায় মেতে উঠার কথা। এই দুটি হত্যাকান্ডেই নাড়া দিয়েছে পুরো পার্বত্যাঞ্চলের অভিজ্ঞ মহলকে। দিনদুপুরে নিজ কার্যালয়ে চেয়ারম্যানকে হত্যা, চলন্ত গাড়িতে গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ নেতা বর্মা হত্যাকান্ডের ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত। এসব হত্যাকান্ড থেকে বোঝা যায় পার্বত্য আঞ্চলিক দলগুলোর মাঝে অভিজ্ঞ ক্লিলিং স্কোয়ার্ড তৈরি হয়েছে।
এরপর গত ৩ মাসে পার্বত্য রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলায় প্রায় ১০টি হত্যাকান্ড এবং প্রায় শতাধিক অপহৃত হয়েছে। এ নিয়ে রাঙ্গামাটি ছিল উত্তাল। অবরোধ, হামলা পাল্টা হামলার প্রতিনিয়ত আতঙ্কে ছিল পাহাড়ের জনপদ।
পাহাড়ের অবৈধ অস্ত্রধারীরা প্রতিনিয়ত পাহাড়কে অশান্ত করে তুলেছে। একটি মহলের ইন্ধনে পাহাড়কে অশান্ত করে তুলতে প্রতিনিয়ত দ্বন্দ্ব সংঘাত লেগেই আছে। আঞ্চলিক দলগুলোর অনিয়ন্ত্রিত সংঘাতে বলি হচ্ছে পাহাড়ি বাঙালি। কেউ রেহাই পাচ্ছে না। ২০১৭ সালের ১ জুন লংগদু উপজেলায় নুরুল ইসলাম নয়ন হত্যাকান্ডের ঘটনায় আগুন জ্বলেছিল ২ শতাধিক সাধারণ নিরীহ উপজাতীয় পরিবারের ঘর।
নুরুল ইসলামের হত্যাকান্ডের পরের দিন লংগদু উপজেলার স্বার্থান্বেষী একটি বাঙালি গোষ্ঠী নিরীহ উপজাতীয় পরিবারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। জ্বালিয়ে দেয় প্রায় ২ শতাধিক বাড়িঘর। এ নিয়ে সরকারকে পোহাতে হয় অনেক যন্ত্রণা। এ ঘটনায় বিশ্বে বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুন্ন হয়।
এই অবস্থার উন্নতি করতে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কয়েকটি টিম রাঙ্গামাটির লংগদু সফর করে সরকার ঘোষণা দেয় ক্ষতিগ্রস্তদের বাড়িঘর নির্মাণের প্রতিশ্রুতি। প্রায় বছর গড়ানোর মাথায় এসে প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাড়িঘর নির্মাণ করে উপজাতীয় জনগোষ্ঠীকে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে আগামী কিছু দিনের মধ্যে।
পার্বত্যাঞ্চলের অশান্তির আরেক নাম হচ্ছে ভ‚মি কমিশন। এই কমিশনের কার্যক্রমে কোনো রোডম্যাপ না থাকায় দিন দিন অশান্তি আরো দানা বাঁধছে। সরকার ভ‚মি কমিশনকে কার্যকর করার জন্য বেশকিছু উদ্যোগ গ্রহণ করলেও তা এখনো কার্যকর হয়নি। ভ‚মি কমিশনের সদস্যদের মধ্যে বারবার বৈঠক হলেও কাজ এগিয়ে না যাওয়ায় হতাশা বাড়ছে।
কমিশনের বৈঠকের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানান, সম্প্রতি বান্দরবান বৈঠকে ভ‚মি কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান সন্তু লারমাকে কাজের অগ্রগতি বাড়াতে শুধু ৫০টি মামলা নিয়ে কাজ শুরু করার প্রস্তাব দান করলেও কোনো ধরনের সদুত্তর না আসায় সেই প্রস্তাব ভেস্তে গেছে বলে মনে করছেন অনেকেই। কমিশনের অন্যান্য সদস্যরা বলেন, শুধু নিজেদের কথা চিন্তা না করে সমস্যা সমাধানে কাজ শুরু করলেই সকলে উপকৃত হতো। কিন্তু উভয় পক্ষের সদিচ্ছা না থাকায় এই কাজও পিছিয়ে যাচ্ছে।
এই পরিস্থিতির পার্বত্যাঞ্চলের শান্তি ফিরিয়ে আনতে পাহাড়ের সব গোষ্ঠীকেই আন্তরিক হতে হবে। সরকারের স্বদিচ্ছার সঙ্গে আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর নমনীয়তা এবং আন্তরিকতা ঘাটতি থাকলে পাহাড়ের শান্তি নামক সোনার হরিণ ধরা খুবই কষ্ট সাধ্য হবে বলে মনে করছেন অভিজ্ঞ মহল।