×

জাতীয়

বাঙালির শোকাবহ দিন আজ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০১৮, ১০:৫৬ এএম

বাঙালির শোকাবহ দিন আজ
“চিৎকার, ক্রন্দন আর শশব্যস্ত আহবানের মাঝে/উল্লাস করছে কিছু অন্ধ/ওরা বলে, ‘এখন ভোর’, কিন্তু জীবনপানে তাকিয়ে/আমি দেখি রাত্রি, ঘোর অমানিশা/বিদ্যুৎ চমকানো আর বজ্রপাতে মনে হয় দূরে বৃষ্টি হচ্ছে/কিন্তু বাতাসে বৃষ্টির নাম-গন্ধ নেই/রক্তের ধারা বইছে প্রবল/এখানে এখনো ক্রুদ্ধ রাত (আকাশ প্ল্যানেট, মীর গুল খান নাসির)।” এ এক ভয়ঙ্কর বীভৎসতা! পুরো বাড়িটি যেন রক্তগঙ্গা। রক্ত, মগজ ও হাড়ের গুঁড়ো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে বাড়িটির প্রতিটি তলার দেয়াল, জানালার কাচ, মেঝে ও ছাদে। গুলির আঘাতে দেয়ালগুলোও ঝাঁঝরা। চারপাশে রক্তের সাগরের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ঘরের জিনিসপত্র। প্রথম তলার সিঁড়ির মাঝখানে নিথর পড়ে আছেন ঘাতকের বুলেটে ঝাঁঝরা হওয়া চেক লুঙ্গি ও সাদা পাঞ্জাবি পরা স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু, বুক যার বাংলাদেশের হৃদয়। নিথর দেহের পাশেই পড়ে রয়েছে ভাঙা চশমা ও অতিপ্রিয় তামাকের পাইপ। অভ্যর্থনা কক্ষে শেখ কামাল, টেলিফোন অপারেটর, মূল বেডরুমের সামনে বেগম মুজিব, বেডরুমে সুলতানা কামাল, শেখ জামাল, রোজী জামাল, নিচতলার সিঁড়িসংলগ্ন বাথরুমে শেখ নাসের এবং মূল বেডরুমে দুই ভাবির ঠিক মাঝখানে বুলেটে ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত ছোট্ট শিশু শেখ রাসেল যে মায়ের কাছে যাবে বলে বায়না ধরেছিল। স্বাধীনতার মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধুর বাসভবনসহ তিনটি বাড়িতে সংঘটিত খুনিদের নারকীয় পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের এমন ভয়াল বীভৎসতার হৃদয়স্পর্শী বর্ণনা দিয়েছিলেন সেনাবাহিনীর তৎকালীন মেজর আলাউদ্দিন আহমেদ পিএসসি। রক্তাক্ত ৩২ নম্বরের সেই রক্তগঙ্গা প্লাবিত করেছে ৫৬ হাজার বর্গমাইল। কবি রবীন্দ্র গোপের ‘কাঁদো বাংলার মানুষ কাঁদো’ কবিতার মতোই ৪৩ বছর ধরে পিতৃশোকে কাঁদছে জাতি। হৃদয়ে বাজছে, ‘কাঁদো বাংলার মানুষ কাঁদো/যদি বাঙালি হও নিঃশব্দে কাছে এসো, আরো কাছে/... এখানেই শুয়ে আছেন অনন্ত আলোয় নক্ষত্রলোকে/জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান/ মৌমাছির গুঞ্জনের পাখির কাকলিতে করুণ সুর বাজে/গভীর অরণ্যে পুষ্পের সুগন্ধে/... অনেক রক্তের মূল্যে পাওয়া এ স্বাধীনতা/এখানে ঘুমিয়ে আছে, এইখানে দাঁড়াও শ্রদ্ধায়...।’ রক্তের অক্ষরে লেখা ১৫ আগস্ট আজ। জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কিত দিন। এই কালো দিনটিতেই জাতি হারিয়েছে তার গর্ব, আবহমান বাংলা ও বাঙালির আরাধ্য পুরুষ, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। রক্তঝরা এই দিনটিতে ঘৃণ্যতম একদল ঘাতকের পৈশাচিকতার বলি হয়েছিলেন বিশ্বের শোষিত মানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেদিন শ্রাবণের বৃষ্টি নয়, আকাশের চোখে ছিল রক্তাশ্রæ। মহাদেব সাহা তার ‘সেই দিনটি কেমন ছিলো’ কবিতায় লিখেছেন : ‘সেদিন কেমন ছিলো- ১৫ আগস্টের সেই ভোর/সেই রাত্রির বুকচেরা আমাদের প্রথম সকাল/সেদিন কিছুই ঠিক এমন ছিলো না/সেই প্রত্যুষের সূর্যোদয় গিয়েছিলো/সহস্র যুগের কালো অন্ধকারে ঢেকে/কোটি কোটি চন্দ্রভুক অমাবস্যা তাকে গ্রাস করেছিলো/রাত্রির চেয়েও অন্ধকার ছিলো সেই অভিশপ্ত দিন।’ হতবিহ্বল জাতির চারদিকে ছিল ঘাতকের উদ্ধত সঙ্গিন। মুছে দিতে চেয়েছিল রক্তের চিহ্নসহ জনকের লাশ। ভয়ার্ত বাংলায় ছিল ঘরে ঘরে চাপা দীর্ঘশ্বাস। সেই শোক অনির্বাণ এখনো বাংলায়। নদীর স্রোতের মতো চির বহমান কাল থেকে কালান্তরে জ্বলবে এ শোকের আগুন। আর বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদ বিচারের হাত থেকে খুনিদের রক্ষা করতে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করেন। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে ইনডেমনিটিকে আইন হিসেবে অনুমোদন করেন। সময়ের পরিক্রমায় পিতা হারানোর বেদনায় ব্যথাতুর বাঙালির কান্নার দিন আজ। অসংখ্য কবির কবিতা, শিল্পীর আগুনঝরা গীত, সাহিত্যিকের ক্ষুরধার লেখনী আর স্বাধীনতাপ্রিয় কোটি কোটি বাঙালির হৃদয়ে ঠাঁই পাওয়া সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক শেখ মুজিবুরকে শ্রদ্ধায় স্মরণ করার দিন। মর্মস্পর্শী এই দিনটি আজ জাতীয় শোক দিবস। অভিশপ্ত এই দিনটিতে বাঙালি জাতির ললাটে যে কলঙ্কতিলক পরিয়ে দেয়া হয়েছিল, ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি দীর্ঘ ৩৪ বছরেরও বেশি সময় পর সেই কলঙ্ক থেকে জাতির দায়মুক্তি ঘটেছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার চূড়ান্ত বিচারের রায় অনুযায়ী ওই দিন মধ্যরাতের পর ৫ খুনির ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে জাতির জনক হত্যা, ষড়যন্ত্র এবং অবৈধ ক্ষমতা দখলের ঘৃণ্য ও তমসাচ্ছন্ন অধ্যায়ের অবসান ঘটেছে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বাঙালির বিজয়ের অভিযাত্রাও আরেক ধাপ এগিয়েছে। ‘যতদিন রবে পদ্মা, মেঘনা, গৌরী, যমুনা বহমান/ ততদিন তোমার কীর্তি রবে শেখ মুজিবুর রহমান’- অমর এই কবিতার মতোই অনন্তকাল বাঙালি জীবনে, ইতিহাস-ঐতিহ্যে আর বিশ্বের শোষিত প্রাণের লড়াই সংগ্রামে চিরভাস্বর হয়ে আলোর পথ দেখাবেন টুঙ্গিপাড়ার রাখাল রাজা খোকা। যে রাতে খুলে গিয়েছিল নরকের দরজা : ‘সেই রাতে আকাশে একটিও নক্ষত্র ছিল না, সেই প্রাতে সূর্যালোক বন্দি ছিল কৃষ্ণ গহ্বরে... সেই রাতে ঈশ্বর তাই দেখতে পাননি, পৃথিবীতে কী ঘটেছিল!’ ১৫ আগস্ট চ্যান্সেলর হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে যাওয়ার কথা ছিল বঙ্গবন্ধুর। ১৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধু রাত সাড়ে আটটার দিকে গণভবন থেকে বাড়ি ফেরেন। ওই রাতে কাওরান বাজারে একটি ট্যাংক, পিজি হাসপাতালের সামনে আরেকটি ট্যাংক, মতিঝিলের কাছে আরো একটি ট্যাংক দেখতে পান রাজধানীবাসী। এক কিলোমিটারের ব্যবধানে ৩টি ট্যাংক, আবার ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের সামনে আরেকটি ট্যাংক দেখেও কারো মনে কোনো প্রশ্ন আসেনি। কৃষ্ণপক্ষের ওই অন্ধকার রাতে খন্দকার মোশতাকের ৫৪ নং আগামাসি লেনের বাসায় মেজর রশিদ এবং তাহেরউদ্দিন ঠাকুরের একান্ত বৈঠক হয়। পরদিন বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবর্ধনা জানানো হবে বলে ক্যাম্পাসে বিভিন্ন কাজ করে সেদিন মধ্যরাতে বাড়ি ফেরেন মুজিবপুত্র কামাল। ১৫ আগস্ট কালরাতে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়িতে প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে বেরিয়ে আসে বর্বরোচিত ঘটনার নৃশংস চিত্র। শিশুপুত্র রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব ঘুমাচ্ছিলেন দোতলায়। শেখ কামাল ও তার স্ত্রী সুলতানা কামাল তিনতলায়, শেখ জামাল ও রোজী জামাল এবং বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের ঘুমিয়েছিলেন দোতলায়। ঘুমাচ্ছিল বাংলাদেশ। শুধু জেগেছিল চক্রান্তকারীরা। ঘাতক এজিদ, সীমার আর দুর্যোধনের অট্টহাসিতে বিদীর্ণ হয় রাত্রির নিস্তব্ধতা। পৈশাচিক উল্লাসে আবারো খণ্ড-বিখণ্ডিত হয় রক্তে কেনা বাংলাদেশ। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী, অপারেশন ১৫ আগস্টের নেতৃত্বে ছিল কর্নেল ফারুক। তারই পরিকল্পনায় ৭৫ থেকে ১৫০ জন সৈন্যের বড় বড় তিনটি দল সাজানো হয়। তিনটি দলের প্রধান টার্গেট শেখ মুজিব, আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও শেখ মণির বাড়ি। শেখ মুজিবের বাড়ি আক্রমণের জন্য প্রথমে দায়িত্ব দেয়া হয় বহিষ্কৃৃত সেনা কর্মকর্তা মেজর ডালিমকে। রাষ্ট্রপতি পরিবারের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্কের কারণে হয়ত বা ডালিম বঙ্গবন্ধুর ওপর সরাসরি আক্রমণ চালাতে ব্যক্তিগতভাবে নারাজি দেখায়। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমণ করার পরিবর্তে সেরনিয়াবাতের বাড়ি আক্রমণ করার দায়িত্ব নেয় ডালিম। আর জাতির জনক হত্যাকাণ্ডের জঘন্যতম ঘটনার দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর নূর ও মহিউদ্দিনকে। তাদের সঙ্গে ছিল এক কোম্পানি ল্যান্সার। খুনি ফারুকের অত্যন্ত আস্থাভাজন রিসালদার মুসলেহউদ্দিনকে দেয়া হয় শেখ মণির বাড়ি আক্রমণের। খুনিদের ওপর নির্দেশ ছিল সবাইকে হত্যা করার। এ ছাড়া খুনিদের পরিকল্পনায় বাধা সৃষ্টি করতে পারে বা পরবর্তীতে খুনিদের বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে এমন যে কাউকেই প্রয়োজনবোধে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিল কর্নেল ফারুক। খুনি গ্রুপ ছাড়াও হত্যাকাণ্ডের বাধা আসতে পারে এমন স্থানেও কিছু সৈন্য মোতায়েন ও ট্যাংক প্রস্তুত করে রাখে হায়েনারা। যেন কেউ প্রতিহত করতে আসার আগেই পৃথিবী থেকে চিরতরে তাকে সরিয়ে দেয়া যায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী, একটা ট্যাংক বিমানবন্দরের রানওয়ে আটকাবে আর সৈন্যরা মিরপুর ব্রিজ নিয়ন্ত্রণ করবে। অন্য দলগুলোকে পাঠানো হবে রেডিও স্টেশন, বঙ্গভবন আর নিউমার্কেটের পাশে পিলখানায় বাংলাদেশ রাইফেলস (বর্তমানে বিজিবি-বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড) সদর দপ্তরে। আর ঢাকা সেনানিবাসে ইতিহাসের ন্যক্কারজনক হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নে ব্যস্ত কর্নেল ফারুক বেঙ্গল ল্যান্সারের উদ্দেশ্য ভাষণে ধর্মের দোহাই দিয়ে মুজিবকে শেষ করে দেয়ার নির্দেশ দেয়। খুনি ফারুক বলে, ‘যদি তোমরা ব্যর্থ হও, তাহলে মুজিব সেনাবাহিনীদের শেষ করে দেবে এবং ল্যান্সারদের বাতিল করবে। অতএব আর দেরি নয়। এবার আঘাত হানার সময় এসেছে।’ ভোর ৪টা ০৮ মিনিটের মধ্যেই প্রস্তুত হয়ে যায় খুনিবাহিনী। রক্তপিপাসু ঘাতক চক্র তিন দলে বিভক্ত হয়ে বেরিয়ে পড়ে। মাত্র দুই কিলোমিটার দূরেই তাদের লক্ষ্যবস্তু। গভীর রাতে রক্ষীবাহিনী তড়িঘড়ি করে শেরেবাংলা নগরের এমএনএ-এর হোস্টেলের সামনে লুঙ্গি ও গেঞ্জি পরে অবস্থান নিলেও অজ্ঞাত (!) কারণবশত কিছুক্ষণ বাদেই ফেরত যায় (কার নির্দেশনায় ফিরে যায়, এ প্রশ্নের উত্তর আজও পাওয়া যায়নি)। একটি ট্যাংক পুরনো এয়ারপোর্টের রানওয়ে দিয়ে এসে একটি দেয়াল ভেঙে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পের দিকে ট্যাংকের বন্দুকের নলটি তাক করে। এ ছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ৩০টি ট্যাংক অবস্থান নেয়। মুজিব ও তার ভগ্নীপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত এবং ভাগনে শেখ ফজলুল হক মণির বাড়ি ট্যাংক দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়। মূল দলটি ৩টি উপদলে বিভক্ত হয়ে ভোর ৫টার মধ্যেই ঘেরাও করে ফেলে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়ি এবং তার আশপাশের এলাকা। ১২টি ট্রাক ও কয়েকটি জিপে করে আক্রমণকারী ল্যান্সার ও আর্টিলারির প্রায় ৫০০ জন রাইফেলস ট্রুপস আশপাশে ছেয়ে যায়। খুনি মেজর মহিউদ্দিন, মেজর হুদা, মেজর পাশা, মেজর নূরের নেতৃত্বে আউটার ও ইনার দুটি বৃত্তে ঘেরাও করে ফেলে ওই বাড়িটি। আনুমানিক সাড়ে ৫টার দিকে রাষ্ট্রপতি ভবনে আক্রমণ শুরু হয়। রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে পুলিশ গার্ডরা অবিরাম গুলি চালিয়ে সেনাদের আক্রমণে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে। আর্টিলারির শামছুল আলমের মাথায় গুলি লেগে সঙ্গে সঙ্গেই তিনি মারা যান। আরো একজন আহত হন। সঙ্গীদের ঢলে পড়তে দেখে আর বঙ্গবন্ধু ভবনের ভেতর থেকে প্রচণ্ড প্রতিরোধের