×

জাতীয়

পার্বত্য জনপদে ধসের ঝুঁকি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২ জুন ২০১৮, ১২:০৩ পিএম

পার্বত্য জনপদে ধসের ঝুঁকি
নির্বিচারে পাহাড় নিধন, পাহাড়ের গাছপালা ধ্বংস, নদী-খাল, নালা নর্দমা দখল-ভরাট করে ফেলায় ফের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শঙ্কায় পড়েছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ও তিন পার্বত্য জেলা। গত দুদিন ধরে এসব এলাকায় প্রবল বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এতে পাহাড়ধসের পাশাপাশি বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে কয়েকটি এলাকায় পাহাড়ধস, দেয়ালধস, বৈদ্যুতিক খুঁটি পড়ে যাওয়া, পানির স্রোতে শিশু ভেসে যাওয়া ও নৌকাডুবিতে কমপক্ষে ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে গিয়ে গতকাল পর্যন্ত কমপক্ষে ২০ জেলে নিখোঁজ ছিলেন। অন্যদিকে উখিয়া-টেকনাফ এলাকায় রোহিঙ্গাদের বসতির জন্য নির্বিচারে পাহাড় নিধনের ফলে সেখানেও বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে বলে খোদ প্রশাসনের পক্ষ থেকেই বলা হয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে পুরো বৃহত্তর চট্টগ্রামই এখন রয়েছে পাহাড়ধস, প্রবল বৃষ্টিজনিত জলাবদ্ধতা ও বন্যার শঙ্কায়। যদিও প্রশাসন এসব প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে হতাহতের ঘটনা ও ক্ষয়ক্ষতি রোধে ঝুঁকিপূর্ণভাবে পাহাড়ের পাদদেশে ও পাহাড়ে বসবাসরতদের সরিয়ে আনার জন্য সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু তাতেও খুব একটা কাজ হচ্ছে না বলেই বিভিন্ন এলাকা থেকে খবর পাওয়া গেছে। পরিবেশবিদ, নগর পরিকল্পনাবিদসহ পাহাড়ধস রোধে কাজ করছেন এমন বিশিষ্টজনরা গত কয়েক বছর ধরেই মানবসৃষ্ট প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধে নানা ধরনের সতর্কবার্তা ও করণীয় সম্পর্কে বারবার সতর্ক করে আসছেন। কিছু সুপারিশও করেছেন তারা। কিন্তু তা থেকে গেছে অকার্যকর। হঠাৎ বড় ধরনের কোনো পহাড়ধসে হতাহতের পর বেশ তোড়জোড় দেখা গেলেও শুষ্ক মৌসুমে এসব প্রতিরোধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়ার কার্যকর পদক্ষেপ নেই বললেই চলে। এ ব্যাপারে পরিবেশ স্থপতি ও পরিকল্পনাবিদ আশিক ইমরান ভোরের কাগজকে বলেন, আমরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ফোরাম থেকেই পাহাড়-বনাঞ্চল-নদী-খাল-জলাশয় রক্ষার দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু দেখা গেছে, বৃহত্তর চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো একের পর এক নির্বিচারে ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে। বিশেষ করে তিন পার্বত্য জেলা ও কক্সবাজারের বিভিন্ন পাহাড়ে বসতি স্থাপনকারীদের অন্যত্র সরাতে সুপারিশ করেছিলাম। কিন্তু তাতো হয়নি, উল্টো তা আরো বাড়ছে। পাহাড়ে পরিকল্পিত বনায়নের পরিবর্তে বন উজার হচ্ছে। আবার পাহাড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা বাড়ানোর জন্য যেসব সড়ক তৈরি করা হচ্ছে পাহাড় কেটে  তা সঠিকভাবে করা হচ্ছে কিনা তারও কোনো মনিটরিং নেই। নানামুখী উন্নয়ন-বসতির নামে যেভাবে পাহাড়-বন ধ্বংস করা হচ্ছে তাতে তো পরিবেশ-প্রকৃতি আমাদের