×

অর্থনীতি

বাজেটে বরাদ্দ রাখলেও ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে সরকারি ব্যাংকে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ জুন ২০১৮, ১২:১২ পিএম

বাজেটে বরাদ্দ রাখলেও ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে সরকারি ব্যাংকে
সরকারি ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি মেটাতে প্রতি বছরই বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়। সে অনুযায়ী চলতি অর্থবছরেও দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটেও এই খাতে অর্থ বরাদ্দের সম্ভাবনা রয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকারি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণে গত ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর এ চার বছরে জনগণের করের টাকা থেকে সরকার সর্বমোট ৯ হাজার ৬৪০ কোটি জোগান দিয়েছে। অন্যদিকে সরকারের কাছে ২০ হাজার কোটি টাকা মূলধন চাইছে রাষ্ট্রায়ত্ত ৬টি ব্যাংক। চাহিদা অনুপাতে বরাদ্দ সেক্ষেত্রে একেবারেই নগণ্য। করের টাকা থেকে মূলধন ঘাটতিতে থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে এ বছরেও মূলধন জোগানের সিদ্ধান্ত চ‚ড়ান্ত করেছে সরকার। ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতির গুরুত্ব এবং বরাদ্দ বিবেচনা করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ মূলধন বরাদ্দের সুপারিশ করবে। গত এপ্রিল মাসে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি পরিস্থিতি নিয়ে সচিবালয়ে বৈঠক করেছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এর সিনিয়র সচিব মো. ইউনুসুর রহমানের সভাপতিত্বে বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরসহ সোনালি, রূপালি, জনতা, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীরা উপস্থিত ছিলেন। সূত্র জানায়, সভায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা (এমডি) তাদের চাহিদার কথা জানান। তখন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ জানায়, চলতি অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি পূরণে বরাদ্দ রয়েছে ২ হাজার কোটি টাকা। এ অবস্থায় ঘাটতি বিবেচনায় অর্থ ছাড় করা যেতে পারে। সূত্রে জানা গেছে, সরকারি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণে ২০১১-১২ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। জানা গেছে, এক সোনালী ব্যাংকের কারণেই রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মোট মূলধন ঘাটতি অল্প সময়ের ব্যবধানে এত বেড়েছে। এই ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি যেখানে গত সেপ্টেম্বরে ছিল ৩ হাজার ১৩০ কোটি টাকা, সেখানে তা বেড়ে ডিসেম্বরে হয়েছে ৬ হাজার ৫৯৩ কোটি টাকা। কিন্তু ব্যাংকগুলোর জন্য যত টাকা বাজেটে রাখা হচ্ছে, সে তুলনায় মূলধন ঘাটতি পূরণের চাহিদা ১০ গুণ বেশি। এভাবে দেশের গরিব মানুষের করের টাকায় মূলধন ঘাটতি মেটানো হয় বলে সমালোচনাও রয়েছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, মূলত খেলাপি ঋণের কারণেই মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে ব্যাংকগুলো। তবে আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে মূলধন ঘাটতি পূরণের জন্য বাজেটে টাকা বরাদ্দ নাও রাখা হতে পারে। এর বদলে বিকল্প পথ খুঁজছে সরকার। সেটি হচ্ছে ব্যাংকগুলো বর্তমানে সরকারের যেসব সেবা বিনামূল্যে দিয়ে থাকে, তা আর বিনামূল্যে দেবে না। সূত্র জানায়, মূলধন ঘাটতি পূরণে সবচেয়ে বেশি অর্থ চেয়েছে সোনালী ব্যাংক। এ ব্যাংকটি প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা চাহিদার কথা জানিয়েছে। এ ছাড়া রূপালি, জনতা, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংক বড় ঘাটতিতে রয়েছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ পর্যালোচনা করে দেখেছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির অন্যতম কারণ বহুল আলোচিত হলমার্ক কেলেঙ্কারি। এ কারণে সরকার ২০১৩-১৪ ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সোনালী ব্যাংককে ২ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা দিয়েছে। বিসমিল্লাহ গ্রæপ কেলেঙ্কারির ক্ষতি মেটাতে জনতা ব্যাংকও টাকা পেয়েছে। আর বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির পর এই ব্যাংককে সরকার প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের শেষে দেখা গেছে, সরকারি মালিকানার ৬ ব্যাংকে ঘাটতি রয়েছে ১৭ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা। এসব ব্যাংকের মধ্যে মূলধন ঘাটতির শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। এক বছর আগে ঘাটতি ছিল ৭ হাজার ৮৩ কোটি টাকা। সোনালী ব্যাংকের ঘাটতি ৩ হাজার ৪৭৪ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা হয়েছে। বেসিক ব্যাংকে আগের মতোই ২ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকার ঘাটতি রয়েছে। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৮১৩ কোটি টাকা, রূপালী ৬৩৮ কোটি এবং জনতা ব্যাংকে ১৬১ কোটি টাকা। এদিকে ব্যাংকগুলোকে বাজেটে কেন ‘পেইডআপ ক্যাপিটাল’ দেয়া হচ্ছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, অযথা জনগণের অর্থ কেন অপচয় করা হচ্ছে তার কোনো সঠিক ব্যাখ্যা নেই। নতুন কয়েকটি ব্যাংকেও সরকারি ব্যাংক থেকে টাকা দেয়া হচ্ছে। এটা অপচয়, এভাবে ব্যাংক বাঁচানো যাবে না। নিজেদের সুশাসন, দক্ষতা দিয়েই বাঁচতে হবে। ড. সালেহ উদ্দিন বলেন, ব্যাংকিং সেক্টর পুনর্গঠন করতে না পারলে যতই বিনিয়োগ চান বা সুদ কমাতে বলেন তাতে কোনো কাজ হবে না। সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর বরাদ্দ এমনিতেই প্রতি বছর কমছে। তার ওপর গরিবদের থেকে মাশুল নেয়ার চিন্তা হবে ভুল উদ্যোগ বরং ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ে মনোযোগী হওয়া উচিত। তিনি বলেন, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলো নিজেরাই মূলধন ঘাটতিতে আছে। তাদের দিয়ে আবার বেসরকারি ফারমার্স ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণের উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, মূলধন ঘাটতি পূরণে প্রথম ২০১১-২০১২ অর্থবছরে রাখা হয় ৩৪১ কোটি টাকা। পরের ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা রাখা হলেও ওই অর্থবছরে শেষ পর্যন্ত দেয়া হয় ৫৪১ কোটি টাকা। ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে মূলধন ঘাটতি পূরণের জন্য বরাদ্দ রাখা হয় ৪২০ কোটি টাকা। কিন্তু সরকার ওইবার খরচ করে প্রায় ১২ গুণ বেশি, ৫ হাজার কোটি টাকা। আর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও শেষ পর্যন্ত খরচ হয় ৫ হাজার ৬৮ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এ খাতে ৫ হাজার কোটি টাকা দেয়া হয়। তবে ওই অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা করা হয়। ২০১৬-১৭ এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছর দেয়া হয় ২ হাজার কোটি টাকা করে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App