×

জাতীয়

ধেয়ে আসছে বন্যা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০১৮, ১১:১৬ এএম

ধেয়ে আসছে বন্যা
ধেয়ে আসছে বন্যা
টানা বৃষ্টি, উজান ও পাহাড়ি ঢলের কারণে দেশের প্রায় সব নদনদীর পানি বাড়তে শুরু করেছে। গত তিন দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভারি বর্ষণের কারণে তিস্তা, সুরমা, ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, ঘাঘট, শঙ্খ, যমুনা ও পদ্মার পানি বেড়েছে। মেঘনা, বুড়িগঙ্গা, তুরাগসহ দেশের অন্য নদীগুলোর পানিও বাড়ছে। ইতোমধ্যেই সুরমার কানাইঘাট ও সুনামগঞ্জ পয়েন্ট, কুশিয়ারার শেরপুর-সিলেট পয়েন্ট, সারিঘাটের সারিগোয়াইন পয়েন্ট এবং পুরনো সুরমার দিরাই পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্যদিকে নীলফামারীর ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার মাত্র ৫ সেন্টিমিটার নিচে রয়েছে তিস্তা নদীর পানি। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া জানান, গত সপ্তাহে উত্তরাঞ্চলের নদীগুলোতে পানি কমার প্রবণতা থাকলেও সোমবার থেকে তা আবারো বাড়তে শুরু করেছে। অন্তত আরো দুদিন ব্রহ্মপুত্র-যমুনার পানি বাড়বে। এ ছাড়া দেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে এবং ওই এলাকা সংলগ্ন ভারতীয় অংশে আরো বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। সোমবার ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ২৩২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশে পানি বৃদ্ধির প্রবণতা আরো বাড়তে পারে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের সূত্র মতে, বর্ষা মৌসুমের কয়েক মাস আগেই এ বছর দেশব্যাপী অতি বর্ষণ ও ভারি বর্ষণ শুরু হয়েছে। বৈশাখের শুরুতেই বড় ধরনের বৃষ্টিপাত হয়েছে। সঙ্গে ছিল বজ্রপাতও। জ্যৈষ্ঠ মাসেও বজ্রপাত হয়েছে, সামান্য বিরতি দিয়ে বৃষ্টি ছিল মুসলধারে। বজ্রপাতে প্রাণহানির ঘটনা নতুন আতঙ্ক ছড়িয়েছে। আষাঢ়ের শুরুতে বজ্রপাত কিছুটা কমলেও বৃষ্টির তীব্রতা বেড়েছে। অতি বর্ষণে পাহাড় ধসে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। সবমিলিয়ে এবার মাঝারি থেকে ভয়াবহ বন্যার একটা আশঙ্কা রয়েছে। এদিকে বন্যার আশঙ্কায় আগাম প্রস্তুতি হিসেবে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় তিন মাস আগ থেকেই সতর্ক রয়েছে। এ জন্য তারা দফায় দফায় বৈঠক করে ৬৪ জেলা প্রশাসককে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রস্তুত থাকতে নির্দেশ দিয়েছে। সব জেলায় নগদ টাকা, চাল ও ঢেউটিন বরাদ্দ দিয়েছে। খোলা হয়েছে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। আবহাওয়া অধিদপ্তরের সঙ্গেও সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। জানা গেছে, আবহাওয়ার খবর পর্যালোচনা করে গত এপ্রিল মাসেই বন্যার আশঙ্কা করে সরকার। এর আগে দেশের ২০ থেকে ২২টি জেলায় বন্যায় প্লাবিত হলেও এবার আরো বেশি জেলায় বন্যা হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়। এ বছর বর্ষা মৌসুমে দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৩৭ জেলায় বন্যার আশঙ্কা রয়েছে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এর পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে পাঁচ দিনই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ও মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহ্ কামাল। ওই বৈঠকে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। এরপর ১ মে বৈঠক করে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়। বৈঠকে বন্যাসহ যে কোনো দুর্যোগ মোকাবেলায় সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেয়া হয়। জরুরি বার্তা দেয়া হয়েছে দেশের ৬৪ জেলা প্রশাসকের কাছে। তাদের বন্যাসহ যে কোনো দুর্যোগ মোকাবেলায় সতর্কাবস্থায় রাখা হয়েছে। ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সচিব এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। অন্যদিকে বন্যার সময় জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলায় সব জেলার ডিসির ত্রাণ ভান্ডারে দুই লাখ টন চাল, নগদ ৫ লাখ টাকা ও দুই বান্ডিল ঢেউটিন দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে শীতের কম্ব^ল দেয়া হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থা অধিদপ্তরে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে। জেলা উপজেলার স্কুল কলেজ ও মাদ্রাসার ভবনগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখার জন্য বলা হয়েছে, যেন বন্যা দেখা দেয়া মাত্রই বন্যাকবলিত মানুষজনকে আশ্রয় দেয়া যায়। সুনামগঞ্জ থেকে জাকির হোসেন ও স্বপন কুমার বর্মণ জানান, ৫ দিনের টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের কারণে সুনামগঞ্জের নদী ও হাওরের পানি বেড়েছে। গতকাল বুধবার বেলা ৪টা পর্যন্ত সুরমা নদীর সুনামগঞ্জ পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ৭২ সেমি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এ জেলায় গত ২৪ ঘণ্টায় ১০৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টিপাতের কারণে নদী তীরবর্তী এলাকাসহ গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ সড়ক তলিয়ে গেছে। এতে জনদুর্ভোগের সৃষ্টি হয়েছে। সুনামগঞ্জ পৌর শহরের তেঘরিয়া, নবীনগর, আরপিননগর, বড়পাড়াসহ কয়েকটি আবাসিক এলাকায় পানি প্রবেশ করেছে। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি সড়ক প্লাবিত হওয়ায় যান চলাচলসহ মানুষের চলাফেরায় বিঘ্ন ঘটছে। এদিকে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় গত কয়েকদিনের অতি বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে পানি বেড়েছে। হাওরের প্রবল ঢেউয়ে উপজেলা সদর থেকে বিশ্বম্ভরপুর বাজার পর্যন্ত সড়ক ভেঙে যাচ্ছে, ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে কৃষ্ণনগর পূজা মন্দির। শক্তিয়ারখলা থেকে বিশ্বম্ভরপুর সদর পর্যন্ত সড়ক পানিতে ডুবে থাকায় তাহিরপুর উপজেলার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। ফলে নৌকা দিয়ে জনসাধারণকে চলাচল করতে হচ্ছে। অন্যদিকে ছাতক পৌর শহরের তাঁতিকুলা, বৌলা, বাঁশখোলা ও নোয়ারাই গ্রামে সুরমা নদীর পানি ঢুকেছে। জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলার প্রায় ৩০টি গ্রামের ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি আছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী রঞ্জন কুমার দাস জানান, কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিম্নাঞ্চলের বেশ কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে সর্বত্র বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সমির বিশ্বাস জানান, বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রও প্রস্তুত রাখা আছে। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রশাসন প্রস্তুত রয়েছে। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা ফরিদুল হক জানান, জেলার প্রতি উপজেলায় ১০ টন করে চাল ও নগদ ৫০ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছে। নীলফামারীর ডিমলা থেকে মাজহারুল ইসলাম লিটন জানান, ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধির কারণে ডিমলা উপজেলার পূর্ব ছাতনাই, খগাখড়িবাড়ি, টেপাখড়িবাড়ি, খালিশা চাঁপানী, ঝুনাগাছ চাঁপানী, গয়াবাড়ি ও জলঢাকা উপজেলার, গোলমুÐা, ডাউয়াবাড়ি, শৌলমারী ও কৈমারী ইউনিয়নের ১৫টি চরের দুই সহ¯্রাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ভারতের গজলডোবা ব্যারাজের জলকপাট খুলে দেয়ার ও ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে তিস্তা নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানিয়েছেন তিস্তা অববাহিকার জনপ্রতিনিধিরা। ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা নিয়ন্ত্রণ পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের কর্মকর্তারা জানান, মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে দুপুর ৩টা পর্যন্ত ডালিয়ার তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে তিস্তার পানি ৫২ দশমিক ৫২ মিটার দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। গতকাল দুপুর ১২টা নাগাদ তা আরও ৩ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে ৫২ দশমিক ৫৫ মিটারে প্রবাহিত হয় এবং পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ডালিয়া ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রফিকুল আলম চৌধুরী বলেন, মঙ্গলবার সকাল থেকে তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেলেও এখনো বিপদসীমা অতিক্রম করেনি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে তিস্তা ব্যারেজের সব কয়টি (৪৪টি) সøুইস গেট (জলকপাট) খুলে রাখা হয়েছে। ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুন নাহার বলেন, বন্যা-দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। নীলফামারী জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ খালেদ রহীম বলেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে পুরো বিষয়টি মনিটরিং করা হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড, উপজেলা প্রশাসন, ইউনিয়ন পরিষদ এ নিয়ে কাজ শুরু করছে। চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থেকে এম নাজিম মাহমুদ জানান, ভারি বর্ষণে পাহাড়ি ঢলে বন্যায় সাতকানিয়ায় অর্ধ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। শঙ্খ নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদীভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। পাহাড়ি ঢলে শত শত ঘরবাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ভাঙনের শিকার ঘরহারা মানুষ খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। উপজেলার নিচু গ্রামগুলো বন্যায় মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্যার পানি সাতকানিয়া আদালতের মাঠে প্রবেশ করায় আদালতের কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। পৌরসভার আনুফকির দোকান এলাকায় উভয় পাশে সড়ক বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ওই সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। এদিকে উপজেলার বাজালিয়া বড়দুয়ারা মাহালিয়া রাস্তার মাথা এলাকা, দস্তিদার হাটের পূর্বে আধা কিলোমিটার সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় বান্দরবান-চট্টগ্রাম সড়কে মঙ্গলবার থেকে লোকাল বাস চলাচল বন্ধ রেখেছেন মালিকরা। এতে হাজারো যাত্রী দুর্ভোগে পড়েছেন। তারা পানিতে ডুবে থাকা স্থানে নৌকা, ভ্যান ও রিকশা দিয়ে পারাপার হচ্ছেন। অন্যদিকে উপজেলার সহ¯্রাধিক মৎস্য প্রকল্প বন্যার পানিতে ডুবে যাওয়ায় চাষিদের কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে। ফসলেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তলিয়ে গেছে বীজতলা। গো-খাদ্যেরও চরম সংকট দেখা দিয়েছে। সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোবারক হোসেন বলেন, বন্যায় প্লাবিত এলাকাগুলোর খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। বন্যা পরিস্থিতি সম্পর্কে জেলা প্রশাসককে জানানো হয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App