ওপর প্রতিশোধ নেবেই। এখনো সময় আছে সচেতন হয়ে পরিকল্পিতভাবে এসব কিছুকে রক্ষা করে প্রাণহানি ও সম্পদহানি থেকে রেহাই পাওয়ার। ভোরের কাগজের রাঙ্গামাটি প্রতিনিধি নন্দন দেবনাথ ২০১৭ সালের ১৩ জুন রাঙ্গামাটির বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক পাহাড়ধস ও হতাহতের বিষয়টি তুলে ধরে গতকাল বলেন, বৃষ্টির যে অবস্থা দেখছি তাতে আবারো তেমন কোন ট্র্যাজেডি ঘটে যেতে পারে। গত বছর সে সময়ে রাঙ্গামাটিতে কমপক্ষে ১২০ জনের প্রাণহানি ও অনেকে আহত হয়েছিলেন। চট্টগ্রামের সঙ্গে রাঙ্গামাটির সরাসরি সড়ক যোগাযোগই বন্ধ ছিল প্রায় ১০ দিন। তিন দিনব্যাপী বিদ্যুৎবিহীন এক ভ‚তুরে জনপদে পরিণত হয়েছিল তখন রাঙ্গামাটি। এদিকে প্রবল বৃষ্টির পানিতে চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন এলাকার ঘরবাড়ি-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে গেছে। কোথাও হাঁটু পানি আবার কোথাও কোমর পানি বা তার চেয়েও বেশি। চট্টগ্রামে গতকাল সোমবার বেলা ৩টা পর্যন্ত ২৩৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস। রাঙ্গামাটিতে ২৫৭ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন রাঙ্গামাটি প্রতিনিধি নন্দন দেবনাথ। এ দুটো বৃষ্টিপাতই এ মৌসুমের সর্বোচ্চ রেকর্ড বলেই জানা গেছে আবহাওয়া অফিস সূত্রে। চট্টগ্রাম নগরীতেও পাহাড়ের ভ‚মিধসের আশঙ্কায় পাহাড়ে ও পাহাড়ের ঢালে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের সরিয়ে নিতে শুরু করেছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। নগরীর ৪ সার্কেলের অন্তর্ভুক্ত ৯ পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করা ৪৯০ পরিবারকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে এরইমধ্যে। চট্টগ্রাম জেলার বেশ কয়েকটি উপজেলার রাস্তাঘাট ডুবে বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এদিকে প্রবল বৃষ্টির কারণে রাঙ্গামাটিতে পাঁচ স্থানে পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে। চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি সড়কের অন্তত দুটি জায়গায় সড়কে পানি উঠে যাওয়ায় এবং পাহাড়ের মাটিধসের কারণে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ অনেকটা বিচ্ছিন্ন। প্রবল বৃষ্টির সঙ্গে ঝড়ো হাওয়ায় ট্রলার ডুবে ২ জন ও বিদ্যুতায়িত হয়ে ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার ফিশিং বোট মালিক সমিতি সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সাগরে নিম্নচাপের প্রভাবে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের অন্তত তিনশ জেলে ফিরে এসেছেন। অপরদিকে রাউজান উপজেলার হলদিয়া ইউনিয়নের পূর্ব সীমান্তে ডাবুয়া খালের ওপর কৃষিনির্ভর জনপদের সেতুটি সম্পূর্ণ ভেঙে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। গতকাল সোমবার সকালে প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে এটি সম্পূর্ণ দ্বি-খন্ডিত হয়ে যায়। