×

মুক্তচিন্তা

বুদ্ধের আত্মজাগরণ ও জীবনদর্শন

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০১৮, ০৭:২৮ পিএম

  আষাঢ়ী পূর্ণিমা বৌদ্ধজীবনে অত্যন্ত তাৎপর্যমণ্ডিত ও গুরুত্ববহ তিথি। এ পূর্ণিমায় গৌতম বুদ্ধ সিদ্ধার্থরূপে মাতৃগর্ভে প্রতিসন্ধি গ্রহণ করেন। জরা, ব্যাধি, মৃত্যু ও বিমুক্তিলাভী সন্ন্যাসী- এ চার দৃশ্য দেখে কুমার সিদ্ধার্থ এ পূর্ণিমা তিথিতেই গৃহত্যাগ করেন। আবার বুদ্ধত্ব লাভের পর এ পূর্ণিমা তিথিতে সারনাথের ঋষিপতন মৃগদাবে তিনি পঞ্চবর্গীয় শিষ্য কৌণ্ডণ্য, বপ্প, ভদ্দীয়, মহানাম ও অশ্বজিতের কাছে তার নবলব্ধ ধর্ম প্রচার করার মানসে ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র দেশনা করেন, শ্রাবস্তীতে ঋদ্ধিপ্রতিহার্য প্রদর্শন এবং এ পূর্ণিমা তিথিতে তিনি তার প্রয়াত মাতৃদেবীকে দর্শন ও সদ্ধর্ম দেশনার জন্য তাবতিংস স্বর্গে গমন করেন। এ পূর্ণিমাতেই বৌদ্ধ ভিক্ষুসংঘ ত্রৈমাসিক বর্ষাবাস অধিষ্ঠান গ্রহণ করেন। তাই আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিটি বিশ্বের সব বৌদ্ধদের জন্য অত্যন্ত পবিত্রতম দিন। বৌদ্ধ ভিক্ষু ও গৃহীরা আষাঢ়ী পূর্ণিমার প্রথম দিবস থেকেই তাদের আত্মসংযম ও ধ্যানচর্চা এবং উপোস ব্রতের মাধ্যমে আত্মদর্শন ও আত্মোপলব্ধির শিক্ষা গ্রহণ করেন। মানব জীবনের সর্বগ্রাসী দুঃখ, দুঃখের কারণ এবং তা থেকে মুক্তির উপায় বের করার তাগিদ থেকেই সিদ্ধার্থ গৌতম ২৯ বছর বয়সে সাধনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেন। দুঃখ মুক্তির অন্বেষণে প্রাচীন ঋষি, মনীষীর সান্নিধ্যে যান। কিন্তু কেউ মুক্তির পথরেখা দেখাতে পারেননি। তাদের কাছে ব্রহ্মপ্রাপ্তির উপায় জানতে পারলেন বটে, সর্বজ্ঞজ্ঞান লাভের উপায় কারো জানা ছিল না। তাই তিনি তার আত্মজাগরণের চেতনাকে ছয় বছর কঠোর সাধনার মাধ্যমে সফল করেন। তার মানসজাত ভাবনায় জগৎ দুঃখময়। জাগতিক জীবনযাপনে দুঃখ আছে। অবশ্যই সে দুঃখের কারণ আছে। এই দুঃখ রহস্য উদঘাটনের মধ্য দিয়েই দুঃখ নিরোধ, দুঃখ নিরোধের উপায়মন্ত্র সিদ্ধার্থ গৌতম মধ্যমমার্গ সাধনায় অর্জন করেন এবং অপরিসীম সম্বোধির আলোয় নিজেকে প্রকাশ করলেন মহামানব বুদ্ধরূপে। বুদ্ধ বলেছেন- জন্মে দুঃখ, নাশে দুঃখ, রোগ দুঃখময়, মৃত্যু দুঃখময়। অপ্রিয়ের সংযোগ দুঃখময়, প্রিয়জনের বিয়োগ দুঃখময়। রোগ হতে উৎপন্ন পঞ্চস্কন্ধ দুঃখময়। সব কিছু দুঃখময়। এ দুঃখ আমাদের