×

জাতীয়

ফুটেজ মেলে আসামি মেলে না

Icon

ইমরান রহমান

প্রকাশ: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১১:৩৩ এএম

ফুটেজ মেলে আসামি মেলে না
২০১৬ সালের ২৪ জুলাই রাজধানীর উত্তরার দক্ষিণখানের উত্তর গাওয়াইরে বাসা ভাড়া নেয়ার কথা বলে গৃহকর্ত্রী শাহিদা বেগমকে (৫০) হত্যা করে স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে পালিয়ে যায় এক যুবক। এরপর ২১ আগস্ট দক্ষিণখানের তেঁতুলতলা রোডে গৃহকর্ত্রী সুমাইয়া বেগমকে (৫২) একই কায়দায় হত্যা করে ওই খুনি। ১০ দিন পর ৩১ আগস্ট দক্ষিণখানের মুন্সী মার্কেট এলাকায় জেবুন্নিছা চৌধুরীকে (৫৬) কুপিয়ে হত্যা করে পালিয়ে যায় সে। এর মাত্র ৭ দিন পর ৭ সেপ্টেম্বর ওই একই খুনি একইভাবে দক্ষিণখানের উত্তর গাওয়াইরে গৃহকর্ত্রী ওয়াহিদা আক্তারকে (৪৮) খুন করে এবং যথারীতি পালিয়ে যায়। ৪৫ দিনের মধ্যে প্রায় একই কায়দায় ৪ নারী খুন হওয়ার পর পুলিশ জানায়, প্রতিটি ঘটনা একই ধরনের। একজন ঠান্ডা মাথার সিরিয়াল কিলার বাড়ি ভাড়ার কথা বলে ওই ৪ নারীকে খুন করেছে। ঘাতককে গ্রেপ্তারের সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। পরে ওই যুবকের একটি ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। ওই ফুটেজ দেখে বোঝা যায়, যুবকের বয়স আনুমানিক ২৫-২৬ বছর। উচ্চতা প্রায় ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি। গায়ের রং ফরসা। মাথার চুল ছোট। ফরমাল পোশাক। কাঁধে ব্যাগ ঝোলানো। ফুটেজ দেখে ওই সিরিয়াল কিলারকে চিহ্নিত করা হলেও তাকে গ্রেপ্তার করতে ব্যর্থ হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এই ৪ নারী খুনের পর চলতি বছরের ৮ মার্চ দুপুরে রাজধানীর তেজগাঁও এলাকার নাখালপাড়ায় এক বাসায় ঢুকে বাড়ির মালিক আমেনা বেগমকে (৭০) খুন করা হয়। এ ঘটনাতেও এক যুবক বাসা ভাড়া নিতে এসে ওই বৃদ্ধাকে খুন করে। পরে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, পূর্বের ৪ নারী খুনের সঙ্গে এ ঘটনারও মিল রয়েছে। ওই সিরিয়াল কিলারই এ ঘটনা ঘটাতে পারে। কিন্তু একের পর এক কিলিংয়ের পর ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা ফুটেজে চিহ্নিত হয়েও এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে সেই সিরিয়াল কিলার। শুধু এই সিরিয়াল কিলারই নয়, এ ধরনের বিভিন্ন আলোচিত ঘটনায় সিসি ক্যামেরার ফুটেজ মিললেও আসামিরা রয়ে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। অনেক ক্ষেত্রে সিসি ক্যামেরায় অপরাধ সংঘটিত হওয়ার বিষয়টি ধরা পড়লেও ক্যামেরার দুর্বলতার কারণে অপরাধীদের চেহারা ঠিকমতো বোঝা যায় না। ফলে তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। এতে সিসি ক্যামেরা আছে জেনে শুনেও অপরাধ করতে দ্বিধা করছে না অপরাধীরা। এ অবস্থায় বিভিন্ন স্থানে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের কার্যকরিতা নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য মতে, গত ১৪ জুলাই গভীর রাতে মহাখালীর স্কুল রোডের জিপি-গ/৩৩/১ নম্বর ভবনে (কঙ্কাল বাড়ি) অবস্থিত কথিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘রেইনবো নিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে’র কার্যালয়ে কাজী রাশেদ নামে এক যুবলীগ নেতা খুন হয়। ঘটনার পরে উদ্ধারকৃত সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, ১৪ জুলাই রাতে ৩টা ৪ মিনিটে হাতে পলিথিনের ব্যাগ পেঁচিয়ে রাশেদের নিথর দেহ টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে ৪ যুবক। এ চার যুবক হলেন মহাখালী দক্ষিণপাড়ার ডিশ ব্যবসায়ী ফিরোজ, বনানী থানা যুবলীগের যুগ্ম আহবায়ক ইউসুফ সরদার সোহেল ওরফে সুন্দরী সোহেলের বডিগার্ড হাসু, সুন্দরী সোহেলের মিডিয়া নিয়ন্ত্রক দিপন ওরফে দিপু। চতুর্থ জন ফর্সা লম্বা গড়নের। তার পরিচয় উদ্ঘাটন হয়নি। এ হত্যাকান্ডের প্রধান সন্দেহভাজন সুন্দরী সোহেল। কিন্তু সোহেলসহ বাকি চারজনের কেউই এখনো গ্রেপ্তার হয়নি। গত ৪ আগস্ট সকালে তেজগাঁও বেগুনবাড়ী এলাকায় রুবেলের