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন কৃষিজীবী, শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ। সেতুটি নতুনভাবে নির্মাণের আশ্বাস দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। রাঙ্গামাটির বাসিন্দা-সাংস্কৃতিক সংগঠক ও সংবাদকর্মী ফজলে এলাহী জানিয়েছেন, প্রবল বৃষ্টির কারণে রাঙ্গামাটি জেলার সাতছড়ি, কলেজগেইট, শিমুলতলী, বেদবেদী ও মুসলিম পাড়া এলাকায় পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটেছে। পাহাড়ধসের ঘটনায় পুরো রাঙ্গামাটি জেলায় রবিবার বিকেল থেকে বিদ্যুৎ ছিল না। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে রাঙ্গামাটিতে পাহাড়ধসের শঙ্কায় সাধারণ মানুষকে সতর্কবার্তা দিয়ে নিরাপদ আশ্রয় চলে যেতে মাইকিং করে বলা হয়েছে। বেশ কয়কটি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এদিকে কক্সবাজার প্রতিনিধি সৈয়দুল কাদের জানিয়েছেন, বঙ্গোপসাগরে কক্সবাজারসহ বিভিন্ন চ্যানেলে এ পর্যন্ত প্রায় ১২টি ট্রলারডুবির ঘটনা ঘটেছে। এতে ২০ মাঝি-মাল্লা নিখোঁজ রয়েছেন। নিহত হয়েছেন ২ জন। এর মধ্যে কক্সবাজার সদরের চৌফলদন্ডীর মোহনায় ঝড়ো হাওয়ার কবলে পড়ে ১০টি ট্রলারডুবির ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় আব্দুস শুক্কুর (৩৫) ও দিদারুল আলম (৩০) নামে দুই জেলের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রায় ১০ জন জেলেকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। বর্তমানে তারা কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে মাটির দেয়ালধসে মো. সুলতান নামে ৩ বছরের এক শিশু মারা গেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসরত কমপক্ষে এক হাজার পরিবারকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। বান্দরবান থেকে ভোরের কাগজের প্রতিনিধি মংশানু মারমা জানিয়েছেন, বান্দরবানেও প্রবল বৃষ্টির কারণে পাহাড়ধসের আশঙ্কা রয়েছে। শঙ্খ নদীর পানি নদীর দুক‚ল ছাপিয়ে আশপাশের বিস্তীর্ণ জনপদ-ঘরবাড়ি তলিয়ে গেছে। বান্দরবান-রাঙ্গামাটি সড়ক পানিতে প্লাবিত হওয়ায় সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। চট্টগ্রামে রবিবার বিকেল থেকে বিরামহীন বৃষ্টিতে নগরীর ওয়াসা মোড়, জিইসি মোড়, দুই নম্বর গেট, মুরাদপুর ও বহদ্দারহাট মোড়, চকবাজার, ধনির পুল, কাপাসগোলা, বাদুরতলা, কেবি আমান আলী রোড, খাজা রোড, প্রবর্তক মোড়, সিঅ্যান্ডবি কলোনি, হালিশহরের বিভিন্ন এলাকা, সিডিএ আবাসিক এলাকা, আগ্রাবাদ এক্সেস সড়কের একাংশ এবং বাকলিয়ার বিভিন্ন অংশে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। ফলে এসব এলাকার বাসিন্দাদের নিদারুণ দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। বৈরী আবহাওয়ার কারণে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে অপেক্ষমাণ বড় জাহাজ থেকে ছোট জাহাজে পণ্য খালাস (লাইটারিং) বন্ধ রয়েছে। সাগর উত্তাল থাকায় প্রবল ¯্রােত ও ঢেউয়ের কারণে বহির্নোঙরে বড় জাহাজে আমদানি করা খোলা পণ্য লাইটার (ছোট) জাহাজে খালাস করা ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় লাইটারিং বন্ধ রাখা হয়েছে। চট্টগ্রামের বৃহত্তম ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার চাক্তাই-খাতুনগঞ্জেও সড়কে পানি উঠে যায়। আড়ত ও দোকানে পানি ওঠার ভয়ে অনেক ব্যবসায়ী-কর্মচারীকে দোকানেই রাত কাটাতে হয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App