চারপাশ ঘিরে থাকে। অনির্ধারিত, অনাকাক্সিক্ষত দুঃখ আমাদের যাপিত জীবনে প্রতিনিয়ত হানা দেয় এবং আমাদের বিপর্যস্ত করে। ধম্মপদে বুদ্ধ বলেছেন- অনেক জাতি সংসারং সন্ধাব্বিসং অনিব্বিসং, গহকারকং গবেসন্তো, দুকখা জাতি পুনপপুনং। অর্থাৎ : এ (দেহরূপ) গৃহের নির্মাতাকে অনুসন্ধান করতে গিয়ে (জ্ঞানাভাবে) তাকে না পেয়ে আমি বহু জন্মজন্মান্তর সংসার পরিভ্রমণ করলাম। বারবার জন্মগ্রহণ করা দুঃখজনক। বুদ্ধ নিজের এবং অপরের দুঃখকে এক করে দেখার জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন, তাই দুঃখকেন্দ্রিক চারটি আর্যসত্য এর মৌলিক অখণ্ডনীয় যুক্তির ওপর রচিত বুদ্ধের দর্শন আমাদের পরিশীলিত জীবনাচরণের পথ নির্দেশ করে। বৌদ্ধ দর্শনের উৎপত্তি এবং পরবর্তী সময়ে এর বিকাশ সমাজের সব শ্রেণিকেই ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। তার দর্শন কতটা বৈপ্লবিক তা আমরা তার প্রতিটা বাণীতেই অনুধাবন করতে পারি। তিনি ঐশ্বরিক শক্তির অলৌকিকত্ব কিংবা আশীর্বাদপুষ্টতাকে অস্বীকার করেছেন। ঈশ্বর কিংবা দেবতার করুণায় অর্জিত হয় না কোনো মহৎ কাজ। তিনি ঈশ্বর মুখাপেক্ষী ছিলেন না বলেই সম্পূর্ণ নিজের যোগ্যতা, মেধা, প্রজ্ঞায় অর্জন করেছেন বোধি যেখানে অন্ধ বিশ্বাসের অনুপস্থিতি ও যুক্তিনির্ভর তত্ত্বজ্ঞানের বিশ্লেষণ। যা কিছু দৃশ্যমান, অনুভূত সমস্তই অনিত্য, সমস্তই দুঃখ, সমস্তই অনাত্মা। বুদ্ধ মতে অনিত্য, দুঃখ ও অনাত্মা এই তিনটি বিষয়ে সম্যক জ্ঞানের অভাবই অবিদ্যার লক্ষণ। বুদ্ধের দর্শন চরম নিয়তিবাদের বিরুদ্ধে বলে তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছেন- দুঃখ মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়া কোনো অদৃষ্টবাদী নিয়ন্ত্রকের অধীন নয়। অবিদ্যাপ্রসূত কর্ম দ্বারাই মানুষ দুঃখকে বরণ করে জন্মশৃঙ্খলে যন্ত্রণা কাতর হয়। আবার সম্যক জ্ঞানের আলোয় অবিদ্যা দূর করে নির্বাণলাভের মাধ্যমে মানুষ দুঃখ থেকে পরিত্রাণও পেতে পারে। এ জন্য মানুষকে অন্য কোনো অলৌকিক নিয়ন্ত্রকের অধীন হতে হয় না। তার ধারণায় জীবের চেতন সত্তা ক্ষণস্থায়ী প্রবাহের ন্যায় পরিবর্তনীয়। প্রতিটি ক্ষণের অনুভূতি এক একটি কার্য-কারণমালা বা শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকে বলেই আমাদের মনে একটি স্থায়ী আত্মার ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হয়। সংযুক্ত নিকায়ে বলা