×

মুক্তচিন্তা

আসন্ন নির্বাচনে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্য

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ আগস্ট ২০১৮, ০৮:১৯ পিএম

 
বাংলাদেশে বস্তুত আওয়ামী লীগকে প্রত্যাখ্যান করার চিন্তা হবে প্রগতিশীল শক্তির জন্য আত্মঘাতী এবং দেশের জন্যও তা ডেকে আনতে পারে মারাত্মক পরিণাম। আগামী সংসদ নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার দায়িত্ব অবশ্যই সরকারের এবং নির্বাচন কমিশনের। আবার সংশ্লিষ্ট সবাই ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের’ দাবি জানিয়ে ঘরে বসে থাকলেও চলবে না। শুধুমাত্র নির্বাচন মানেই যেমন গণতন্ত্র নয়- তেমনি আবার গণতন্ত্রের প্রাথমিক শক্তিই হলো সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, শক্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দ্রুত এগিয়ে আসছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বলে দিয়েছেন আগামী ডিসেম্বরেই অনুষ্ঠিত হবে নির্বাচন। তাই সরকারি দল আটঘাট বেঁধে মাঠে নেমেছে। প্রেসিডিয়ামের সভা, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভার আলোচনাও সুস্পষ্টভাবেই ইঙ্গিত দেয় নির্বাচন প্রকৃতপক্ষেই আসন্ন। দলীয় সভানেত্রী স্বয়ং নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের প্রাথমিক কাজগুলো অনেকাংশেই সম্পন্ন করে একটি খসড়া তালিকাও প্রস্তুত করার কাজও এগিয়ে নিয়েছেন বলে শোনা যায়। অপরদিকে বিএনপি এখন মামলা-মোকদ্দমা নিয়েই ব্যস্ত। মনে হয় কোমর সোজা করে দাঁড়ানোর শক্তিটুকুও তারা হারিয়ে ফেলেছে। তা না হলেই বা কি হতো? অর্থাৎ খালেদা জিয়া যদি মামলামুক্ত, কারা মুক্ত থাকতেন এবং তারেক রহমানও যদি স্বাভাবিকভাবে দেশে আসতে পারত, তাতে কি তাদের রাজনীতির মৌল আদর্শ বদলে যেত? মৌলিকভাবে বিএনপি কি তার পশ্চাৎপদ রাজনৈতিক আদর্শ ও নীতিমালা ত্যাগ করে প্রগতির ধারায় আসতে পারত? পারত কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আদর্শকে অর্থাৎ গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রকে তাদের কর্মসূচিতে দলীয় মেনিফেস্টোতে, কথায়বার্তায়, আচার-আচরণে গ্রহণ করতে? বিএনপি কি পারবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার, জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলামসহ সব ধর্মাশ্রয়ী দলকে বেআইনি ঘোষণা করার দাবি জানাতে? কখনো না। তারা আওয়ামী লীগ বিরোধী বটে তবে সেটা শুধু ক্ষমতার জন্য, যে কোনো মূল্যে পুনরায় ক্ষমতায় আসতে চায় তারা। কিন্তু আওয়ামী লীগের অনুসৃত নীতিগুলোর সঙ্গে কোথায় কোথায় তাদের দ্বিমত তারা এ সরকারের প্রতিক্রিয়াপন্থি নীতিগুলোর পরিবর্তে প্রগতিমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে কিনা তা আজো খোলাসা করছে না। অতীতে তারা জামায়াতে ইসলামীকে ক্ষমতার অংশীদার করেছিল সেটা আবার যে করবে না তা কদাপি বলছে না। এমন কি নির্বাচনী জোট থেকে জামায়াতে ইসলামীকে বাদ দেয়ার কোনো আগ্রহও তাদের নেই বরং যাতে জামায়াতে ইসলামী আওয়ামী লীগের দিকে ঝুঁকে না পড়ে সে জন্য তারা নতুন করে জামায়াতে ইসলামীকে তোষণ করে চলেছে। জামায়াতও সেই সুযোগ পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করতে কার্পণ্য করছে না। সাম্প্রতিক সিটি কাউন্সিল নির্বাচনগুলোর দিকে তাকালে দিব্যি তা ধরা পড়ে। এ সব কারণে বিএনপিকে কেউ বিরোধী দল বা আওয়ামী লীগের বিকল্প কোনো গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক দল বলে মনে করলে মারাত্মক ভুল হবে। কোনো কারণেই এ দলটি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না সঠিক বিবেচনায়। নেতিবাচক কিন্তু ভোট তারা পেয়ে যাবে হয়তো। সে ভোট হয় বিভ্রান্ত ভোটারদের অথবা হয়তো অবৈধ অর্থের বিনিময়ে প্রদত্ত। তবে এখনো যতটুকু বোঝা