×

মুক্তচিন্তা

বাংলাদেশে কি কোনো প্রগতিশীল শক্তি আছে?

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ জুলাই ২০১৮, ০৮:৩৮ পিএম

বাংলাদেশে আর্থ-সামাজিক, রাষ্ট্রিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আমরা উন্নতি চাই, প্রগতি চাই, Progress চাই। উন্নয়নও চাই। তবে বিশ্বব্যাংক ও অর্থনীতিবিদরা যেভাবে চিন্তার গোটা ধারাকে কেবল উন্নয়নে সীমাবদ্ধ রাখতে চায়। তা আমরা অতিক্রম করে যেতে চাই। অর্থনীতিবিদদের চিন্তার সীমাবদ্ধতা আমাদের বুঝতে হবে। যে রাজনীতিবিদরা ও বুদ্ধিজীবীরা বিশ্বব্যাংকের অন্ধ অনুসারী, বুঝতে হবে যে, তারা আমাদের ভুল পথে পরিচালনা করেন।

সভ্যতা, প্রগতি, আদর্শ ইত্যাদি নিয়ে দুনিয়ায় এখন খুব কম লোকেরই আগ্রহ দেখা যায়। অনেকে এমন উদারতাবাদ, বহুত্ববাদ, অবাধ-প্রতিযোগিতাবাদ ইত্যাদি নিয়ে আগ্রহী। এসব শেষ পর্যন্ত মানুষকে শূন্যবাদ ও নৈরাশ্যবাদে নিয়ে যায়। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, আন্তর্জাতিকতাবাদ- ইত্যাদিকে অনেকে আজকাল অবাস্তব, প্রতারণামূলক, ভাঁওতামূলক ব্যাপার মনে করেন। যে আদর্শগত বাস্তবতা বিভিন্ন দেশে বিরাজ করছে তাতে মানুষ দ্রুত ধর্মের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে। ধর্মের কিংবা আদর্শের পরম্পরতা ছাড়া বিপুল অধিকাংশ মানুষ চলতে পারে না। বাংলাদেশে প্রগতি বলতে অনেকে ধর্মনিরপেক্ষতা, ধর্মের বিরোধিতা, নাস্তিকতা, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধিতা, নারীবাদ, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা ইত্যাদি বুঝে থাকেন এবং এসবের পক্ষে প্রচার চালান। মৌলবাদবিরোধী আন্দোলন ও নারীবাদী আন্দোলন বাংলাদেশে ১৯৮০-এর দশক থেকে চালানো হচ্ছে এবং আগে বাংলাভাষার দেশে মৌলবাদ ও নারীবাদের ধারণা ও এই পারিভাষিক শব্দ ছিল না। সুবিধাবাদের নিন্দা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরেও দুই দশক প্রচলিত ছিল। কিন্তু পরে বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদরা অতিদ্রুত সুবিধাবাদকে তাদের স্থায়ী কর্মনীতি রূপে গ্রহণ করে নেন। এখন সুবিধাবাদকে বলা যায় বাংলাদেশের জাতীয় আদর্শ। সবচেয়ে সুবিধাবাদীরাই বেশি সম্মানিত ও সফল। সমাজের ও রাষ্ট্রব্যবস্থার স্তরে স্তরে বিকশিত হচ্ছে এমন এক অবস্থা তাকে বলা যায়- জোর যার মুল্লুক তার। ধূর্ততার জোর, চতুরতার জোর, গায়ের জোর, মারামারি করার জোর, অস্ত্রের জোর, টাকাপয়সার জোর। এই অবস্থাটা কি জীবনের জন্য ভালো?

