×

জাতীয়

সড়কে শৃঙ্খলা ফেরেনি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১১:১৮ এএম

সড়কে শৃঙ্খলা ফেরেনি
সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কোনো নির্দেশনাই কাজে আসছে না। জনসাধারণ ও পরিবহন মালিক-শ্রমিক কেউই তোয়াক্কা করছে না বেঁধে দেয়া নির্দেশনার। মঙ্গলবার ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের কঠোর নির্দেশনার পরও গতকাল বুধবার ঢাকার রাস্তায় লেগুনা ও ট্যাম্পো চলাচল করেছে পুরনো স্টাইলে। গুপরিবহনকে যেভাবে চলার কথা বলা হয়েছে তার কিছুই মানা হয়নি। যত্রতত্র যাত্রী উঠানামা বন্ধ, চালকদের লাইসেন্স প্রদর্শন, দরজা লাগানোর ক্ষেত্রে দেয়া নির্দেশনা আমলেই নেয়নি গণপরিবহন শ্রমিকরা। বাদুরঝোলা হয়ে যাত্রী পরিবহনও বন্ধ হয়নি। সড়কে গতকালের চিত্র ছিল পুরনো সব দিনের মতোই। এমনকি নিষেধাজ্ঞা সত্তে¡ও ফিলিং স্টেশনগুলোতে হেলমেট ছাড়া আরোহী ও চালকের মোটরসাইকেলে জ্বালানি তেল দেয়া হয়েছে। তবে ট্রাফিক পুলিশ ও স্কাউটদের পীড়াপীড়িতে অনেকস্থানেই ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার কিছুটা হলেও বেড়েছে। অবশ্য কাগজপত্র তল্লাশির কারণে রাস্তায় গণপরিবহনের সংখ্যা কম থাকায় জন সাধারণকে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে। এদিকে হঠাৎ করেই লেগুনা ও ট্যাম্পো বন্ধের ঘোষণায় বিপাকে পড়েছেন এর মালিকরা। তারা বলছেন, কেউ জমি বিক্রি করে, আবার কেউ ব্যাংক ঋণ নিয়ে রাস্তায় লেগুনা নামিয়েছেন। হঠাৎ করে লেগুনা বন্ধ করে দেয়া হলে ব্যাংকের কিস্তি পরিশোধ করব কিভাবে? লেগুনা বন্ধের ঘোষণায় যাত্রীদের মধ্যেও দেখা গেছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। যাত্রীরা বলছেন, বিকল্প ব্যবস্থা না করে হঠাৎ লেগুনা বন্ধ করে দেয়া হলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়বে। গতকাল সকালে সরেজমিন খিলগাঁও লেগুনাস্ট্যান্ডে গিয়ে প্রতিদিনের মতোই মুগদা-মালিবাগ রুটের লেগুনা চলাচল করতে দেখা যায়। লেগুনা চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই রুটে প্রতিদিন ৭০ থেকে ৮০টি লেগুনা চলাচল করে। তবে বাসাবো-গুলিস্তান রুটের লেগুনা গতকাল কম চলতে দেখা গেছে। এই রুটেও প্রায় শতাধিক লেগুনা রয়েছে। মুগদা-মালিবাগ রুটের ঢাকা মেট্রো-ছ ১১-৩১৯৮ নম্বর লেগুনার চালক বাবু ভোরের কাগজকে বলেন, ‘ঢাকার সড়কে লেগুনা চলবে না’ আমরা এমন কোনো নির্দেশনা পাইনি। তবে টিভির খবরে শুনেছি। কিন্তু কবে থেকে এটা কার্যকর করা হবে তা জানি না। ঢাকা মেট্রো-ছ ১১-৩৯৪৪ নম্বর লেগুনার চালক রাজুও একই কথা বলেন। খিলগাঁও স্ট্যান্ডের লাইনম্যান ফরিদুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, লেগুনা চলবে না, আমরা এমন কোনো নির্দেশনা পাইনি। ডিএমপি কমিশনারের বক্তব্য শুনেছি। তবে হঠাৎ করে লেগুনা বন্ধ করে দেয়া ঠিক হবে না। কারণ, অনেকেই জমি বিক্রি করে কিংবা ব্যাংক ঋণ নিয়ে লাখ লাখ টাকায় লেগুনা রাস্তায় নামিয়েছেন। হঠাৎ লেগুনা বন্ধ করা হলে মালিকদের পথে বসতে হবে। ব্যাংকের লোন পরিশোধ করবে কিভাবে? আমার নিজেরও এই রুটে দুটি লেগুনা আছে। লেগুনা বন্ধ করে দেয়া হলে না খেয়ে মরতে হবে। এ ছাড়া সাধারণ যাত্রীরাও ভোগান্তিতে পড়বে বলে মনে করেন তিনি। মালিবাগ থেকে লেগুনায় করে খিলগাঁও আসা যাত্রী মাহফুজ আনাম ও মো. মামুন জানান, বিকল্প