বাড়ির দোতলার একটি কক্ষের সাগরিকা তৃপ্তি (১২) নামে এক স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের পর হত্যা করে পালিয়ে যায় এক যুবক। তার পালিয়ে যাওয়ার সেই দৃশ্য ধরা পড়ে হাতিরঝিল সংলগ্ন একটি বাড়ির সিসি ক্যামেরার ফুটেজে। তাতে দেখা গেছে, গোলাপি রঙের টিশার্ট আর থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট পরিহিত আলম দাশ নামে ওই ঘাতক যুবক সকাল ৯টা ১৩ মিনিটে তৃপ্তিদের বাড়ির গলি থেকে বেরিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে হাতিরঝিলের দিপিকার মোড়ের দিকে। কিন্তু ওই যুবককে গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকালে গত ৪ আগস্ট মিরপুরে সাধারণ শিক্ষার্থী ও ৫ আগস্ট ঝিগাতলায় সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। এসব ঘটনায় ফুটেজ উদ্ধার হলেও আসামিরা চিহ্নিত হয়নি। সর্বশেষ গত ২১ আগস্ট সন্ধ্যায় সাভারের গেন্ডা বাসস্ট্যান্ডে পুলিশ স্থাপিত সিসি ক্যামেরার নিচেই খুন হন মারুফ খান নামে এক যুবক। অথচ দুই সপ্তাহেও মূল ঘাতকদের কাউকেই আটক করতে পারেনি পুলিশ। এর আগে ২০১৫ সালের বাংলা নববর্ষের দিন বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে আলোচিত যৌন হয়রানির ঘটনায় ফুটেজ উদ্ধার করা হলেও কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। একইভাবে ২০১৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর গুলশানে ইতালির নাগরিক তাবেলা সিজার হত্যাকান্ড, একই বছর ২৬ ফেব্রæয়ারি লেখক ড. অভিজিৎ রায় হত্যাকান্ড, ওই বছরের ৩১ অক্টোবর শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে প্রকাশক দীপন হত্যাকান্ড ও ২০১৬ সালের ৫ জুন চট্টগ্রামে পুলিশ সুপারের (এসপি) স্ত্রী হত্যাকান্ডসহ আরো কয়েকটি হত্যাকান্ডে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে। পরে এসব ঘটনায় জড়িত আসামিরা গ্রেপ্তার হলেও সিসি ক্যামেরা ফুটেজ অস্পষ্ট হওয়ায় সাক্ষ্য প্রমাণে তা তেমন কোনো কাজে আসেনি বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, সিসি ক্যামেরার ব্যবহার আমাদের দেশে কালচার হিসেবে এখনো গড়ে ওঠেনি। আবার সিসি ক্যামেরা ব্যবহারের জন্য যে ম্যানেজমেন্ট ও জনবল দরকার সেটিও আমাদের নেই। ফলে সিসি ক্যামেরা থাকা সত্ত্বেও অপরাধীরা বিভিন্ন ফাঁক গলে বেড়িয়ে যাচ্ছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে যারা ব্যক্তিগত উদ্যোগে সিসি ক্যামেরা ব্যবহার করেন তাদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সম্পর্ক নেই। ফলে সিসি ক্যামেরা বেশিরভাগ সময় বন্ধ থাকে। অন্যদিকে, সিসি ক্যামেরায় ভিডিও রেকর্ড হলেও তা অস্পষ্ট থাকায় অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্যও আসামিকে গ্রেপ্তার করে না। তবে, সিসি ক্যামেরা ব্যবহারে সমন্বয় গড়ে তুলতে পারলে অপরাধ অনেকাংশে কমে যাবে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) শেখ নাজমুল আলম ভোরের কাগজকে বলেন, সিসি ক্যামেরার ফুটেজ উদ্ধার হলেও আসামি গ্রেপ্তার হয় না এটা ঠিক নয়। অনেক সময় ফুটেজ অস্পষ্ট থাকার কারণে তদন্তে একটু দেরি হতে পারে। তবে ইতোমধ্যেই অনেক চাঞ্চল্যকর ঘটনার রহস্য উদঘাটন হয়েছে সিসি ক্যামেরার ফুটেজের মাধ্যমে। রাজধানীর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আমাদের কমিশনার স্যার (ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া) প্রতিটি ফ্ল্যাটে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের নিদের্শ দিয়েছেন। ডিএমপির প্রতি থানার ওসি বিষয়টি নজরদারি করছে। এক প্রশ্নের জবাবে ডিএমপির এ কর্মকর্তা বলেন, অনেক সময় সিসি ক্যামেরা নিম্নমানের হয়। এ ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক ক্যামেরাগুলো বেশি নিম্নমানের দেখা গেছে। তবে, ব্যক্তিগত উদ্যোগে যারা সিসি ক্যামেরা স্থাপন করেছেন সেগুলোর ফুটেজ স্পষ্ট। আমরা আশা করি, প্রতিটি এলাকায় সিসি ক্যামেরা স্থাপিত হলে অপরাধ আরো কমে যাবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App