কারণে সৈন্যরা তাদের সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। গুলি করতে থাকে চারদিক থেকে। একটি বুলেট মুজিবের ছোটভাই নাসেরের হাতে লাগে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতের মতো এবারো বাড়ির সবাই শেখ মুজিবের শোবার ঘরে আশ্রয় নেন। শেখ মুজিব কয়েকজন অফিসারকে ফোন করেন এবং বারান্দায় এসে পুলিশদের ফায়ার বন্ধ করতে বলেন। বেগম মুজিব শাড়ির এক অংশ ছিড়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দেন নাসেরের রক্তাক্ত হাতে। কামাল ওপর থেকে নিচে নেমে এসে গার্ডদের অবস্থান নেয়ার জন্য বলেন; কিন্তু ততক্ষণে গার্ডরা নিরস্ত্র। এই মুহূর্তে মেজর হুদা কয়েকজনকে নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলে গার্ডরা হুদাকে স্যালুট দেয়। এতে আক্রমণকারী সৈন্যরা বিনা বাধায় বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে প্রবেশের সহজ সুযোগ পেয়ে যায়। ঢুকেই তারা নিচতলার প্রতিটি কক্ষ তল্লাশি করে এবং মেজর হুদার সঙ্গে থাকা একজন বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে কামালকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। শেখ কামাল ও শেখ জামাল সঙ্গে সঙ্গে তাদের স্টেনগান হাতে নিয়ে শত্রæর বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন। তবে বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি কামাল। ব্রাশফায়ারে ঝাঁঝরা হয়ে সিঁড়ির সামনে লুটিয়ে পড়েন তিনি। বঙ্গবন্ধু যখন গোলাগুলির মধ্যে আক্রান্ত ছিলেন, তখন তিনি বাসা থেকে বিভিন্ন দিকে ফোন করে সাহায্য চাইলেন। তিনি পুলিশ কন্ট্রোল রুমে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কেউ ফোন ধরছিল না। এরপর ফোনটি করেন তার মিলিটারি সেক্রেটারি কর্নেল জামিল উদ্দিনকে। যাকে মাত্র ১৫ দিন আগে শেখ মুজিব বিশেষভাবে নির্বাচন করেছিলেন। তাকে বলেন, ‘জামিল তুমি তাড়াতাড়ি আস। আর্মির লোক আমার বাসায় আক্রমণ করেছে। সফিউল্লাহকে ফোর্স পাঠাতে বলো।’ জামিল ফোন পেয়ে তাৎক্ষণিক ছুটে আসেন শেখ মুজিবকে বাঁচাতে। পোশাক পরিধানের সময় না পেয়ে পাজামার ওপর ড্রেসিং গাউনটি চড়িয়ে তার প্রাইভেট লাল কার হাঁকিয়ে ছুটে যান ঘটনাস্থল ৩২ নম্বরে, কিন্তু ততক্ষণে ৩২ নম্বর সড়কের ৬৬৭ নম্বর বাড়িটি কারবালার ময়দান। জামিল গাড়ি নিয়ে বাসায় ঢুকতে চাইলে, সৈন্যরা গুলি চালায় জামিলের বুকে আর মাথায়। টলতে টলতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনেই মৃত্যুর হিমশীতল পরশ আলিঙ্গন করে নেন তিনি। নিজের জীবনের বিনিময়েও শেখ মুজিবের কোনো কাজে আসতে পারলেন না মুজিব সেনা জামিল। একসময় সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহর সঙ্গে কথা হয় বঙ্গবন্ধুর। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘সফিউল্লাহ, তোমার আর্মি আমার বাড়ি আক্রমণ করেছে। কামালকে মনে হয় মেরে ফেলেছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও।’ সফিউল্লাহ বলেন, ‘স্যার আই এম ডুয়িং সামথিং। ক্যান ইউ গেট আউট অব দ্য হাউস।’ এরপর সফিউল্লাহ ফোনে গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান। তখন ভোর আনুমানিক ৫টা ৫০ মিনিট। এর মধ্যেই বাড়ির সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে মেজর মহিউদ্দিন, হুদা, নূর চৌধুরীসহ ঘাতকের দল। দোতলায় ওঠার সিঁড়ির গোড়াতেই দেখা হয়ে যায় ঘাতকের কিলিং মিশনের প্রধান টার্গেট জাতির জনক সঙ্গে। ধূসর রঙের চেক লুঙ্গি-সাদা পাঞ্জাবি আর ডানহাতে প্রিয় পাইপের চিরায়ত বাঙালির শ্বাশত রূপের প্রতিকৃতি বিশাল হৃদয়ের শেখ মুজিবের সামনে দাঁড়িয়ে মুহূর্তে বিচলিত হয়ে যায় খুনি মহিউদ্দিন। শেখ মুজিবকে হত্যার দৃঢ় মনোবল নিয়ে আসা মহিউদ্দিন আমতা আমতা করে বলে, স্যার আপনি আসুন। অত্যন্ত কর্কশ ভাষায় গর্জে ওঠে সিংহ হৃদয়, ‘তোরা কী চাস? কেন বেয়াদবি করছিস? তোরা কি আমাকে খুন করতে চাস? ভুলে যা। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীও তা পারেনি। তোমরা কি মনে করো, তা পারবে?’ শেখ মুজিব তাকে অত্যন্ত কড়া ভাষায় ধমকেই যাচ্ছিলেন। বলছিলেন, ‘যে দেশের সেনাবাহিনী সদস্যরা, দেশের ও সেনাবাহিনীর আইনশৃঙ্খলা ও সংবিধান লঙ্ঘন করে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির বাসা আক্রমণ করতে পারে, আমি তার রাষ্ট্রপতি থাকতে চাই না। তবে তোমাদের মতো অধঃস্তন কর্মকর্তাদের কাছে পদত্যাগও করতে পারি না। তোমাদের সেনাবাহিনীর চিফ ও ডেপুটি চিফদের এখানে নিয়ে এসো, তাদের কাছে ইস্তফাপত্র দেব।’ এ সময় দুজন মেজর বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা বেতার কেন্দ্রে গিয়ে পদত্যাগের ঘোষণা দেয়ার জন্য বললে বঙ্গবন্ধু আবারো বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘আমার সঙ্গে শেখ কামালকে যেতে দিলে আমি বেতার কেন্দ্রে যেতে পারি।’ পরাক্রমশালী ব্যক্তিত্বের কাছে নিতান্তই বেমানান খুনি তখনো একই গান গেয়ে যাচ্ছিল, স্যার, আপনি আসুন। আর অন্যদিকে থামছিল না মুজিবের ধমকানো। কাঁপতে কাঁপতে হাত থেকে পড়ে যায় ল্যান্সার মহিউদ্দিনের পিস্তল। এমন সময় স্বয়ংক্রিয় স্টেনগান নিয়ে দৌড়ে আসে ঘাতক নূর চৌধুরী। (যে এখনো কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছে)। বুদ্ধিমান শেখ মুজিব ধমকিয়ে তাদের সময় ও মনোবল নষ্ট করতে চাইছেন বুঝে ফেলে নূর চৌধুরী। মহিউদ্দিনকে ধাক্কা মেরে এক পাশে সরিয়ে চিৎকার করে বলে, ‘স্টপ! দিস বাস্ট্রার্ড হ্যাজ নো রাইট টু লিভ।’ গর্জে ওঠে স্বয়ংক্রিয় স্টেনগান। বৃষ্টির মতো গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে ছয় ফুট দুই ইঞ্চির বিশাল দেহ মুখ-থুবড়ে পড়ল সিঁড়িতে। বুকের ডানদিকে গুলির বিরাট ছিদ্র। যে উঁচু করা তর্জনী ছিল পাকিস্তানের ভয়ের কারণ আর সন্তানসম বাঙালির আস্থার প্রতীক, ঘাতকের ব্রাশফায়ারে উড়ে যায় সেই তর্জনীটি। তবুও ডানহাতে আঁকড়েধরা ছিল ধূমপানের প্রিয় পাইপ। মসজিদের শহর খ্যাত ঢাকার মসজিদ থেকে ভেসে আসা পবিত্র আজানের ধ্বনিকে বিদীর্ণ করে ঘাতকদের মেশিনগানের ঝাঁক ঝাঁক গুলি। বিদীর্ণ করে বাংলাদেশের বুক। শহিদ হলো অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার এক অপূর্ণ মহৎ স্বপ্ন। ভোরের সময়ই অস্তমিত হয়ে যায় জাতীয় গৌরবের প্রতীক সূর্যের মতো একটি অনন্য অধ্যায়। অন্ধকারের কালো মেঘে ঢেকে যায় বাংলার আকাশ। আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করে অন্ধকার এক সাম্প্রদায়িকতার চোরাগলিতে। ‘তবু তোমার বুকেই গুলির পর গুলি চালালো ওরা/তুমি কি তাই টলতে টলতে বাংলার ভবিষ্যৎকে/বুকে জড়িয়ে সিঁড়ির ওপর পড়ে গিয়েছিলে?’ নির্মম রাতে প্রাণ দিয়েছেন যারা : বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেদিন প্রাণ হারান তার প্রিয় সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, তিন ছেলে মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল, সেনা কর্মকর্তা শেখ জামাল ও ১০ বছরের শিশুপুত্র শেখ রাসেল, নবপরিণীতা দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল। প্রবাসে থাকায় প্রাণে রক্ষা পান বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। ওই রাতে আরো প্রাণ হারান বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছেলে আরিফ সেরনিয়াবাত, মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত, শিশু পৌত্র সুকান্ত বাবু, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, শহীদ সেরনিয়াবাত, আবদুল নঈম খান রিন্টু এবং বঙ্গবন্ধুর জীবন বাঁচাতে ছুটে আসা রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদসহ কয়েকজন নিরাপত্তা কমকর্তা ও কর্মচারী। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জাতি আজ গভীর শোক ও শ্রদ্ধায় স্মরণ করবে এই শহিদদেরও। মহাকালের মহানায়ক : ৫৫ বছরের সংগ্রামী জীবনে বঙ্গবন্ধু বাঙালির হৃদয়ে জাগ্রত মহাকাব্যের মৃত্যুঞ্জয়ী মহানায়ক হিসেবে। এ মহাকাব্যের আবেদন কোনোদিন শেষ হবে না। উজ্জ্বল বাতিঘর হয়ে জাতিকে অনুপ্রেরণা দেবেন। গণতান্ত্রিক চেতনার উজ্জ্বলতা, নিপীড়িত জাতির স্বাধিকার অর্জন এবং মুক্তিসংগ্রামের অবিনাশী গান শোনাবে তার অমর কবিতা ৭ মার্চের ভাষণ। সেই সঙ্গে বাঙালি জাতি পাবে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণে অবিনাশী প্রেরণা। মৃত্যুর পরও তার মহাকর্ম যুগ যুগ এদেশের মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। কবির ভাষায়, ‘মোর লাগি করিয়ো না শোক/আমার রয়েছে কর্ম, আমার রয়েছে বিশ্বলোক/মোর পাত্র রিক্ত হয় নাই/পুণ্যরে করিব পূর্ণ, এই ব্রত বহিবে সবাই।’

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App