×

মুক্তচিন্তা

ক্ষতিপূরণে কি ক্ষতি পূরণ করা সম্ভব?

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ আগস্ট ২০১৮, ০৭:৪২ পিএম

 
এই দুনিয়ায় বেঁচে থাকার অধিকার আমাদের সবার সমান। যে ক্ষতি পায়েল, সজীব, মীমের পরিবারের হয়েছে তার বিনিময়ে কোনো অঙ্কই নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। মীমের বা সজীবের বাব-মা আপনাদের কাছে টাকা চায়নি, চেয়েছে এই হত্যার বিচার। সড়কের এ হত্যার বিরুদ্ধে যথাযথ প্রতিরোধ নেয়ার মাধ্যমেই সম্ভব ক্ষতিপূরণ করা।
সড়ক দুর্ঘটনাকে এখন আর দুর্ঘটনা বলতে নারাজ আমরা। কারণ প্রতিদিন যেভাবে সড়কে মানুষ মারা যাচ্ছে তার বিরুদ্ধে কোনো আইনি পদক্ষেপ বা প্রতিকার না নেয়ায় এখন সেটা হত্যার পর্যায়েই চলে গেছে। মনে আছে তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর যখন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলেন তখন তদন্তে দোষী ড্রাইভারের বিরুদ্ধে রায় হয়েছিল আইনি প্রক্রিয়ায়। কোর্টের সেই রায়কে মানেনি আমাদের পরিবহন সেক্টর। তারা সারাদেশে অবরোধের ডাক দিল। দেশ অচল করে দেয়ার হুমকি দিয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করল। সরকার নতিস্বীকার করতে বাধ্য হলো। ভোগান্তিতে পড়েছিল সাধারণ নাগরিকরা। আবারো দেশ উত্তাল হলো সড়কে হত্যা নিয়ে। ক’মাস আগেই জীবন গেল রাজীব নামের এক ছাত্রের, তার দুয়েকদিন পরই জীবন দিল রোজিনা নামের একটি কিশোরী যে জীবিকার তাগিয়ে বাবা-মায়ের কোল ছেড়ে ঢাকায় এসেছিল। কাজ করত মানুষের বাসায়। কিন্তু গ্রামের সেই সহজ সরল মেয়েটির আর বাবা-মায়ের কাছে ফেরা হয়নি জীবিত অবস্থায়। সম্প্রতি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পায়েল নামের এক ছাত্রের মর্মান্তিক মৃত্যুর জন্য দায়ী হানিফ পরিবহনের ড্রাইভার ও হেলপারকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার ঠিক পরপরই জাবালে নূর নামের এক বাস কেড়ে নিল রাজধানীর একটি কলেজের দুটি তাজা প্রাণ, আহত হলো অনেক ছাত্র। নাহ! এখন আর এসব নিয়ে লিখতে ইচ্ছে করে না। করে না কারণ এই দেশে এসব ঘটনা কেবলই ঘটনা হয়েই থাকে। কোনো বিচার হয় না। শাস্তি পায় না কোনো দোষী ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ। অনলাইন পত্রিকায় পড়লাম যে মেয়েটি মারা গেছে তার বাবাও একজন বাসচালক। তিনি দাবি করছেন এটি দুর্ঘটনা না। একজন বাসচালক হিসেবে তিনি জানেন কোনটি অনিচ্ছাকৃত আর কোনটি অবহেলার কারণে ঘটেছে। এই অসহায় পিতার সামনে কোনো পরিবহন নেতারা যাননি। তাদের কেউ গিয়ে সান্ত্বনা দেননি। মাফ চাননি। একজন বাবার বুক ফাটা কান্না কী সেসব পরিবহন নেতাদের হৃদয়ে পৌঁছায় না? আসলে যার যায় সেই বুঝে। যে বাবা তার আদরের সন্তানকে এমন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় হারিয়েছেন, যে বাবা বা মার বুক খালি হয়েছে, যে বাবা বা মা আর কোনোদিন তার বুকের মানিককে কপালে চুমু খেতে পারবেন না, যে বাবা প্রতিদিন ডিউটিতে যাওয়ার সময়ে মেয়েকে কলেজে নামিয়ে দিতে পারবেন না তার কাছে কোনো ক্ষতিপূরণ কী পূর্ণ করতে পারবে বুকের শূন্যতা? যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই আমরা নিহতের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে ঘটনাকে সামলে নিতে চাই। একজন মন্ত্রীর ছেলের গাড়ির নিচে পড়ে জীবন দিল আরেকজন মানুষ। বিচার নয়, সুরাহা হলো তিন লাখ টাকায়। ক্ষমতাহীন সেই পরিবার এতেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। কিছুই যে করার নেই। রমিজ উদ্দীন কলেজের যে দুটি ছাত্রকে