×

জাতীয়

সংগ্রাম ও সাফল্যের সত্তরে আওয়ামী লীগ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ জুন ২০১৮, ১১:০৪ এএম

সংগ্রাম ও সাফল্যের সত্তরে আওয়ামী লীগ
স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সাফল্যের ৬৯ বছর পেরিয়ে ৭০তম বছরে পদার্পণ করল দক্ষিণ এশিয়ার প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী এ দলটি তৈরি হয়েছিল ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন। দীর্ঘ উত্থান পতনের ধারাবাহিকতায় এখন টানা ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রক্ষমতায় আছে দলটি। প্রতিষ্ঠাকালে রাজধানীর টিকাটুলিতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে যে দলটি আত্মপ্রকাশ করেছিল সেই দলটিই আজকের আওয়ামী লীগ। আত্মপ্রকাশের ছয় বছরের মাথায় দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে দেয়া হয়, উদ্দেশ্য ছিল দলে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা এবং অসাম্প্রদায়িকতা প্রতিষ্ঠা করা। ১৯৬৬ সালে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যে ছয় দফা দাবি তুলে ধরা হয়েছিল, সেটাকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের প্রথম পদক্ষেপ মনে করা হয়। এরপর ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের ভ‚মিকা দলটিকে এই অঞ্চলের একক বৃহৎ রাজনৈতিক দলে পরিণত করে আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পরিণত হন দলের অবিসংবাদিত নেতায়। এরসঙ্গে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা যুক্ত হওয়ায় শেখ মুজিব আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। বলা হয় সেই জনপ্রিয়তাই ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বিপুল বিজয় এনে দেয়। ফলশ্রুতিতে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিল, যার ধারাবাহিকতায় এখন স্বাধীন বাংলাদেশ। আওয়ামী লীগ স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা পাওয়ার পর সরকার প্রধান হন দলের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু একপর্যায়ে গিয়ে ১৯৭৫ সালে দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে বিলুপ্ত করে দিয়ে চালু করছিলেন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশাল নামের শাসনব্যবস্থা। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. শান্তনু মজুমদার ভোরের কাগজকে বলেন, বাকশালটাকে আমি দেখি তৎকালীন দেশের ভেতরের রাজনীতি এবং বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে। বাকশাল ভালো হয়েছে না মন্দ হয়েছে, এর উত্তর দিতে আমি এই মুহূর্তে অপারগ। এটা লম্বা আলোচনার বিষয়। তবে এটুকু বলতে পারি যে আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্রের যে অভিযাত্রা, সেটাকে একপ্রকার থমকে দিয়েছিল বাকশাল। কিন্তু এটুকু বলে থেমে গেলে, বাকশালের ধারণার প্রতি সুবিচার করা হবে না। দেশে কিছু লোক আছে বাকশাল প্রসঙ্গে আলোচনা করে মজ্জাগত এন্টি-আওয়ামী সেন্টিমেন্ট থেকে। তাতে বাকশাল বোঝার ক্ষেত্রে কোনো সুবিধা হয় না। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকদের হাতে সপরিবারে নিহত হন বঙ্গবন্ধু। এরপর দীর্ঘ সময়ের জন্য সামরিক সরকারের শাসনে চলে যায় বাংলাদেশ। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ঘটে বিরাট ছন্দপতন। সেসময় দেশের বাইরে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে দলের নেতৃত্ব গ্রহণের পর আবার ছন্দে ফিরতে শুরু করে আওয়ামী লীগ। পরবর্তী সময়ে ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশে যে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন শুরু হয় তার অন্যতম শরিক হয় আওয়ামী লীগ, যুগপৎ সেই আন্দোলনে স্বৈরশাসকের পতন হয়। দীর্ঘকাল পর ১৯৯০ সালে একটি সাধারণ নির্বাচনে অংশ নিলেও পরাজিত হয়ে বিরোধী দলে পরিণত হয় আওয়ামী লীগ। তবে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নারী বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে জাতীয় সংসদে জোরাল ভ‚মিকা রাখেন শেখ হাসিনা। দীর্ঘ ২১ বছর রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থাকার পর অবশেষে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন নির্বাচনে জয়ী হয়ে আবার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। তার আগে ১৫ ফেব্রুয়ারি একটি বিতর্কিত নির্বাচনের পর আন্দোলনে নামে আওয়ামী লীগ। এ সময় নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে একটি আন্দোলন করে সফলতা পায় দলটি। এরপর ২০০১ সালে নির্বাচনে হেরে আবারো বিরোধীদলের আসনে বসে দলটি। ৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকার পর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফের বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। দ্বিতীয় দফায় বাংলার প্রধানমন্ত্রী হন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। এ মেয়াদে সংবিধানে সংশোধনী এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেয় আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের সাফল্যর কথা বলতে গিয়ে বর্তমান মেয়াদে দায়িত্ব পালনের কথা তুলে ধরে শান্তনু মজুমদার বলেন, আওয়ামী লীগের গত কয়েক বছরের মধ্যে আমার দৃষ্টিতে অন্যতম তিনটি সাফল্য হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীর বিচার, সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে পুনরায় অন্তর্র্ভুক্ত করা এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মতো একটা গণতন্ত্রপরিপন্থী জিনিসকে পরিত্যাগ করতে পারা। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার বিদায়টা কতটা তাত্তি¡কভাবে বুঝেশুনে আর কতটা দলীয় অবস্থান থেকে করা হয়েছে তা বলতে পারব না। তবে ঘটনাটা ঘটেছে, এটা ভালো ব্যাপার। অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশের সাফল্য আন্তর্জাতিকভাবেই স্বীকৃত। এই সাফল্যের বড় দাবিদার আওয়ামী লীগ। তবে একদিকে যেমন অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে, অন্যদিকে বৈষম্যও প্রবল হচ্ছে, যা কোনো শুভ ইঙ্গিত বহন করে না। তারপরও বাংলাদেশ অর্থনেতিক উন্নয়নের দিকে ধাবিত হচ্ছে, এই সরকার সে বিষয়ে অনেকখানি সাফল্য দাবি করতে পারে। ব্যর্থতার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন দলের কতগুলো রোগ থাকে। যেমন : মাঠপর্যায়ে ছোট ছোট দুর্নীতি, যেমন দুঃস্থ ও বিধবা ভাতার টাকা আত্মসাৎ করা। আওয়ামী লীগ এই ব্যাপারটি খুব একটা অতিক্রম করতে পারেনি। এই ছোট ছোট দুর্নীতিগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে না পারা, এটা সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচন্ড ক্ষোভ তৈরি করে। এটা আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে ভোগাতে পারে। আরেকটি হচ্ছে, এক ধরনের ধমকের সংস্কৃতি। অনেক সময় ছোট ছোট পাতি নেতারাও সাধারণ মানুষকে ধমক দিয়ে কথা বলেন। এ ছাড়া বড় দুর্নীতিগুলোর বিষয়েও প্রশ্ন থেকে যায়। বড় দুর্নীতিবাজদের কাকে ধরা হবে কাকে বাইরে রাখা হবে সে ব্যাপারে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। এই বিষয়গুলো ভাবার দরকার আছে বলে আমি মনে করি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়াই সেই নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়। এতে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। অবশ্য এ নির্বাচন নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে পড়তে হয় আওয়ামী লীগকে। সেই পরিস্থিতির জন্য আওয়ামী লীগকে এককভাবে দায়ী করেন অনেকেই। এ বিষয়ে শান্তনু মজুমদার বলেন, ওই নির্বাচনে একটি পক্ষ যেকোনোভাবে নির্বাচন করতে চেয়েছিল। আরেক পক্ষ যেকোনো উপায়ে নির্বাচন ঠেকাতে চেয়েছে। এটা ছিল সামর্থ্যরে লড়াই। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ জিতেছে, এইত ব্যাপার। লড়াইটা শুরু হয়েছিল ২০১৩ সালের ফেব্রæয়ারির শুরুতে; যুদ্ধাপরাধের রায় আসার সময় থেকে। মে মাসে হেফাজতে ইসলামের মধ্য দিয়েও এর বহিঃপ্রকাশ দেখেছি। বছরজুড়ে সংখ্যালঘুদের ওপর সারা দেশে হামলার ঘটনা ঘটতে দেখেছি। অনেক কিছু দেখেছি। এসব বিবেচনা থেকে ২০১৪ সালের নির্বাচনকে শুধুমাত্র তত্ত্বাবধায়কের দাবির ফ্রেমে দেখার অবকাশ নেই। আশা করা যাক যে ২০১৮ সালের নির্বাচনে ২০১৪ এর পুনরাবৃত্তি হবে না। শান্তনু মজুমদারের মতে, বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে আসার দায়িত্ব সরকারি দলের না। তবে নির্বাচনে আসার পথে যেন কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি না হয়, সেটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারি দলের। প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে আওয়ামী লীগের কর্মকান্ড প্রসঙ্গে শান্তনু মজুমদার বলেন, সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতি তত্ত্ব ভিত্তিক পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ থেকে ও উদার গণতান্ত্রিক ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্তরণের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দিয়েছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সর্বোচ্চ উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া, একে স্বাধীনতার পক্ষে পরিচালিত করা আওয়ামী লীগের কৃতিত্ব। এটা সম্ভবপর হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের গুণে। বামপন্থীদের বিশাল অবদানের কথা স্মরণে রেখেই বলছি কথাটা। তবে সামরিক শাসনের আমলে আওয়ামী লীগ প্রচন্ড চাপের মধ্যে পড়েছে, অস্তিত্ব সংকটের মধ্যে পড়েছে। সেই অবস্থা থেকে আওয়ামী লীগ বেরিয়ে এসেছে। তারপরও আওয়ামী লীগ একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক দলে পরিণত হয়েছে কি না, সে ব্যাপারে আমি বলব, এক্ষেত্রে দলটিকে লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে। দলের ভেতরে গণতন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তথা চার নীতির ক্ষেত্রে কখনো-কখনো দৃষ্টিকটু শিথিলতা এগুলো কিভাবে সামনের দিনগুলোতে দেখভাল করা হয় তা দেখার বিষয় হবে নিশ্চয়ই।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App