×

জাতীয়

বেপরোয়া জামায়াত-শিবির জনমনে আতঙ্ক, উদ্বেগ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ জুলাই ২০১৮, ১১:০৫ এএম

সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচন (সিসিক) সামনে রেখে সিলেটের রাজনৈতিক দৃশ্যপট বদলে গেছে। বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে দেশব্যাপী চরম নাশকতা ও সহিংসতার অভিযোগে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামী আবার প্রকাশ্যে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকা জামায়াত-শিবিরের হাজার হাজার নেতাকর্মী এখন সিলেট নগরীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আচরণবিধি লঙ্ঘন করে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণার নামে বিশাল শোডাউন করছে। জামায়াত মনোনীত মেয়রপ্রার্থীর প্রতিটি পথসভা এখন জনসভায় রূপ নিচ্ছে। জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে ধারালো অস্ত্র হাতে যুবলীগের নেতাকর্মীদের ওপর হামলাও চালিয়েছে। হঠাৎ জামায়াত-শিবিরের এমন সক্রিয়তায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী এবং নগরীর সাধারণ ভোটারদের মধ্যেও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। এদিকে জামায়াত-শিবিরের এমন আতঙ্কজনক সক্রিয়তার পরও সিলেটের প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন কোনো ব্যবস্থ না নিয়ে রহস্যজনক ভূমিকা পালন করায় নগরবাসীর মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। জামায়াত-শিবিরের এমন সক্রিয়তায় সিলেটের সুশীল সমাজ, মুক্তিযোদ্ধা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ব্যক্তিবর্গ হতাশা ব্যক্ত করেছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিগত ১৫ বছরে জামায়াত সিলেটে কোনো নির্বাচনে অংশ নেয়নি। তারা সব সময় ২০ দলীয় জোটের শরিক দল বিএনপির প্রার্থীর পক্ষে নেপথ্যে থেকে কাজ করেছে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের বিচার হওয়ার পর জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। যাদের বিরুদ্ধে হামলা রয়েছে তারা আত্মগোপনে চলে যায়। স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাÐ চালানো তো দূরের কথা, এই সংগঠনের কাউকে কখনো রাজপথেও দেখা যায়নি। কিন্তু সিসিক নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সিলেটে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের প্রবলভাবে সক্রিয় হয়ে উঠতে দেখা যায়। নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, জামায়াত-শিবিরের দুর্ধর্ষ তৎপরতা ততই দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। গত শুক্রবার নগরীর ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সুবিদবাজার এলাকায় শিবিরের কর্মীরা এক যুবলীগ নেতার রেস্টুরেন্টে ধারালো অস্ত্রসহ হামলা চালিয়েছে। দলীয় প্রার্থী জামায়াতের মহানগর আমির ও সিটি নির্বাচনের মেয়রপ্রার্থী এডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়েরের সমর্থনে লিফেলেট বিতরণকালে ছাত্রলীগ কর্মীরা শিবির কর্মীদের বাধা দেয়। এর এক ঘণ্টা পরই ৭ নম্বর ওয়ার্ডের শিবির সভাপতি দীপুর নেতৃত্বে সংগঠিত হয়ে অস্ত্রশস্ত্রসহ ছাত্রলীগ কর্মীদের ধাওয়া করে শিবির ক্যাডাররা। ছাত্রলীগ কর্মীরা সরে গেলে শিবির ক্যাডাররা সাবেক যুবলীগ নেতা আব্দুল হান্নানের মালিকানাধীন মৌরসী রেস্টুরেন্টে হামলা ও ভাঙচুর করে। আব্দুল হান্নান জানান, ঘটনার সময় তিনি রেস্টুরেন্টে ছিলেন না। সিসিটিভির ফুটেজে দেখেন শিবির সভাপতি দীপুর নেতৃত্বে ৪টি মোটরসাইকেলে ৮-১০ শিবিরকর্মী এসে হামলা চালায়। এর আগে গত ১৫ জুলাই হাউজিং এস্টেট এলাকায় প্রচারণাকালেও শিবির কর্মীরা যুবলীগ কর্মীদের ওপর হামলা চালিয়েছে। জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা নির্বাচনী আচরণ বিধিও ভঙ্গ করছে। গত রবিবার দলীয় প্রার্থী জুবায়েরের নির্বাচনী প্রচারণাকালে ৫ হাজারেরও বেশি নেতাকর্মী বিশাল শোডাউন করেছে। এ ধরনের মিছিল নির্বাচনী বিধিমালা লঙ্ঘনের শামিল। কিন্তু জামায়াতের এই বেপরোয়া কার্যক্রমের পরও সিলেটের পুলিশ প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে রহস্যজনক কারণে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা ততই বেপরোয়া হয়ে উঠছে। এর ফলে সুশীল সমাজসহ নগরীর বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক, ক্ষোভ ও হতাশা দেখা দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা ও সিলেট জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সুব্রত চক্রবর্তী জুয়েল বলেন, নির্বাচনের সুযোগে জামায়াত-শিবির নতুন