হত্যা করা হয়েছে তাদের পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণ চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেছেন একজন। হাইকোর্ট জাবালে নূর পরিবহনকে প্রতি পরিবারকে ৫ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেয়ার রায় দিয়েছে। সেই রায় আবার বাস মালিক দিতে অস্বীকার করেছে বলে পত্রিকায় প্রকাশ। তিনি পাঁচ লাখ নয়, ‘মোটরযান আইন’ অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ দিতে চায় বাস কর্তৃপক্ষ। হায়রে ক্ষতিপূরণ। মোটরযান আইনে বলা আছে ২০ হাজার টাকার কথা তাই তারা ৫ লাখ টাকা দিবেন না। এই যে টাকার অঙ্ক নিয়ে বাহাস চলছে, কেউ কী একবারের জন্য সেই মীম বা সজীবের বাব-মার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে চিন্তা করেছেন বিষয়টা? একটা জীবনের মূল্য আপনাদের কাছে ২০ হাজার? হাজার কেন কোটি দিলেও কী যে ক্ষতি পরিবারগুলোর হয়েছে সেটা পূরণ হবে? একবার ভেবে দেখেন তো। মীমের বাবার আহাজারি কী মিটে যাবে আপনাদের দেয়া টাকায়? মীম কি ফিরে আসবে তার মমতাময়ী মা-বাবার কাছে? বা তার আদরের ছোট ভাইটির কাছে? সজীবের বাবা মাকেই কী উত্তর দিবেন আপনারা? একজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তিনি নিজে পরিবহন নেতা হিসেবে এবং সরকারের একজন ক্ষমতাশালী অংশ হিসেবে অপরাধীদের প্রশ্রয় ও আশ্রয় দিয়ে থাকেন। মীম ও সজীবের মৃত্যুর পর যে ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছেন সেটির বিরুদ্ধে সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে সর্তক হয়ে কথা বলার পরামর্শ দিয়েছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। তাহলে প্রশ্নটি থেকেই যায়, যিনি ক্ষমতার ব্যবহার করে একদিকে অন্যায়ভাবে একটি বৃহৎ সেক্টরের নেতা হয়ে আছেন তিনি কেমন করে দেশের বাকি জনতার সেবক হিসেবে নিজেকে উৎসর্গ করতে পারবেন? স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে তার পক্ষে কী নিরপেক্ষ বিচার করা সম্ভব হবে? দাবি উঠেছে জনতার কাছ থেকে, পদত্যাগ করতে হবে মৃত্যু নিয়ে দাঁত ক্যালানো সেই মন্ত্রীকে। কিন্তু তিনিও কম যান না, পাল্টা প্রশ্ন ছুড়েছেন পদত্যাগেই কী সব সমাধান হবে? তিনি মনে করেন তিনি পদের থেকেই সমাধান করতে পারবেন। এর মাধ্যমে তিনি কী সূক্ষ্ণভাবে আবারো সরকারকে হুমকি দিল? না নিজের ক্ষমতাকে জাহির করতে চাইল? এই যে মানসিকতা আমাদের সেবকদের, এর বিরুদ্ধে লড়াই না করলে, এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে কেবল ক্ষতিপূরণেই কী সমস্যার সমাধান হবে? আমরা যদি মনে করতে শুরু করি যে একজন মানুষের জীবনের মূল্য কিছু নোটের বিনিময়ে সমাধান করা যায় তাহলে বুঝতে হবে সেখানে মনুষ্যত্ব বলে কিছু নেই। যতদিন আমরা মানুষ হিসেবে মানুষের জীবনের মূল্যকে মূল্যায়িত করতে না পারব ততদিন কোনো ডলারের হিসেবেই মিটানো যাবে না এ সমস্যা। আমাদের কর্তৃপক্ষকে উপলব্ধি করতে হবে কোনো মানুষের জীবন নেয়ার মালিক কেউ না। আমার জীবনের দাবি কেবল আমারই। এই দুনিয়ায় বেঁচে থাকার অধিকার আমাদের সবার সমান। যে ক্ষতি পায়েল, সজীব, মীমের পরিবার বা সেসব মৃতদেহের করা হয়েছে তার বিনিময়ে কোনো অঙ্কই নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। মীমের বা সজীবের বাব-মা আপনাদের কাছে টাকা চায়নি, চেয়েছে এই হত্যার বিচার। সড়কের এ হত্যার বিরুদ্ধে যথাযথ প্রতিরোধ ও প্রতিষেধক নেয়ার মাধ্যমেই সম্ভব ক্ষতিপূরণ করা। লীনা পারভীন : লেখক, সাবেক ছাত্রনেতা; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App