‘বন্দুকযুদ্ধে’ একরাম হত্যা: অডিও খতিয়ে দেখছে র্যাব
কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১ জুন ২০১৮, ০৯:৪৮ পিএম
সংবাদ সম্মেলনে একরামুলের স্ত্রী
কথিত বন্দুকযুদ্ধে কক্সবাজারের টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর একরামুল হক নিহতের ঘটনা নিয়ে ছড়ানো অডিও রেকর্ডটি খতিয়ে দেখার কথা জানিয়েছে র্যাব।
সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে তোলপাড় করা এই রেকর্ডটি একরাম হত্যায় র্যাবের বর্ণনাকে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
অবশ্য একরামের বিরুদ্ধে কোনো মাদকের মামলা না থাকা আর তার করুণ আর্থিক অবস্থা আগেই একরামের মাদক চক্রে জড়িত থাকার দাবিকে আগেই প্রশ্নের মুখে ফেলেছিল।
এর মধ্যে বৃহস্পতিবার কক্সবাজার প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে একরামের স্ত্রী আয়শা আক্তার এই ঘটনার যে বর্ণনা দিয়েছেন তাতে সমালোচনায় বিদ্ধ হতে হচ্ছে র্যাবকে।
আয়েশা জানান, তার স্বামী নিহত হওয়ার আগে তার মোবাইলে বেশ কয়েকবার কল করেছিলেন। আর তাকে যখন গুলি করে হত্যা করা হয় তখনও কল কাটা হয়নি। ফলে তিনি পুরো ঘটনাটি শুনেছেন। আর এই কলটি তার মোবাইল ফোনে রেকর্ড হয়ে আছে।
মোট চারটি কলের রেকর্ড সাংবাদিকদের দিয়েছেন যা সব মিলিয়ে ১৪ মিনিটের বেশি। এর মধ্যে ট্রিগার টেনে গুলি করা, ‘কুত্তার বাচ্চা’, ‘শুয়রের বাচ্চা’ বলে গালিগালাজ, গাড়ির সাইরেনের শব্দ আর চিৎকার চেচামেচির সব শব্দই আছে।
একরামের স্ত্রীর দাবি, তার স্বামীকে গুলি করে হত্যার সময়কার অডিও এসব। তিনি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে এর বিচার চেয়েছেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালও সাংবাদিকদেরকে আশ্বাস দিয়েছেন, এই ঘটনা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবেন তারা।
একরামের বন্দুকযুদ্ধে নিহতের দাবি করেছিল র্যাব-৭। এই অডিওর বিষয়ে জানতে বাহিনীটির কোম্পানি কমান্ডার মেজর রুহুল আমিনকে কল দেয়া হলে তিনি, ‘বিজি রাইট রাও, সেন্ড ম্যাসেজ প্লিজ’ লিখে ম্যাসেজ পাঠান।
পাল্টা ম্যাসেজে তাকে বিষয় জানালে আর কোনো রিপ্লাই দেননি।
এরপর র্যাব-৭ এর অপারেশন অফিসারকে একাধিকবার কল করা হলে তিনি ফোন কেটে দেন।
পরে বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করা হয় র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘একটি অডিও প্রকাশিত হয়েছে। অডিওটা শুনেছি, এখন সেটা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পরে বিস্তারিত বলতে পারব।’
৪ মে থেকে মাদকের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান শুরু করে র্যাব। পরে অভিযানে যোগ দেয় পুলিশ। অভিযানে ১৩ হাজারেরও বেশি সন্দেহভাজন মাদক কারবারি গ্রেপ্তারের পাশাপাশি নিহত হয়েছেন ১২০ জনেরও বেশি।
বন্দুকযুদ্ধে নিহতের প্রতিটি ঘটনায় র্যাব ও পুলিশ একই রকম বর্ণনা দিচ্ছে। সন্দেহভাজনকে ধরতে গেলে তিনি বা তার সহযোগীরা গুলি করছে অথবা সন্দেহভাজনকে নিয়ে অভিযানে গেলে তার সহযোগীরা গুলি করছে আর পাল্টা গুলিতে নিহত হয়েছেন সন্দেহভাজন।
এই বর্ণনা এবারই প্রথম নয়। ২০০৪ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে র্যাব গঠনের পর ব্যাপকভাবে ক্রসফায়ারর শুরু হওয়ার পর থেকেই একই রকমের বর্ণনা এসেছে। যদিও এসব বর্ণনা শুরু থেকেই প্রশ্নের মুখে পড়েছিল।
এর মধ্যে কথিত বন্দুকযুদ্ধে একরামের নিহতের পর তার জানা যায় বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতি, তার পরিবার ও এলাকাবাসীর বক্তব্যর পর এবার অডিও ক্লিপ ফাঁস হওয়ার পর শুরু হয়েছে তীব্র সমালোচনা।
ফেসবুকে বানী ইয়াসমিন হাসি নামে একজন সাংবাদিক লিখেছেন, 'একরাম কাউন্সিলর সাথে উনার স্ত্রী এবং মেয়ের ১৪ মিনিট ২২ সেকেন্ডের কথোপকথনের অডিও ক্লিপ শুনলাম। তারপর থেকেই বুকের ভেতর খুউব অস্থির লাগছে।’
‘এই কান্নার চরম মূল্য দিতে হবে আজ না হয় কাল। আসলে কোনকিছুই আনপেইড থাকে না।’
‘ফোনের লাইনে রেখে একরামকে গুলি করা হলো। বউ বাচ্চাকে সেই গুলির আওয়াজ শোনানো হলো।… বিনা অপরাধে যদি একরামকে খুন করা জায়েজ হয়। তাহলে এই ঠান্ডা মাথার খুনিগুলো কেন পার পেয়ে যাবে?’