হয়েছে, বিনাশশীল দেহ অবিনাশী আত্মা হতে পারে না। আবার ইন্দ্রিয়ানুভূতি, প্রবৃত্তি, বুদ্ধি প্রভৃতির সাহায্যেও অবিনাশী আত্মা গঠিত হতে পারে না, কারণ এগুলো বিনাশশীল। বিনাশশীল উপাদান দিয়ে গঠিত আত্মা অবিনাশী হতে পারে না। মজ্ঝিমনিকায় বলা হয়েছে, স্থায়ী আত্মার ধারণা অজ্ঞান-প্রসূত ও পরিত্যাজ্য। বুদ্ধের দর্শনে আত্মার ধারণা অস্বীকৃত। বুদ্ধ বলেছেন, যদি আত্মাকে নিত্য স্বীকার করা হয় তবে আসক্তি বাড়বে এবং দুঃখ উৎপন্ন হবে। ভ্রান্ত ব্যক্তিই আত্মাকে সত্য বলে মানে, ফলে তার প্রতি আসক্তি বাড়ে। জীবন ও জগতের নিয়ত পরিবর্তনশীলতা ও ক্ষণস্থায়িত্বের কথা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বহু দর্শনেই আলোচিত বিষয়। বুদ্ধের মতে জগতের প্রত্যেকটি জিনিস কার্য-কারণ শৃঙ্খলাবদ্ধ। কোনো বস্তু স্বয়ং উৎপন্ন হয় না। একটি ঘটনা আরেকটি ঘটনা থেকে সংঘটিত হয় ও বিস্তার লাভ করে। সবকিছুর উৎপত্তি কোনো ঘটনা থেকে। প্রতীত্য ও সমুৎপাদ এ দুটি শব্দের সমাস পাওয়া যায়। প্রতীত্য পদের অর্থ কোনো বস্তু উপস্থিত হলে পর বা কোনো কিছুর অধীন এবং সমুৎপাদ শব্দের অর্থ কোনো কিছুর উৎপত্তি। অর্থাৎ প্রতীত্য সমুৎপাদ শব্দটির অর্থ হচ্ছে একটি বস্তুর কিংবা ঘটনার অধীনে বা উপস্থিতিতে (আগমনে) অন্য কোন বস্তুর বা ঘটনার উৎপত্তি। মজ্ঝিমনিকায় বলা হচ্ছে, এটি ঘটবার পর ওটি ঘটছে। একের বিনাশের পর অন্যের উৎপত্তি- এই নিয়মকেই বুদ্ধ নাম দিয়েছেন প্রতীত্য সমুৎপাদ। বুদ্ধের দ্বিতীয় আর্যসত্য অনুযায়ী সবকিছুর যেমন কারণ আছে তেমনি দুঃখেরও কারণ আছে। দুঃখের উৎপত্তিতে একটি কার্যকারণ শৃঙ্খল প্রতিভাত হয়। প্রতীত্য সমুৎপন্ন এই কার্যকারণ শৃঙ্খলে বারোটি নিদান বা কারণের কথা বলা হয়েছে। এজন্যই একে দুঃখের দ্বাদশ নিদান বা দ্বাদশাঙ্গ বলা হয়। দ্বাদশ নিদানের তালিকাটি নিম্নরূপ- পূর্বজন্ম (১) অবিদ্যা চারটি আর্যসত্য বিষয়ে অজ্ঞতা (২) সংস্কার- পূর্বজন্মের কর্মজাত প্রবণতা। বর্তমান জন্ম (৩) বিজ্ঞান- গর্ভস্থ ভ্রুণের প্রাথমিক চেতনা (৪) নামরূপ- দেহমন সংগঠন (৫) ষড়ায়তন- ছয় ইন্দ্রিয় (৬) স্পর্শ- বিষয় সংযোগ (৭) বেদনা বিষয় সংবেদন (৮) তৃষ্ণা বিষয় কামনা (৯) উপাদান বিষয়াসক্তি। ভবিষ্যৎ জন্ম (১০) ভব-পুনর্জন্ম গ্রহণের প্রবণতা (১১) জাতি। পুনর্জন্ম (১২) জরামরণ-বিবিধ দুঃখ। দ্বিতীয় আর্যসত্যের ব্যাখ্যায়, জরামরণ বা দুঃখের কারণ জাতি, জাতির কারণ ভব, ভবের কারণ উপাদান, উপাদানের কারণ তৃষ্ণা, তৃষ্ণার কারণ বেদনা, বেদনার কারণ স্পর্শ, স্পর্শের কারণ ষড়ায়তন, ষড়ায়তনের কারণ নামরূপ, নামরূপের কারণ বিজ্ঞান, বিজ্ঞানের কারণ সংস্কার, সংস্কারের কারণ অবিদ্যা। এভাবে দুঃখের কারণের ব্যাখ্যায় কার্যকারণের শৃঙ্খলাকে বুদ্ধ প্রতিপাদন করেছেন। এই শৃঙ্খলে দুঃখের বারোটি নিদানের একদিকে প্রথম নিদান হচ্ছে জরামরণ, অবিদ্যা হচ্ছে অন্তিম। আবার অন্যদিক থেকে আদিতে অবিদ্যা, আর অন্তে জরামরণ বা দুঃখ। বুদ্ধ সাহসী কণ্ঠে বলেছেন ‘এসো দেখ, আমার অর্জিত জীবন পরিচালনার সুনীতি। পরীক্ষান্তে গ্রহণযোগ্য মনে করলে গ্রহণ কর, যদি গ্রহণ করার মাপকাঠিতে বিবেচ্য না হয় তবে বর্জন কর।’ এমন দুঃসাহসিক বাণী একমাত্র বুদ্ধের কণ্ঠেই উচ্চারিত হয়েছিল যে কারণে বুদ্ধের ধর্ম সার্বজনীন। মহামানব বুদ্ধের সৃজিত দুঃখ মুক্তির সাহসী বাণী আমাদের আত্মজাগরণের এবং মানবিক মূল্যবোধের জীবনাচরণ, বিশুদ্ধ জীবন পদ্ধতি মেনে চলতে পথ দেখায়। মানুষ যদি জীবনাচরণে, কর্মে ও চিন্তায় এবং জ্ঞান ও মননশীলতায় বড় না হয়, তাহলে সে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারে না। এ জন্যই বুদ্ধ শীলাচার জীবন ও সুনৈতিকতার কথা বারবার বলেছেন। যার মাধ্যমেই ব্যক্তি তার শীল, সমাধি, প্রজ্ঞা ভাবনার মাধ্যমেই একটি উন্নত ও উৎকৃষ্ট জীবন তৈরি করতে পারে। বুদ্ধের নীতি ও অনুশাসনগুলো আত্মপ্রতিষ্ঠা ও আপন কর্মশক্তিতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রেরণা জোগায়। বুদ্ধের দর্শন ও যুক্তিবাদ মানুষের আপন কর্মশক্তিকে আস্থাবান করে তুলেছে। আষাঢ়ী পূর্ণিমার এ পুণ্যলগ্নে বুদ্ধের শিক্ষা, নীতি অনুশীলনের মাধ্যমে মানব সমাজ সব সংকীর্ণতা, জাতি-ধর্ম বৈষম্য, সাম্প্রদায়িকতা এবং সংঘাত ও সহিংসতা দূরীভ‚ত করে বিশ্বে মানবতাবোধ, মৈত্রী, সম্প্রীতি ও সৌভ্রাতৃত্বের সেতুবন্ধ রচনা করুক এ শুভ কামনা। আষাঢ়ী পূর্ণিমায় সবাইকে মৈত্রীময় অভিবাদন। সংঘাতময় এ পৃথিবীতে বুদ্ধের অহিংসার অমরবাণীর প্রায়োগিক সদ্ব্যবহারে সমাজের সর্বস্তর থেকে কলুষতা, অকল্যাণ এবং অমানবিক অকুশল কর্ম দূরীভূত করে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হোক। পৃথিবীর সব জীবের কল্যাণ হোক। দিলীপ কুমার বড়ুয়া : রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত), ইউএসটিসি, চট্টগ্রাম।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App