ব্যবস্থা না করে লেগুনা বন্ধ করা ঠিক হবে। এতে আমরা সাধারণ যাত্রীরা ভোগান্তিতে পড়ব। ৪০ টাকার রিকশা ভাড়ার পথ আমরা লেগুনায় ৮ টাকায় যেতে পারছি। লেগুনায় তো কোনো সমস্যা দেখছি না, বরং ঢাকা শহরের যানজটের জন্য রিকশা অন্যতম কারণ। যাত্রী রুবেল, আফসানা, আলমগীরও একই কথা বলেন। এ বিষয়ে ট্রাফিক পুলিশের এএসআই আলমগীরের কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। এদিকে রাজধানীর অন্যান্য এলাকার মতো গতকালও গুলিস্তানের গোলাপশাহ মাজার ও ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ড এলাকায় লেগুনা চলাচল করেছে। লেগুনাগুলোর বেশিরভাগ চালকই জানেন না ডিএমপির লেগুনা বন্ধের ঘোষণা। যারা জানেন তারা এ উদ্যোগকে অসম্ভব বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন। আবার অনেকে বেকার হওয়ার আশঙ্কা করেছেন। তবে ডিএমপির এ সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট নন যাত্রীরা। তাদের দাবি, লেগুনা বন্ধ করে চলাচলের জন্য বাসের ব্যবস্থা করে দিলে ভাড়ার টাকা সাশ্রয় হবে। ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ড থেকে সদরঘাট পর্যন্ত ‘এমপি’ নামে ১০০ লেগুনা চলাচল করে। ব্যতিক্রম ছিল না গতকালও। নীরব দর্শকের ভ‚মিকায় থাকা ট্রাফিক পুলিশের সামনেই চলতে দেখা যায় লেগুনাগুলোকে। ফুলবাড়িয়া স্টার কাবারের সামনে ‘এমপি’ লেগুনা স্ট্যান্ডের সামনে দেখা যায় লেগুনার জটলা। লেগুনা চালক মো. হাসান জানান, পুলিশ কি ঘোষণা দিছে জানি না। আমরা প্রতিদিন ৬০০ টাকা জিপি (চাঁদা) দিয়ে গাড়ি চালাই। আজও চালাচ্ছি। সরকার যদি লেগুনা বন্ধ করে দেয় তাহলে বাস চালাব। জিপি কাদের দেন জানতে চাইলে বলেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও পুলিশ সার্জেন্টের নামে এ টাকা নেয়া হয়। ফুলবাড়িয়া মোড়ে ট্রাফিক পুলিশের এসআই ওয়াহিদ বলেন, আমরা লেগুনা চলতে দিচ্ছি না। তখনই তার সামনে দিয়ে ৩টি লেগুনা ইউটার্ন নিলে জানতে চাওয়া হয়, এগুলো কি? তখন তিনি বলেন, সকালেও ১০টি লেগুনা রেকার দিয়েছি। পর্যায়ক্রমে ঠিক করে ফেলব। গুলিস্তান মাজার এলাকার লেগুনার লাইনম্যান মো. গজনবী বলেন, এই স্ট্যান্ড থেকে প্রায় ৪০০ লেগুনা মোট ১৩টি রাস্তায় চলাচল করে। আমরা গোলাপশাহ পরিবহন হিউম্যান হলার মালিক সমিতির আওতায় কাজ করি। লেগুনা বন্ধের বেপারে তারা বা পুলিশ কিছু বলেনি। মো. সুমন নামে গুলিস্তান থেকে সেকশন রুটে চলাচলকারী এক লেগুনা চালক বলেন, আগে আমাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হোক। পাশাপাশি লেগুনা বন্ধ হলে শত শত মালিক ঋণের চাপে সমুদ্রে পড়বে। তাদেরও উত্তরণের পথ দেখানো হোক। গুলিস্তানেও ট্রাফিক পুলিশ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একুশে হলের নামে ৫০০ টাকা জিপি দিতে হয়। ইসলামবাগগামী লেগুনার চালক রাশেদ আলম বলেন, পুরান ঢাকার সরু গলি দিয়ে আমরা লেগুনা চালাই। ওই সড়কে বাস চলতে পারে না। লেগুনা বন্ধ হলে যাত্রীরাই বিপাকে পড়বে। এদিকে লেগুনা বন্ধের ঘোষণায় বিচলিত নয় যাত্রীরা। মো. শাহ আলম নামে এক যাত্রী জানান, খারাপ অভ্যাস পরিবর্তন করাই ভালো। লেগুনার পরিবর্তে সরকার বাসের ব্যবস্থা করে দিলে মানুষের ভাড়ার টাকা অনেক সাশ্রয় হবে। এদিকে মোহাম্মদপুর থেকে বাড্ডা, ফার্মগেট ও শিয়া মসজিদ থেকে বাড্ডা রুটে লেগুনা কম চলাচল করতে দেখা