যায় তাদের ভোটে জিতে পুনরায় ক্ষমতা দখল করা আদৌ সম্ভব নয়। নানা কারণে মানুষ ক্ষিপ্ত এই সরকারের ওপর। তবে নানা উন্নয়নমূলক কাজের প্রশংসা তাদের অবশ্যই প্রাপ্য। তার মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও আদালতের রায় বাস্তবায়ন, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ও রায় সাধ্যানুযায়ী বাস্তবায়ন ও চার জাতীয় নেতা হত্যার বিচার ও সাধ্যানুযায়ী আদালতের রায় বাস্তবায়ন, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল, মুক্তিযোদ্ধাদের নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা প্রদান, নারীর ক্ষমতায়নে বেশ কিছুটা অগ্রগতি সাধন প্রভৃতি। কিন্তু এত কিছুর পরও এই সরকারের ব্যর্থতা পশ্চাৎগামিতার পাল্লাও কম ভারী নয়। এক. সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী এনে তাতে জিয়া প্রবর্তিত ‘বিসমিল্লাহ’ প্রতিস্থাপন, জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলামসহ সব ধর্মাশ্রয়ী দলগুলোকে সাংবিধানিক বৈধতা প্রদান ও স্বৈরশাসক এরশাদের অষ্টম সংশোধনীর ‘রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম’ সংবিধানে পুনঃস্থাপন। এগুলো হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক বাতিল ঘোষণা করার পর এই সরকার নতুন করে সংবিধান সংশোধন করে তা পুনঃস্থাপন করায় বঙ্গবন্ধুর বাহাত্তরের সংবিধানের অমর্যাদাই ঘটানো হয়নি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে মৌলিক বিচ্যুতি ঘটিয়ে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রহসনে পরিণত করা হয়েছে। এহেন বিচ্যুতি আকস্মিকভাবে ঘটেনি- সুচিন্তিতভাবেই করা হয়েছে মুসলিম মানসকে তুষ্ট করা ও মৌলবাদী জামায়াতে ইসলামী ও জঙ্গিবাদী হেফাজতে ইসলামীর সঙ্গে ভোটের প্রয়োজনে আপসরফার পথ খোলা রাখার লক্ষ্যে। এ বিষয়ে শুভাকাক্সক্ষী এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী অনেকেই অনেকভাবে বলেছেন, লিখেছেন বিভিন্ন সংবাদপত্রে কিন্তু কোনো ফলোদয় হয়নি। তদুপরি সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ভাস্কর্য সরানো, পাঠ্যপুস্তক থেকে প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক খ্যাতিমান লেখকদের নানা রচনা বিস্তর প্রতিবাদ সত্ত্বেও অপসারণ করে সেগুলোর বদলে সাম্প্রদায়িক লেখকদের রচনা স্থান দেয়া, ব্লগারদের নির্মম হত্যার বিচারের ক্ষেত্রে সীমাহীন শ্লথগতি প্রভৃতি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থী কাজকর্ম অব্যাবহতভাবে চলইে। অর্থনীতি ব্যাপক দুর্নীতির করালগ্রাসে নিপতিত। সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা নির্বিঘ্নে লুটপাট, বিদেশে টাকা পাচার, ব্যাংকগুলোর পরিচালকদের এবং ক্ষেত্রবিশেষে চেয়ারম্যানের পক্ষ থেকে এবং তাদের পছন্দের গ্রাহকদের পক্ষ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করা প্রভৃতির মাধ্যমে ব্যাংক খাতকে জনগণের কাছে এক আস্থাহীন সংস্থায় পরিণত করা, এক শ্রেণির মন্ত্রী-এমপির হিসাববহির্ভূত, আয়বহির্ভূত সম্পদ (নিজের ও স্বজনদের নামে) এ সব কিছুই যেন আজ ডালভাতে পরিণত। দুর্নীতিবাজরা খনি থেকে বিপুল পরিমাণ কয়লা পর্যন্ত কীভাবে পাচার করতে পারল সে এক বিস্ময় এবং এ সব অবিশ্বাস্য ধরনের লুটপাট কদাপি এক দিনে বা একক কোনো ব্যক্তির পক্ষে ঘটানো সম্ভব না। প্রকৃত নিরপক্ষ তদন্ত হলে থলের বিড়াল বের করা আদৌ কঠিন কিছু না। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই যেন দায়সারা তদন্ত করে বিচারের আড়ালেই সব কিছু লুকিয়ে ফেলা হচ্ছে। এ সব বড় ধরনের দুর্নীতির কোনো বিচার আজতক হয়নি। হবে এমন লক্ষণও চোখে পড়ে না। এতকিছু ঘটা সত্ত্বেও এগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকরী কোনো প্রতিবাদ-প্রতিরোধে কোনো মহল আজো এগিয়ে আসছে না। ফলে জনগণ হতাশাগ্রস্ত। বিরোধী রাজনীতিও যেন আজ মুখ থুবড়ে পড়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসনসহ অনেক নেতাকর্মীই সম্প্রতি জেলে কিন্তু তার আগেইবা তাদের ভ‚মিকা কী ছিল? দিব্যি তারা সিটি কাউন্সিলসহ নানা নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে কিন্তু আন্দোলনের কথা উঠলেই যেন অজুহাত হিসেবে জেল জুলুমের দোহাই। কিন্তু এত কিছুর মুখেও যে নির্বাচন এগিয়ে আসছে তা নিয়েও বিরোধী মহলগুলোর নড়ন-চড়ন নেহাতই প্রাথমিক পর্যায়ে। প্রয়োজনীয় সময়গুলো দ্রুত মিলিয়ে যাচ্ছে দেখেও কারো যেন তেমন কোন হাপিত্যেশ নেই। সে যা হোক, বিকল্প দল গড়ে তোলার কথা বহু বছর ধরে বাম মহলগুলো থেকে প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু তা যেন প্রচারেই সীমাবদ্ধ। গভীর আন্তরিকতা দিয়ে তা বলা হচ্ছে এবং নিষ্ঠা সহকারে তেমন কোনো প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে এমন কোনো লক্ষণ আজো ময়দানে দেখা যাচ্ছে না। দেখছি কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে একটি আট দলীয় জোট অতিসম্প্রতি গঠিত হয়েছে। যা-ই নাম দেয়া হয়ে থাকুক- এটি আসলে আট দলীয় কমিউনিস্ট ঐকমত্য। কিন্তু যে দেশে মৌলবাদের উত্থান ঘটেছে, জঙ্গি কার্যক্রম গ্রামগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে, যে দেশের সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ’ ‘রাষ্ট্র ধর্ম’ প্রভৃতি লেখা হয়েছে সেই রাষ্ট্রে ‘প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ঐক্য’ গঠনই যে সর্বাধিক প্রয়োজনীয় এবং ততধিক জরুরি এ বিষয়টি যেন উপেক্ষিত হয়েছে। আট দলীয় ঐক্য গঠিত হয়েছে ঠিক পশ্চিম বাংলার আদলে যা হয়তো ভারতের কেরালা এবং ত্রিপুরাতেও দৃশ্যমান। কিন্তু সেখানকার বাস্তবতা ও বাংলাদেশের বাস্তবতা এক নয়। এই ভিন্নতা গভীরভাবে উপলব্ধি করে অগ্রসর হতে না পারলে দিনে দিনে গভীর থেকে গভীরতর বিপর্যয়েরে মুখে পড়তে হবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে। নিজেদের শক্তির দিকে তাকিয়ে এবং দেশের সব বাস্তবতার দিকে তীক্ষ্ণ নজর রেখে আরো যে কথাটি স্পষ্ট করে উল্লেখ করতে চাই তা হলো বাংলাদেশে বস্তুত আওয়ামী লীগকে প্রত্যাখ্যান করার চিন্তা হবে প্রগতিশীল শক্তির জন্য আত্মঘাতী এবং দেশের জন্যও তা ডেকে আনতে পারে মারাত্মক পরিণাম। কারণ হাজারো দুর্বলতা, বিচ্যুতি এবং আপসকামিতা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এই বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তিকে বাদ দিলে যে বাংলাদেশের ছবি সবার চোখে ভেসে ওঠে তা ভয়াবহ ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১-এর চেয়েও তা বিপজ্জনক। এটা বুঝতে নিশ্চয়ই কোনো দিব্যদৃষ্টির প্রয়োজন পড়ে না। আগামী সংসদ নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার দায়িত্ব অবশ্যই সরকারের এবং নির্বাচন কমিশনের। আবার সংশ্লিষ্ট সবাই ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের’ দাবি জানিয়ে ঘরে বসে থাকলেও চলবে না। শুধুমাত্র নির্বাচন মানেই যেমন গণতন্ত্র নয়- তেমনি আবার গণতন্ত্রের প্রাথমিক শক্তিই হলো সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, শক্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। ইংরেজিতে বললে অনেকের কাছে হয়তো বাংলাদেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিটি আরো স্পষ্ট হবে- ‘BANGLADESH AT CROSS ROADS’ এক মারাত্মক পরিস্থিতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। হয় কোমর সোজা করে প্রগতির মুখে ঘুরবে আমাদের প্রিয় দেশটি, নয়তো প্রতিক্রিয়ার এটা বুঝেই কর্তব্য নির্ধারিত হোক দ্রুত। রণেশ মৈত্র : রাজনীতিক, কলাম লেখক; সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App