শিক্ষার্থী ১, শিক্ষক ৩ জন!
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০১৮, ০১:০৮ পিএম
প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ইবতেদায়ি শাখায় মাত্র একজন শিক্ষার্থী। তার পাঠদানের জন্য সরকারি বেতনভুক্ত শিক্ষক রয়েছেন ৩ জন। লালমনিরহাট সদর উপজেলার গোকুন্ডা ইউনিয়নের মোস্তফি ভুড়িধোয়া দাখিল মাদ্রাসার চিত্র এটি।
শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা জানান, অবহেলিত এ গ্রামের কোমলমতি ছেলেমেয়েদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়াতে স্থানীয়দের উদ্যোগে ১৯৯০ সালে মোস্তফি ভুড়িধোয়া দাখিল মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথমদিকে প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদানের অনুমতি পেলেও পরে দাখিল পর্যন্ত অনুমোদন দেয় মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড।
এরপর ২০০০ সালের ২৪ এপ্রিল ইবতেদায়ি শাখায় তিন শিক্ষক ও দাখিল শাখায় ১৪ শিক্ষক কর্মচারী নিয়ে এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করে মাদ্রাসাটি। সেই থেকে প্রথম থেকে দাখিল পর্যন্ত ১০টি শ্রেণির পাঠদান চলে নিভৃত পল্লী গ্রামের এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
মাদ্রাসাটি এমপিওভুক্ত হওয়ার পর শিক্ষকরা নিয়মিত বেতনভুক্ত হন। আর এরপর থেকে শুরু হয় পাঠদানে অবহেলা। ফলে শিক্ষার্থীরাও মাদ্রাসা ছেড়ে চলে যেতে শুরু করে। সরকারি বেতনভুক্ত কর্মচারী হিসেবে সরকারের খাতায় নাম অন্তর্ভুক্ত হলে তা আর কোনোভাবেই মুছে যায় না। এ ধারণায় শিক্ষকরাও ইচ্ছামতো মাদ্রাসায় আসেন আর স্বাক্ষর করে চলে যান।
এ ছাড়া ভুলেও সরকারি দপ্তরের কেউ খোঁজ নেন না সরকারি বেতনভুক্ত এ প্রতিষ্ঠানটির। ফলে শিক্ষার পরিবেশ হারিয়ে ফেলেছে মাদ্রাসাটি। এ জন্য মাদ্রাসা ছেড়ে চলে গেছে শিক্ষার্থীরা।
স¤প্রতি প্রতিষ্ঠানটি সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, কাগজ-কলমে ১০টি শ্রেণিতে ২২৮ শিক্ষার্থী থাকলেও বাস্তবে ২ জনকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি। প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত কোনো শিক্ষার্থী বা শ্রেণিকক্ষ নেই। পুরো ইবতেদায়ি শাখা মিলে পঞ্চম শ্রেণিতে রয়েছে একমাত্র শিক্ষার্থী নাঈম মিয়া। পড়াশোনার কোনো পরিবেশ নেই। ওই কক্ষে নাঈমকে পাঠদান করছেন জুনিয়র মৌলভী আক্কাস আলী। শিক্ষক আক্কাস আলী বলেন, প্রতিদিন পাঁচ/সাতজন শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকে। তবে অজ্ঞাত কারণে আজ সব শিক্ষার্থীরা অনুপস্থিত।
৬ষ্ঠ থেকে ১০ম পর্যন্ত প্রতিটি ক্লাসে পাঁচ থেকে আটজন করে শিক্ষার্থী বসে রয়েছে শিক্ষকের আগমনের অপেক্ষায়। প্রতিষ্ঠানটির জন্মলগ্ন থেকে কোনোদিন সরকারি দপ্তরের কেউ পরিদর্শন করেনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অষ্টম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী জানায়, কয়েক মাস পরই জেডিসি পরীক্ষা অথচ তাদের ইংরেজি বিষয়ে দুই অধ্যায়ও পড়ানো হয়নি।
সংবাদকর্মীরা এসেছেন শুনে শরীর চর্চার শিক্ষক নুর ইসলাম মিয়া এসেছেন ইংরেজি ক্লাসে। তাদের কোনো ক্লাস রুটিন নেই। যেদিন যখন ইচ্ছে শিক্ষকরা ক্লাসে আসেন। প্রতিদিন দুপুরেই মাদ্রাসা ছুটি হয়ে যায়। প্রতিবাদ করলে বার্ষিক পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়।
মাদ্রাসার অফিস সূত্রে জানা গেছে, ১০টি শ্রেণিতে মোট শিক্ষার্থী ২২৮। শিক্ষক কর্মচারী মিলে ১৭ জনের বেতন বাবদ প্রতি মাসে সরকারি বরাদ্দ দুই লাখ ৮৫ হাজার ২২২ টাকা। গত দাখিল পরীক্ষায় ২৮ জন অংশ নিলেও পাস করেছে সাতজন। যার মধ্যে বিগত বছরের দুইজন রয়েছে।
জেডিসি পরীক্ষায় ৩৮ শিক্ষার্থীর মধ্যে বিগত বছরের তিনজনসহ পাস করে মাত্র ১৬ জন। মাত্র সাত/আটজন শিক্ষার্থীকে পাস করাতে এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন বাবদ সরকারি খরচ বছরে ৩৪ লাখ টাকার বেশি।
পাশের গ্রামের বাসিন্দা আজিজার রহমান বলেন, শিক্ষকরা ক্লাস না করায় ছেলে মেয়েরা মাদ্রাসায় গিয়ে গল্পগুজব করে বাড়ি ফিরে যায়। শিক্ষকরা একদিন এসে ছয়দিনের স্বাক্ষর করেন হাজিরা খাতায়। লেখাপড়ার পরিবেশ না থাকায় তারা তাদের ছেলেমেয়েকে অন্যত্র পাঠাচ্ছেন। এ কারণে সরকারি উচ্চ মহলের সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেন তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই এলাকার দুইজন স্কুল শিক্ষক জানান, পাঠদান না করায় মাদ্রাসাটির ইবতেদায়ি শাখায় কোনো শিক্ষার্থী নেই। উচ্চ মহলের তদন্ত এলে পাশেই ভুড়িধোয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ডেকে নিয়ে দেখানো হয়। ইবতেদায়ি শাখাটি বন্ধ করে দেয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন তারা।
মোস্তফি ভুড়িধোয়া দাখিল মাদ্রাসার সুপার আবুল বাশার নাঈমী জানান, প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ক’দিন ধরে মাদ্রাসায় আসছে না। তাই পাঠদান হচ্ছে না। শিক্ষার্থীরা না এলে শিক্ষকদের কি করার আছে? তবে ইবতেদায়ি শাখার শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষ দেখতে চাইলে তিনি দেখাতে পারেননি।