আমার ধারণা সভ্যতা, প্রগতি, আদর্শ, সাম্যবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, আন্তর্জাতিকতাবাদ ইত্যাদির ধারণাকে ইতিহাসের দিক দিয়ে নতুন করে গভীরভাবে বোঝা দরকার। এসবের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে উন্নত নতুন ভবিষ্যৎ সৃষ্টির কথা আমাদের ভাবতে হবে। নতুন কালের জন্য সভ্যতা, প্রগতি, আদর্শ, সাম্যবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, আন্তর্জাতিকতাবাদ ইত্যাদি ধারাকে নবায়িত করে নিতে হবে। প্রচলিত ধারণা আবেদনহীন হয়ে আছে। ইতিহাসের দিক দিয়ে প্রতিটি প্রধান ধর্মের উত্থান-পতন ও পুনরুজ্জীবনকেও আমাদের বুঝতে হবে তাদের আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক পটভূমি সমেত। উন্মেষপর্বে, প্রতিষ্ঠাপর্বে ও অবক্ষয়পর্বে প্রত্যেক ধর্মের ভূমিকাই বিভিন্ন রকম। ধর্মের যেমন অপব্যবহার দেখা গেছে তেমনি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, আন্তর্জাতিকতাবাদেরও অপব্যবহার দেখা গেছে। জাতীয়তাবাদ, ঔপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ এক নয়। অনেকে এগুলোকে গুলিয়ে ফেলেন একাকার করে দেখেন। তাতে ক্ষতি হয়। ইতিহাসের দিক দিয়ে আদর্শগত প্রত্যয়গুলোকে বোঝার জন্য আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে ইউরোপের অগ্রসর জাতিগুলোর রেনেসাঁস, রিফর্মেশক, এনলাইটেনমেন্ট ইত্যাদির দিকে। বাংলার রেনেসাঁসকেও নতুনভাবে বুঝতে হবে। এখানে সংক্ষেপে প্রগতি কথাটির অর্থ সন্ধান করতে চাই। বাংলাদেশে প্রগতি এখন এক হারিয়ে যাওয়া প্রত্যয়। মনে হয় পৃথিবীর সব জাতিই এখন প্রগতির ধারণা হারিয়ে ফেলেছে।

পরিবর্তন ও প্রগতি এক নয়। পরিবর্তন আপনিতেই ঘটে এবং তা মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা নিরপেক্ষ। পৃথিবীতে সব কিছুই পরিবর্তনশীল। অপরদিকে প্রগতি মানবীয় ব্যাপার- মানুষের ইচ্ছাসাপেক্ষ, অর্জনসাপেক্ষ প্রয়াসসাধ্য। সব কিছুই গতিশীল, কিন্তু সব কিছু প্রগতিশীল নয়। কোনো জনগোষ্ঠীতে কিংবা জাতির মধ্যে যে চিন্তা ও কাজের দ্বারা কায়েমি-স্বার্থবাদী অপ্রক্রিয়াশীলদের ও অনুশোচনাহীন অপরাধীদের ছাড়া বাকি সবার কমবেশি কল্যাণ হয়, তার মধ্যেই প্রগতি নিহিত থাকে। প্রগতিতে সর্বাধিক সংখ্যক লোকের সম্ভবপর সবচেয়ে বেশি কল্যাণ বাঞ্ছনীয়। অগ্রগতি না থাকলে, বিকাশ না থাকলে প্রগতি হয় না। আবার যে কোনো অগ্রগতি, যে কোনো বিকাশ প্রগতি নয়। প্রগতির মর্মে থাকে যুগপৎ সৃষ্টিশীলতা, মূল্যবোধ, নৈতিকতা চেতনা, আদর্শবোধ এবং আদর্শ অভিমুখী বাস্তবসম্মত কর্মসূচি ও কর্মনীতি। প্রগতির বিপরীতে থাকে প্রতিক্রিয়াশীলতা। রক্ষণশীলতা প্রগতির সরাসরি বিরোধী নয়। তবে রক্ষণশীলদের বিচার-বিবেচনা বেশি, তাদের গতি ধীর, শেষ পর্যন্ত তারা প্রগতির ধারায়ই চলেন। যুক্তরাষ্ট্রের আব্রাহাম লিঙ্কন, যুক্তরাষ্ট্রের এডমান্ড বার্ক রক্ষণশীল চিন্তাধারার নেতা ছিলেন। যুক্তরাজ্যে রক্ষণশীল দল, Conservative party নামে দল আছে। বাংলা ভাষায় রক্ষণশীলতা, প্রগতিশীলতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার ধারণাকে রাজনীতিবিদরা ও বুদ্ধিজীবীরা কখনো স্পর্শ করেননি।