করে সংগঠিত হয়ে ভোটের মাঠে নেমেছে। তাদের কর্মকাÐে সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ অশান্ত হয়ে উঠতে পারে। এতদিন আত্মগোপনে থাকার পর এই সুযোগে তারা নিজেদের অবস্থান নতুন করে জানান দেয়ার জন্য শেষ চেষ্টা চালাচ্ছে। সিলেট থেকেই তারা ঘুরে দাঁড়াতে চায়। গত কয়েক দিনের কর্মকান্ডে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, সিলেটের সভাপতি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শামসুল আলম সেলিম বলেন, জামায়াত-শিবির আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে। আবার তাদের রাজনীতি করার এই সুযোগ দেয়া ঠিক হচ্ছে না। গত কয়েকদিনের কর্মকাÐে নগরবাসীর মধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। প্রশাসনের এবং নির্বাচন কমিশনের এই ব্যাপারে এখনই ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলে আমি করি। সিপিবি ও বাম সংগঠনের পক্ষ থেকে মনোনীত মেয়রপ্রার্থী আবু জাফর বলেন, জামায়াত-শিবির নির্বাচনের সুযোগে কোণঠাসা অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসেছে। তাদের কর্মকান্ডের ব্যাপারে শাসক দলকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। তারা ভোটের বৈতরণী পার হওয়ার জন্য পেশিশক্তি প্রদর্শনসহ সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালাচ্ছে। এতে সিলেটের মানুষের মাঝে এখন আতঙ্ক বিরাজ করছে। খোঁজ নিয়ে এবং সিলেটের বিভিন্ন স্তরের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে আরো জানা গেছে, কৌশলগত দিকবিবেচনায় নিয়েই জামায়াত নাগরিক কমিটির ব্যানারে মেয়রপ্রার্থী দিয়েছে। জামায়াত বিগত ১৫ বছর নির্বাচনে না আসায় তাদের নিজস্ব ভোটব্যাংকের ব্যাপারে কারো কিছুই জানা নেই। তবে ধারণা করা হচ্ছে, জামায়াতের প্রায় ৩০ হাজার নিজস্ব ভোট রয়েছে। এই ভোটব্যাংক নিয়ে নির্বাচনে জয়লাভ করা যাবে না, এটা তারা জানে। কিন্তু কয়েকটি কারণে জামায়াত এবার ২০ দলীয় শরিক বিএনপির প্রার্থী থাকার পরও নিজস্ব প্রার্থী দিয়েছে। এর মধ্যে একটি কারণ হলো বিগত ১৫ বছর ধরে তারা সিলেটের সব নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছে এবং মাঠে নেমে কাজ করেছে। কিন্তু গত নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর তার কোনো কর্মকানন্ডে জামায়াত-শিবিরকে সম্পৃক্ত করেননি। ফলে গত ৫ বছর জামায়াত-শিবির সিলেটে আরো কোণঠাসা হয়ে পড়ে। তারা মেয়র আরিফের ওপর ভীষণভাবে নাখোশ হয়। এই কারণে জামায়াত জোটের প্রার্থী আরিফুল হকের বিরুদ্ধে মহনগর আমির জুবায়েরকে মেয়রপ্রার্থী করেছে। দীর্ঘদিন ধরে জামায়াতের সাংগঠনিক অবস্থা সুসংহত ছিল না। নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে থাকায় সিলেটে কোনো সাংগঠনিক কার্যক্রম ছিল না। নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগে জামায়াত-শিবির তাদের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে এবং আত্মগোপনে থাকা নেতাকর্মীদের সংগঠিত করার সুযোগ সামনে আসে। একটি সূত্রে জানা গেছে, মেয়রপ্রার্থী জুবায়েরের পক্ষে নির্বাচনী কর্মকান্ডে অংশ নেয়ার জন্য সিলেটের বাইরের বিভিন্ন জেলা থেকে শিবির কর্মীদের সিলেটে নিয়ে আসা হয়েছে। প্রচারণার শেষ দিনে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীর উপস্থিতির মাধ্যমে একটি বড় ধরনের শোডাউন করার পরিকল্পনাও রয়েছে বলে জানা গেছে। জামায়াত নির্বাচনী আচরণবিধির কোনো তোয়াক্কা করছে না। নির্বাচনী বিধি অনুযায়ী কোনো ভোটকেন্দ্রের ৪০০ গজের মধ্যে কোনো প্রার্থীর নির্বাচনী ক্যাম্প থাকবে না। কিন্তু নগরীর ইলেকট্রিক সাপ্লাই রোড এলাকায় স্কলারহোম স্কুুল এন্ড কলেজ ভোটকেন্দ্রের ২০ গজের মধ্যেই জামায়াত প্রার্থী জুবায়েরের প্রধান নির্বাচনী অফিস স্থাপন করা হয়েছে। কয়েকদিন আগে নগরীর কাজীটোলা এলাকায় মঞ্চ তৈরি করে পথসভা করেছেন জামায়াতের প্রার্থী জুবায়ের। এদিকে সিলেটে জামায়াত-শিবিরের সক্রিয়, শোডাউন, যুবলীগ কর্মীদের ওপর হামলার পরও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না। শিবিরের হাতে মার খাওয়ার পরও ভুক্তভোগীরা রহস্যজনক কারণে পুলিশের কাছে কোনো অভিযোগ করেনি। পুলিশও এ ব্যাপারে মাথা ঘামাচ্ছে না। আচরণবিধি লঙ্ঘনের পরও নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের ব্যবস্থা না নেয়ায় সিলেটের বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অনেকেই বলছেন, ধানের শীর্ষের প্রার্থী আরিফুল হকের ভোট কাটার জন্য সরকার জামায়াতকে সুবিধা দিচ্ছে। এতে নৌকার প্রার্থী কামরানের জয়ের সম্ভাবনা জেগে উঠবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App