যায়। গাবতলী ও মহাখালীর চিত্রও ছিল অভিন্ন। এতে অনেক যাত্রী বিপাকে পড়েছেন, তবে সড়কের শৃঙ্খলা ফেরাতে পুলিশের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন যাত্রীরা। বাংলাদেশ হালকা যানবাহন চালক শ্রমিক ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি বোরহান হালদার জসিম বলেন, মঙ্গলবার ডিএমপি কমিশনারের বক্তব্যের পর রুট পারমিট ও অধিকাংশ চালকদের লাইসেন্স না থাকায় আজকের জন্য আমরা লেগুনা বন্ধ রেখেছি। তিনি বলেন, আমরা মানুষের সেবা করি। আমরা চাই, মানবিক দিক বিবেচনা করে আমাদের রুট পারমিট দেয়া হোক। সব পাম্পে ব্যানার, হেলমেটেই মিলছে তেল : ঢাকায় পুলিশের নির্দেশনার পরও গতকাল অনেক পেট্রোল পাম্পে হেলমেট ছাড়া বাইকচালকদের তেল দেয়ার দৃশ্য দেখা গেছে। মিরপুর ১০ নম্বরে অবস্থিত পেট্রোল পাম্প ঘুরে দেখা যায়, পাম্পের পেট্রোল ও অকটেন সরবরাহের মেশিনে টাঙানো কাগজে লেখা আছে, হেলমেট ব্যতিত মোটরসাইকেলে জ্বালানি দেয়া হবে না। তেজগাঁওয়ের তিব্বত মোড়ের সততা পাম্প, বাড্ডা লিংক রোডের সিটিজেন সিএনজি এন্ড ফিলিং স্টেশনে গিয়ে দেখা গেছে একই চিত্র। সেখানেও ব্যানার টাঙানো হয়েছে। সততা পাম্পের কাউন্টার ম্যানেজার শরিফুল ইসলাম বলেন, ট্রাফিক পুলিশের পক্ষ থেকে মঙ্গলবার বলা হয়েছে, হেলমেট ছাড়া তেল না দিতে। আমরা তেল ডেলিভারিম্যানদের বলে দিয়েছি, পুলিশের নজরদারি রয়েছে, তারা যেন কোনোভাবেই হেলমেটবিহীন কাউকে তেল সরবরাহ না করেন। যত্রতত্র যাত্রী উঠানামা : পুলিশের পক্ষ থেকে রাজধানীতে গণপরিবহনে যাত্রী উঠানামা করানোর জন্য ১২১টি বাসস্ট্যান্ড নির্ধারণ করে দিলেও এর তোয়াক্কা করেনি বাসচালকরা। বরাবরের মতোই তারা যেখানে সেখানে ইচ্ছেমতো বাস থামিয়ে যাত্রী তুলেছে এবং নামিয়ে দিয়েছে। প্রায় সব সড়কে দেখা গেছে এমন দৃশ্য। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাসচালক এ প্রসঙ্গে বলেন, অনেক যাত্রীই নির্ধারিত স্ট্যান্ডের পরিবর্তে নিজের সুবিধা মতো জায়গা থেকে গাড়িতে উঠতে চায়। না তুললে আমাদেরই লোকসান। তা ছাড়া, আমি একা এ নিয়ম মানলে তো হবে না, যাত্রী পাব না। সব বাসচালককে এ নিয়ম মানতে বাধ্য করতে হবে। আবার পছন্দ মতো জায়গায় নামিয়ে না দিলে কোনো কোনো যাত্রী রাগ করে। কেউ কেউ গায়েও হাত তুলে। আমাদের তো সবদিকেই সমস্যা। ফুটওভার ব্রিজে দীর্ঘ লাইন : এদিকে রাজধানীতে রাস্তা পারাপারে নিত্যদিনের যে চিত্র ছিল তা যেন মাত্র একদিনেই বদলে গেছে। ডিএমপি কমিশনারের ঘোষণার পর গতকাল ঢাকার বিভিন্ন ফুটওভার ব্রিজে ওঠার জন্য দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে। ফার্মগেট ও উত্তরায় মাসকট টাওয়ারের সামনে ফুটওভার ব্রিজে ওঠতে দেখা গেছে দীর্ঘ লাইন। পথযাত্রী কাউকেই সড়ক পার হতে দেয়া হচ্ছে না। একই চিত্র দেখা যায় শাহবাগ, বাংলামোটরসহ অন্যান্য ফুটওভার ব্রিজে। পথযাত্রীদের ফুটওভার ব্রিজের মাধ্যমে রাস্তা পারাপারে বাধ্য করা হচ্ছে। আর এ কাজে সহায়তা করছেন রোভার স্কাউটের সদস্যরা। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) উপ-পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া এন্ড পিআর) মাসুদুর রহমান বলেন, বেশ কিছু বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। প্রকৃত সফলতা আসতে সময় লাগবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App