প্রত্যেক জাতির ইতিহাসেই দেখা যায়, প্রগতিশীল ধারা সব সময় প্রগতিশীল থাকে না, কখনো কখনো রক্ষণশীল হয়ে পড়ে- নানাভাবে বিকারপ্রাপ্তও হয়। আবার রক্ষণশীল ধারাও সব সময় রক্ষণশীল থাকে না, কখনো কখনো প্রগতিশীল হয়ে ওঠে। কোনো জনগোষ্ঠীতে কিংবা জাতির মধ্যে সব মানুষ প্রগতিশীল নয়, অনেকে প্রগতিশীল, অনেকে রক্ষণশীল কিছু লোক প্রতিক্রিয়াশীল। পরিবর্তনশীল পরিবেশে সারা জীবন কেউই এক অবস্থান নিয়ে কিংবা অপরিবর্তনীয় নীতি নিয়ে চলতে পারে না। সমাজের, জাতির, রাষ্ট্রের গতিধারায় আরো অনেক জটিল ব্যাপার আছে। বাংলাদেশে এসব নিয়ে চিন্তা-ভাবনা নেই। প্রগতি ও সভ্যতার জন্য চিন্তা-ভাবনা দরকার। উন্নত চিন্তা ছাড়া উন্নতি, প্রগতি, সভ্যতা সম্ভব নয়। অর্থনীতিবিদদের চিন্তায় টাকা, ডলার, বৈষয়িক সম্পদ, পরিসংখ্যানের মারপ্যাঁচ থাকে, কিন্তু মানবীয় বিষয়াদির বিবেচনা অল্পই থাকে।

ইউরোপে বিকশিত হয়েছিল progress এর ধারণা যার বাংলা করা হয়েছে প্রগতি। লক্ষ করলে দেখা যায়, উন্নতি শব্দটি ইংরেজি progress-এর মোটামুটি সমার্থক। ইতিহাসে উন্নতি, প্রগতি, progress-এই তিনটি শব্দেরই অর্থের মধ্যে বৃদ্ধির সঙ্গে সামাজিক ন্যায়, জনগণের সার্বিক কল্যাণ ও প্রয়োজনীয় নেতৃত্বের ধারণা যুক্ত। এতে যুক্ত থাকে জনগণের উন্নত আর্থিক জীবন প্রতিষ্ঠার সঙ্গে উন্নত সামাজিক জীবন প্রতিষ্ঠারও লক্ষ্য। উন্নতি বা প্রগতির জন্য আর্থিক সমৃদ্ধির সঙ্গে নৈতিক উন্নতিও অপরিহার্য। প্রত্যেক ঐতিহাসিককালের প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর প্রগতি বা উন্নতির জন্য নেতৃত্বের দিক থেকে জনজীবনের কাজের লক্ষ্য নির্ণয় এবং সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নের কার্যক্রম দরকার হয়। চিন্তাশীলতা, শ্রমশীলতা, সাধনা, সংগ্রাম, বিবর্তন, বিপ্লব- এগুলো প্রগতি বা উন্নতির অবলম্বন। উন্নতির বা প্রগতির মর্মে থাকে সৃষ্টিশীলতা ও ন্যায়পরতা।

প্রগতির পথ কুসুমাস্তীর্ণ থাকে না। জাতীয় জীবনে প্রগতি-প্রয়াসী সংঘশক্তির অভাবে কখনো কখনো সে পথ বিলুপ্তও হয়ে যায়। তখন কাউকে কাউকে কঠিন ব্রত নিয়ে একা একাই পথ তৈরি করে সামনে চলতে হয়। তারপর প্রগতি-অভিলাষী জনসম্পৃক্ত সংঘশক্তি গড়ে তোলা গেলে পথ ও বিপথের পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশে এখন কি কোনো প্রগতিশীল সংঘশক্তি আছে? প্রগতিশীল কোনো সামাজিক শক্তি আছে? যারা এখন প্রগতিশীল বলে আত্মপরিচয় দেন তাদের চিন্তা ও কাজের বৈশিষ্ট্য কী? জাতির সামনে পথ ও বিপথের পার্থক্য কি স্পষ্ট? আমরা কি পথে চলছি, না বিপথে? আমাদের কাছেই আমাদের প্রশ্ন।

উন্নতি ও উন্নয়ন এক নয়। উন্নতি মানে উপরে ওঠা, আর উন্নয়ন হলো উপরে তোলা। উন্নতি নিজের শক্তিতে, নিজের বুদ্ধিতে নিজেকে করতে হয়; তাতে অন্যের সহায়তা যতটা সম্ভব, নিজের স্বাধীনতা ও কর্তৃত্ব বজায় রেখে নিজেকে নিতে হয়। আর উন্নয়ন অন্যের পরিচালনায় অন্যের কর্তৃত্বে সাধিত হয়। তাতে নিজের স্বাধীনতা থাকে না। আজকের পৃথিবীতে বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি এবং ধনী রাষ্ট্রসমূহের অর্থলগ্নিকারী বিভিন্ন সংস্থার সুদের ব্যবসা, বাণিজ্যনীতি, কূটনীতি ও গোয়েন্দানীতির সঙ্গে গরিব রাষ্ট্রগুলোর উন্নয়ন সম্পূর্ণ শর্তাবদ্ধ। উন্নয়ন উন্নতি ও প্রগতি থেকে ভিন্ন।

