সব
৮ জুন রাত সাড়ে ৮টা। ডেমরা থানার ডিউটি অফিসারের কক্ষে বেশ ভিড়। জিডি করছেন ৩ যুবক। বাকিরা বসে আছেন। জিডি করা শেষে লাল শার্ট পরা এক যুবকের সঙ্গে থাকা অন্য যুবককে ২০০ টাকা দিতে বলে। পরে সেই টাকা দেয়া হয় অপারেটর রুহুল আমীনকে। এরপর জিডি করতে বসেন একটি ম্যাগাজিনের মালিক পরিচয়দানকারী এক ব্যক্তি। পারিবারিক বিষয় নিয়ে জিডি শেষে তিনিও অপারেটর রুহুল আমীনকে ৫০০ টাকা দেন। এরপরে ছিলেন এক বৃদ্ধ। তিনিও জিডি করে ১০০ টাকা দেন। কিন্তু ২০০ টাকার নিচে পেয়ে একটু অখুশি মনেই টাকাটা নেন রুহুল আমীন। এভাবেই প্রত্যেকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে নিজ ড্রয়ারে রাখতে থাকেন তিনি।
রাত সাড়ে ৯টার দিকে মেয়েকে নিয়ে থানায় মামলা করতে আসেন আসমা বেগম নামে এক মহিলা। থানায় কোনো শিশু ও নারীবিষয়ক ডেস্ক না থাকায় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গা দৌঁড়ে বেড়াতে দেখা যায় তাকে। ঘটনা কি? জানতে চাইলে আসমা বেগম বলেন, ইমোতে এক ছেলের সঙ্গে আমার মেয়ের প্রেমের সম্পর্ক হয়। কিন্তু ওই ছেলে যে বিবাহিত, তা আমরা জানতাম না। এখন ওই ছেলের শ্বশুরবাড়ির লোকজন আমাদের মারধর করছে। বিষয়টি নিয়ে মামলা করতে এলাম, অথচ পুলিশ আমাদের পাত্তাই দিচ্ছে না। এর
কিছুক্ষণ পর আবার তাদের দেখা যায় থানার সামনে। এবার আসমা বেগম বলেন, এসআই নাসিরের সঙ্গে কথা হয়েছে। ৫০০ টাকা আনতে বলছিলেন, এনেছি। এখন মামলা করব।
এ সময় তার হাতে ৫০০ টাকার নোটও দেখা যায়। এরপরই আসমা বেগমের স্বামী ফোন করে পরের দিন মামলার কথা বললে তারা চলে যান।
অভ্যাগতদের সঙ্গে কথা বলে এবং স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা যায়, ডেমরা থানায় জিডি করার জন্য ২০০ এবং মামলা করার জন্য ৫০০ টাকা যেন ‘ফিক্সড প্রাইজ’। এ ছাড়া যে কোনো সেবা নিতে হলেও গুণতে হয় টাকা। আর এসব কিছুর সঙ্গেই জড়িত আছেন ডিউটি অফিসার আহছান। তবে টাকা নেয়ার বিষয়ে অভিযুক্তরা ভোরের কাগজের সঙ্গে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
এদিকে, ডেমরা থানা এলাকায় রয়েছে প্রায় ৩০০ অবৈধ কারখানা। আছে প্রায় ৫ হাজার অবৈধ অটোরিকশাও। প্রতিদিন ২৫০টি অটোরিকশার গ্যারেজ থেকে পুলিশের নামে চাঁদা উঠানো হয়। ফলে অটোরিকশা চালকরা থানা পুলিশকে ঘুষ দিয়ে দেদারসে চালিয়ে যাচ্ছে এই যান। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার এলাকায় অটোরিকশা থেকে পুলিশের নামে চাঁদা উঠায় আনোয়ার।
এ এলাকায় অবৈধ স্থাপনারও অভাব নেই। থানা পুলিশ ও প্রশাসনকে ম্যানেজ করে স্থাপনাগুলো গড়ে তোলা হয়েছে। অপরদিকে, ডেমরা থানা এলাকা ডিএমপির অন্যতম মাদক অভয়ারণ্য হিসেবে চিহ্নিত। নারায়ণগঞ্জ থেকে ডেমরা রুট দিয়েই রাজধানীতে মাদক প্রবেশ করে। মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পুলিশের জড়িত থাকার অভিযোগও পাওয়া গেছে।
এসব বিষয়ে ডেমরা থানার ওসি মো. সিদ্দিকুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, আমি ১ মে এখানে যোগদান করেছি। এরপর থেকে জিডি কিংবা মামলায় কোনো টাকা নেয়া হয় না। আপনি চাইলে প্রতি মামলা ও জিডির বাদীর সঙ্গে কথা বলতে পারেন। বাদীরা ভয়ে এখনই নাম বলছে না, ফোন দিলে কি স্বীকার করবে? আর সবগুলো ঘটনা এ প্রতিবেদকের সামনেই ঘটেছে জানালে ওসি বলেন, কখনো কেউ অভিযোগ করেনি। যদি আমরা নির্দিষ্ট অভিযোগ পাই তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।
অবৈধ কারখানা ও অটোরিকশা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি এই থানায় নতুন এসেছি। এখনো সব কিছু বুঝে উঠতে পারিনি। তবে, অপরাধী যেই হোক তাকে ছাড় দেয়া হবে না। মাদকের বিষয়ে তিনি আরো বলেন, মাদককে আমরা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। এখন আর আগের মতো নেই।
সরেজমিন দেখা যায়, সকাল থেকে সারাদিনই বেশ নিরিবিলি থাকে থানা। কিন্তু সন্ধ্যার পরেই উল্টো চিত্র। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও দালালরা ভিড় করতে থাকে থানায়। তাদের ভিড়ে ওসির যেন অন্য কারো সঙ্গে কথা বলার সুযোগ নেই। অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য নিতে চাইলে তিনি ২ ঘণ্টা অপেক্ষায় রাখেন এ প্রতিবেদককে।
থানার সূত্র জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৫৮টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ৪৪ মাদক ও ৩টি ধর্ষণ মামলা। ফেব্রæয়ারিতে ৪১টি মামলার মধ্যে ২৭টি মাদক ও ৩টি নারী নির্যাতন মামলা। মার্চে ৫০টি মামলার মধ্যে ৪০টি মাদকের। এপ্রিলে ৫৯ ও মে মাসে ৫৫টি মামলার মধ্যে বেশিরভাগই মাদক সংশ্লিষ্ট মামলা।
থানার কর্মকর্তারা জানান, ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার, গলাকাটা, সানারপাড়, বাদশা মিয়া রোড, মুসলিম নগর, কোনাপাড়া, মোস্তমাঝি, ডগাইর, সারুলিয়া, পাউটি, হাজীনগর ও সুলতানা কামাল ব্রিজ এলাকা নিয়ে থানাটি গঠিত। এ থানায় ১ জন ইন্সপেক্টর ইনচার্জ (ওসি), ২ জন ইন্সপেক্টর, ১৯ জন এসআই, ২২ এএসআই ও ৩৯ জন কন্সটেবল রয়েছে। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। থানায় গাড়ির সংকটের কারণে প্রায়ই লেগুনা ভাড়া করে টহল করতে হয়। এ ছাড়া ভবনের যে সমস্যাগুলো রয়েছে সেগুলো ঈদের পরে থানার নতুন ভবনে শিফট হলে আর থাকবে না বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।