এস টি হোসাইন লিখেছেন, ‘একরাম হত্যা..! ১৪ মিনিট ২২ সেকেন্ডের একটি অডিও রেকর্ডে থমকে গেছে মানবতা!’
রশিদ আল রুহানী লিখেছেন, 'একরামকে এভাবেই হত্যা করা হয়..! বুক কাপঁছে আমার। একরাম হত্যা নিয়ে নাটকের এখনও দৃশ্য শেষ হয়নি, তবে বাকি দৃশ্য কেউ দেখতে পাবে না। এ হত্যার বিচার চাই।’
অডিওতে যা আছে
ফোনে কথা চলছে...
পুরুষ কণ্ঠ: আম্মু! অপরপ্রান্ত থেকে, জে..।
পুরুষ কণ্ঠ: তোমার আম্মু কোথায়?
অপরপ্রান্ত থেকে: আছে।
পুরষ কণ্ঠ: মেজর সাহেবে ডাকছিল। অস্পষ্ট কথা......। তোমার আম্মুকে বলিও।
অপরপ্রান্ত থেকে: আসতে দেরি হবে যে?...এরপর ফোনের লাইন কেটে যায়।
আবার ফোন রিং হয়-
মেয়ের কণ্ঠ: হ্যালো আব্বু, তুমি কেথায়?
পুরুষ কণ্ঠ: আমি টিএনও অফিসে যাচ্ছি তো, আমি চলে আসব আম্মু।
মেয়ের কণ্ঠ: কতক্ষণ লাগবে?
পুরুষ কণ্ঠ: বেশিক্ষণ লাগবে না। আমি চলে আসব ইনশাল্লাহ। ঠিক আছে? রাখলাম...। এরপর ফোনের লাইন কাটার শব্দ।
আবার ফোন....
মেয়ে: হ্যালো আব্বু! জি আম্মু। আম্মু আমি হ্নীলা যাচ্ছি। মেয়ে: কেন?
পুরষ কণ্ঠ: জরুরি কাজে যাচ্ছি।......মেয়ে আবার জিজ্ঞেস করে কেন?
পুরুষ কণ্ঠ: যাচ্ছি আম্মু.....(কান্নার স্বরে কথা)।
মেয়ে: যাচ্ছ, তুমি কান্না করতেছ যে...?
এরপর মেয়ের থেকে ফোন নিয়ে...নারীর কণ্ঠ: হ্যালো... হ্যালো...লাইন কেটে যায়।
এরপর আবার ফোন
নারী কণ্ঠ: ফোন রিং হচ্ছে আর কথা বলছে... আল্লাহ একবার মোবাইলটা দে, আল্লাহ একবার মোবাইল দিয়া কথা কইতে দে...আল্লাহ। ফোন রিসিভ হওয়ার পর..হ্যালো কে (নারী কণ্ঠ)? হ্যালো কে? ওপাশ থেকে অনুচ্চ স্বরে কথা বার্তা...
হ্যালো আমি কমিশনারের সাথে কথা বলতে চাচ্ছি। হ্যালো কে ওইটা...ফোন রিসিভ করছে ওইটা কে...অপরপাশ থেকে অনুচ্চ স্বরে কথা। আমি ওনার মিসেস বলতেছি।
অপর পাশ থেকে আওয়াজ আসছে...এটা বলছ....জ্বি। জড়িত, না?...জ্বি...অনুচ্চ কথা...ট্রিগার টানার শব্দ....গুলির আওয়াজ...ও করে চিৎকারের শব্দ...গোঙানির আওয়াজ.....আবার গুলির শব্দ।
এসময় ফোনের এপাশ থেকে ও আল্লাহ বলে চিৎকার করে ওঠেন নারী। কান্না করে চলছেন মা মেয়ে...আমার জামাই কিছু করে নাই। আমরা বিনাদোষী। আমার হাজব্যান্ড কিছু করে নাই। ফোনের অপর পাশ থেকে অস্পষ্ট কথা বার্তা।....শুয়োরের বাচ্চা বলে গালাগালি...বাঁশি ফুকার শব্দ...ওই কুত্তার বাচ্চা ধর...ওই ধর ওই ধর...(এসব কিছুই হয় গুলি করার পর। যেন আসামি পালাচ্ছে আর র্যাব গুলি করল। অথচ গুলি করা হয় আগে। পরে ধর ধর।)
এপাশে নারী কান্না করে বলে চলছেন...আপনারা কোথায়...আমার জামাই কিছু করে নাই...।
অডিও রেকর্ডের বাকি আওয়াজে সাইরেনের শব্দ আর অস্পষ্ট এবং অনুল্লেখযোগ্য নানা কথাবার্তা আছে।