বাংলাদেশ সরকার বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্য এসব অনেক কম নেয়। এখন সাহায্য নেয় এনজিওগুলো এবং সিএসওগুলো (civil socicty organization) যার প্রকৃত হিসাব সরকার কিংবা দেশবাসী কাউকেই জানানো হয় না। এনজিওগুলো এবং সিএসওগুলো হলো বাংলাদেশের ভেতরে বিদেশি সরকার দ্বারা পরিচালিত সংস্থা। আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারী সংস্থাগুলো এখন দাতা সংস্থা ও উন্নয়ন সহযোগী নাম নিয়ে দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর রাজনীতি, প্রশাসন, অর্থনীতি ও শিক্ষা-সংস্কৃতি ইত্যাদির ওপর প্রায় নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব নিয়ে নিয়েছে। বাংলাদেশ আজ এমন এক অবস্থায় পড়েছে যে, তার গুরুত্বপূর্ণ সব কিছু নির্ধারিত হচ্ছে বিদেশি অর্থলগ্নিকারীদের ও কূটনীতিকদের আদেশ নির্দেশ দ্বারা। Twesday Group-এর ভূমিকা অনুসন্ধান করলে অনেক রহস্য উন্মোচিত হবে। যে মূলনীতি অনুসারে তারা কাজ করে তা হলো ‘আধিপত্য ও নির্ভরশীলতা নীতি’। এই নীতির কবলে পড়ে দুর্বল রাষ্ট্রগুলো আরো দুর্বল হচ্ছে এবং স্বাধীনতা হারাচ্ছে। স্বাধীনতা হারানো ও নিঃস্ব হওয়া একই কথা। স্বাধীনতা হারালে নিজের দেহ-মনের ওপরও নিজের কর্তৃত্ব থাকে না।

উন্নতির ধারণা আমাদের নিজেদের আর উন্নয়নের তত্ত্ব পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিবর্গ কর্তৃক আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া। উন্নতির ধারণাকে অপসৃত করে তার জায়গায় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে উন্নয়নের ধারণা। উনিশ শতকের এবং বিংশ শতকের ও প্রথমার্ধের বাংলা ভাষার চিন্তক ও কর্মীদের রচনাবলিতে উন্নতি কথাটিই পাওয়া যায়, উন্নয়ন পাওয়া যায় না। ঐতিহাসিকভাবে এই সময়টা ছিল সৃষ্টির অনুকূল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ১৯৫০-এর দশকের শুরু থেকে উন্নতি শব্দটির ব্যবহার কমিয়ে ক্রমে তার স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে উন্নয়নকে। বাংলাদেশ কালে এসে উন্নতির কথা আমরা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছি এবং উন্নয়ন ছাড়া আমাদের এক দিনও চলে না। আমরা আমাদের স্বকীয় ধারণাকে বিকাশশীল ও কার্যকর রাখার এবং কালের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের প্রয়োজনে নতুন ধারণা উদ্ভাবনের কথা ভাবিনি। উন্নতির কোনো সূচকও আমরা নির্ণয় করিনি। আমরা গ্রহণ করে নিয়েছি আমাদের নিয়ে অন্যদের প্রয়োজনে, অন্যদের দ্বারা উদ্ভাবিত ও অন্যদের দ্বারা আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া সব কর্মনীতি ও ধারণা। আমরা ব্যবহৃত হচ্ছি বিদেশি আধিপত্যবাদীদের উদ্দেশ্য সাধনের কাজে। ক্রমে আমাদের চিন্তা বদলে গেছে, কাজের ধারাও বদলে গেছে। আমাদের মগজ ধোলাই করা হয়েছে এবং চিন্তন পদ্ধতিকে বদলে দেয়া হয়েছে। এখন আমরা নিজেদের হীন ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। জাতীয় জীবনে আমরা আত্মশক্তি হারিয়ে পরের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছি। তাতে বাংলাদেশ ব্যর্থ রাষ্ট্রের অভিধা লাভ করেছে। যতই উন্নয়ন হোক, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ উঠেছে? বাংলাদেশের শাসক শ্রেণিতে স্বাজাত্যবোধ ও স্বরাষ্ট্রচেতনা বিলীয়মান। এমনটা যে কেবল বাংলাদেশে ঘটেছে তা নয়, নানাভাবে সব দুর্বল রাষ্ট্র আজ এই বাস্তবতার মুখোমুখি। দুর্বল রাষ্ট্রগুলো উন্নয়নশীল নাম পেয়েছে বটে, তবে চলমান প্রক্রিয়ায় তারা আত্মরক্ষার ও শক্তিশালী হওয়ার কিংবা উন্নতি করার উপায় পাচ্ছে না। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের অভিঘাতে দুর্বল রাষ্ট্রগুলো তাদের রাষ্ট্রায়ত্ত হারিয়ে চলছে। আমাদের জন্য সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার এই যে আমাদের রাষ্ট্র তার রাজনীতি হারিয়েছে। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের ও ভারতের কর্তৃত্ব কায়েম হয়েছে। বাংলাদেশের ওপর আধিপত্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে চলছে প্রতিযোগিতা। যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশে তার অনুগত পুতুল সরকার কায়েম করতে।

উন্নয়নকে দুর্বল করা হয় মহিমান্বিত করে। এতে উন্নতির অনেক উপাদানকেই স্থান দেয়া হয়। কিন্তু তা কাগুজে ব্যাপার মাত্র। বাস্তবের সঙ্গে কেতাবি ধারণার মিল নেই। শেষ পর্যন্ত উন্নয়নের মাপকাঠি মোট জাতীয় আয় বৃদ্ধির হার মাথাপিছু গড় আয় বৃদ্ধির হার, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার- এসবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। উন্নয়নকে সীমাবদ্ধ রাখা হয় কেবল ডলার কিংবা টাকা দিয়ে যার মূল্য নির্ধারণ করা হয় তার মধ্যে। বিশ্ববিস্তৃত বাজার অর্থনীতির সব অধ্যায় এর সঙ্গে যুক্ত। পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদেরই অপরিহার্য অঙ্গ এই উন্নয়ন।

প্রগতির ধারণা উন্নয়নের ধারণা থেকে ভিন্ন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরাশক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে এবং উন্নয়নের ধারণা উদ্ভাবন করে। তখন থেকে উন্নতি ও প্রগতির ধারণাকে আর বিকশিত করা হয়নি। সভ্যতার উত্থান-পতন সম্পর্কে কালবার্ট সুইটজারের মতো, সংস্কৃতির উত্থান-পতন সম্পর্কে ওয়াস ওয়ার্থ স্পেংলারের মতো পৃথিবীর কোথাও রাজনীতিবিদদের কাছে গুরুত্ব পায়নি। সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রগতির ধারায় অবলম্বন করেছিল বটে, কিন্তু দেশকালের উপযোগী করে বিকশিত করেনি। বাংলা ভাষায় সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রগতির ধারণা কিছুটা বিস্তার লাভ করেছিল, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নে কিংবা বাংলাদেশে কোথাও প্রগতির কোনো সূচক বা পরিমাপক নির্ণয় করা হয়নি। বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, যুক্তরাষ্ট্রের উন্নয়নের ধারণা সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পূর্ণ গ্রহণ করে নিয়েছিল এবং মার্কসীয় ডায়লেকটিস ও ইতিহাসের বস্তুবাদী ধারণা ভুলে গিয়েছিল। প্রগতি ও উন্নতির মর্মও ভুলে গিয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে (১৯৯১)। তাতে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি দার্শনিক ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা The End of History নামে বই লিখে উল্লাস প্রকাশ করেছেন। তিনি মতপ্রকাশ করেছেন যে, মার্কসীয় ইতিহাসের ধারণার চির অবসান ঘটে গেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙে পড়ার পেছনে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্য- দুই রকম কারণই ছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগীরা নিরন্তর চেষ্টা চালাচ্ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নকে ব্যর্থ করে দিতে। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙে পড়ার জন্য অভ্যন্তরীণ কারণই মূল, বাহ্য কারণ অভ্যন্তরীণ কারণের মধ্য দিয়ে কাজ করেছে। প্রগতির প্রয়োজনে অভ্যন্তরীণ বিষয়াদির সঙ্গে পারিপার্শ্বিক বিষয়াদিকেও বিবেচনায় ধরতে হয়।

বাংলাদেশে আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আমরা উন্নতি চাই, প্রগতি চাই, Progress চাই। উন্নয়নও চাই। তবে বিশ্বব্যাংক ও অর্থনীতিবিদরা যেভাবে চিন্তার গোটা ধারাকে কেবল উন্নয়নে সীমাবদ্ধ রাখতে চায় তা আমরা অতিক্রম করে যেতে চাই। অর্থনীতিবিদদের চিন্তার সীমাবদ্ধতা আমাদের বুঝতে হবে। যে রাজনীতিবিদরা ও বুদ্ধিজীবীরা বিশ্বব্যাংকের অন্ধ অনুসারী, বুঝতে হবে যে, তারা আমাদের ভুল পথে পরিচালনা করেন। আমরা আমাদের জন্য এবং গোটা মানবজাতির জন্য সমৃদ্ধিমান, সুন্দর, প্রগতিশীল নতুন ভবিষ্যৎ চাই। শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো থেকে আমরা দর্শন-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি গ্রহণ করতে চাই আত্মসত্তা রক্ষা করে- আমাদের মতো করে। এ উদ্দেশে জাতীয় জীবনের নানা কাজের মধ্যে আমরা জাতীয় ইতিহাসের চর্চা চাই। ক্লাসিকের চর্চা চাই। নতুন ক্লাসিক ও উন্নত ভবিষ্যৎ সৃষ্টির প্রচেষ্টা চাই। আমরা আত্মশক্তির ওপর নির্ভর করে অতীত থেকে এবং বাইরের জগত থেকে ভালো যা কিছু সম্ভব গ্রহণ করে সামনে চলতে চাই।

নতুন ভবিষ্যৎ সৃষ্টি করতে হলে অতীত সম্পর্কে ধারণাকেও পুনর্গঠিত ও নবায়িত করতে হবে। অতীত সম্পর্কে প্রচলিত সব ধারণা অপরিবর্তিত রেখে উন্নত ভবিষ্যৎ সৃষ্টির চেষ্টা ব্যর্থ হয়।

বাংলাদেশের লেখক-শিল্পীদের ও রাজনীতিবিদদের একটি ধারায় দেখা যাচ্ছে বিশ্ব ভারত ও কলকাতার সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণ। তারা আত্মবিস্মৃত। অপর একটি ধারাকে দেখা যাচ্ছে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি বিরূপ মনোভাব নিয়ে, দেশকালের ঐতিহ্য উপেক্ষা করে, কেবল মধ্যযুগের মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম ইতিহাসের ভালোবাসা স্থূল ধারণার মধ্যে নিজেদের সংস্কৃতির উৎস সন্ধানে ব্যস্ত। দুই পক্ষেরই কেন্দ্রীয় প্রবণতা ধনতান্ত্রিক। ধনসম্পদ, ক্ষমতা ও ভোগবাদ দুই পক্ষেরই চালিকাশক্তি। এই দুই ধারার কোনোটির মধ্যেই আত্মশক্তির উপলব্ধি ও উন্নত নৈতিক চেতনার পরিচয় পাওয়া যায় না। দুই পক্ষই সমভাবে মুক্তবাজার অর্থনীতি, অবাধ-প্রতিযোগিতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়ন নিয়ে চলছে। দুই পক্ষেরই রাজনীতি বৃহৎ শক্তিবর্গের স্থানীয় দূতাবাস ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্টেট ডিপার্টমেন্টের নির্দিষ্ট ডেস্ক অভিমুখী। দুই ধারার মাঝখানে, ১৯৮০-র দশকের শুরু থেকে ভীষণভাবে সক্রিয় আছে সিএসও (civil Society Organizations) ও এনজিওরা। সাম্রাজ্যবাদী মহলের আর্থিক সহায়তা নিয়ে এবং নির্দেশ নিয়ে তারা চলে। বাংলাদেশের রাজনীতির ও সংস্কৃতির গতি ও প্রকৃতি নির্ধারণে গত প্রায় চার দশক ধরে তারা নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে আসছে। তাদের কথামতো চলে কোনোকালে বাংলাদেশের রাজনীতি সুস্থ স্বাভাবিক আত্মবিকাশের পথে উঠতে পারবে? চিন্তার ও কর্মের তিনটি ধারার ভূমিকাই ইতিহাসের সম্মুখগতির বা প্রগতির পরিপন্থী।

সভ্যতা, প্রগতি, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, আন্তর্জাতিকতাবাদ ও বিশ্বায়ন ইত্যাদির ইতিহাস জেনে নতুন বাস্তবতায় নতুন করে নিজেদের আদর্শ নির্ণয় করে উন্নত নতুন ভবিষ্যতের পথে চলতে হবে। আদর্শগত পুনর্গঠন এখন সময়ের মূল দাবি। আবুল কাসেম ফজলুল হক : প্রগতিশীল চিন্তাবিদ, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App