×

জাতীয়

ব্যবসায়ী নেতাদের কদর বেড়েছে আওয়ামী লীগে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ মে ২০১৮, ০৩:২৬ পিএম

ব্যবসায়ী নেতাদের কদর বেড়েছে আওয়ামী লীগে
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে কদর বাড়ছে ব্যবসায়ী নেতাদের। ছাত্র রাজনীতি বা মাঠের রাজনীতিতে অভিজ্ঞতা না থাকলেও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ভিড়ছেন দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা। আসীন হচ্ছেন দলীয় পদে। মনোনয়ন পাচ্ছেন জাতীয় সংসদ বা স্থানীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে। তাদের অনেকেই এমপি, মন্ত্রী, মেয়র হয়েছেন। মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা পদে দায়িত্ব পালন করছেন কেউ কেউ। নিজের আগ্রহেই নৌকায় উঠছেন এমন ব্যবসায়ীর সংখ্যাও কম নয়। অনেক সময় দলের প্রয়োজনে হাইকমান্ড থেকে ডেকেও দলীয় মনোনয়ন দেয়া হচ্ছে তারকা ব্যবসায়ীদের। অবশ্য এ ক্ষেত্রে নিজ নিজ অঙ্গনে যাদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতি রয়েছে, তারাই এগিয়ে রয়েছেন। ২০১৫ সালের এপ্রিলে অনুষ্ঠিত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) নির্বাচনে মেয়র পদে আনিসুল হককে (বর্তমানে প্রয়াত) অনেকটা আকস্মিকভাবেই দলীয় মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। দলটির সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বড় চমকই ছিল এ মনোনয়ন। আনিসুল হক ছিলেন দেশের একজন প্রথিতযশা ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ ও এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি ছিলেন তিনি। আনিসুল হক দেশের শীর্ষ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান মোহাম্মাদিয়া গ্রæপের চেয়ারম্যান ছিলেন। সার্ক চেম্বারের প্রেসিডেন্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালনে সফল ছিলেন ব্যবসায়ী এই নেতা। এর আগে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তিনি সক্রিয় ছিলেন না। গত বছরের ৩০ নভেম্বর লন্ডনের একটি হাসপাতালে মারা যান আনিসুল হক। আসনটি শূন্য ঘোষণা করে চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি ডিএনসিসিতে মেয়র পদে উপনির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে ইসি। এরপর স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সভা ডেকে ঢাকা উত্তরে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেয়া হয় আরেক ব্যবসায়ী নেতা আতিকুল ইসলামকে। তৈরি পোশাক মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ছিলেন তিনি। আনিসুল হকের মতো তারও মাঠের রাজনীতিতে ছিল না কোনো অভিজ্ঞতা। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এটাও চমক ছিল বলে জানান দলটির নেতারা। অথচ ঢাকা উত্তর সিটির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অনেক পোড় খাওয়া ও পরীক্ষিত নেতাও দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন। পরবর্তী সময়ে একটি রিটের ফলে ওই নির্বাচনের ওপর ৬ মাসের স্থগিতাদেশ দেয় উচ্চ আদালত। ফলে ওই নির্বাচন আর অনুষ্ঠিত হয়নি। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন আরেক ব্যবসায়ী নেতা হক গ্রæপের কর্ণধার আদম তমিজী হক। বর্তমানে তিনিও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছেন। অংশ নিচ্ছেন দলের প্রতিটি কর্মসূচিতে। ব্যবসায়ীদের আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আসার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে দলটির সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক ভোরের কাগজকে বলেন, যারা ব্যবসা বাণিজ্য করে অঢেল টাকা পয়সার মালিক হয়েছেন, তারা তারকা ব্যবসায়ী বনে গেছেন। এখন তারা সামাজিক মর্যাদার জন্য রাজনীতিতে আসছেন। বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাÐে যুক্ত হচ্ছেন। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যারা আসছেন, পারিবারিকভাবেই তারা আমাদের সঙ্গে যুক্ত। তবে রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের আসা কোনো দলের জন্য ভালো কিছু বয়ে নিয়ে আসবে না। বরং পেশাজীবীদের বেশি বেশি করে রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়া উচিত। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় দেখা যায় বিজিএমইএর আরেক সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদীকে। গত ৩ মার্চ খুলনায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে বক্তব্য রাখেন তিনি। আগামী জাতীয় নির্বাচনে খুলনার সবকটি আসনে নৌকার বিজয়ে নিজের ভ‚মিকা রাখার কথা ব্যক্ত করে এ ক্ষেত্রে সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাসও দেন সালাম মুর্শেদী। গুঞ্জন রয়েছে, আগামী জাতীয় নির্বাচনে খুলনার যে কোনো একটি আসন থেকে তাকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেয়া হতে পারে। একজন তারকা ফুটবলার হিসেবেও খ্যাতি রয়েছে তার। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আগে থেকেই সক্রিয় আছেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি বেক্সিমকো গ্রুপের কর্ণধার সালমান এফ রহমান। ১৯৯৪ থেকে ৯৬ মেয়াদে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ২০০১ সালে ঢাকা-১ (দোহার-নবাবগঞ্জ) আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নির্বাচন করে তৎকালীন বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার কাছে হেরে যান সালমান। বর্তমানে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছেন এফবিসিসিআইয়ের আরেক সাবেক সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ। ২০১২ থেকে ২০১৫ মেয়াদে ব্যবসায়ীদের এই শীর্ষ সংগঠনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি। কাজী আকরাম বর্তমানে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য। স্ট্যান্ডার্ন্ড ব্যাংকের চেয়ারম্যান তিনি। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় রয়েছেন হা-মীম গ্রুপের চেয়ারম্যান এ কে আজাদ। ২০১০-২০১২ মেয়াদে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এ কে আজাদ বর্তমানে ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতিও। এ ছাড়াও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সহসভাপতি এস এ মান্নান কচি। তিনি বর্তমানে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। ঢাকা দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ। বাংলাদেশের স্বনামধন্য ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান গাজী গ্রুপের কর্ণধার গাজী গোলাম দস্তগীর গাজী বর্তমানে ক্ষমতাসীন দলটির সংসদ সদস্য। এ ছাড়াও দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, সড়ক পরিবহন মালিক সমিতিসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা বর্তমানে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছেন। তাদের কেউ কেউ ব্যবসায়ী থেকে রাজনীতিক বনেছেন। কেউবা রাজনীতি করতে করতে বড় ব্যবসার মালিক হয়েছেন, আসীন হয়েছেন ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতৃত্বেও। এ ছাড়া, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে আরো বেশ কয়েকজন শীর্ষ ব্যবসায়ী আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে ভোটের লড়াইয়ে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের আসাটাকে কী চোখে দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা? জানতে চাইলে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার ভোরের কাগজকে বলেন, ব্যবসায়ীদের রাজনীতিতে আসার সংস্কৃতি ৩০ বছর ধরে চলে আসছে। ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে আমরা দেখেছি বিএনপিতে যোগ দিয়ে শীর্ষ ব্যবসায়ী, সাবেক আমলা ও সাবেক সেনা কর্মকর্তারা নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। ৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগও তাই-ই করেছে। তবে এ ক্ষেত্রে বিএনপিই বেশি লাভবান হয়েছে। ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে আসায় রাজনীতি খুবই ব্যয়বহুল হয়ে যাচ্ছে। মাঠ থেকে উঠে আসা রাজনীতিকরা ভোটের লড়াইয়ে অর্থের দিক দিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পেরে উঠছেন না। আর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখন যে প্রতিযোগিতা, তাতে সবার মধ্যে বিজয়ী হয়ে আসার প্রবণতাটা সবচেয়ে বেশি। এ ক্ষেত্রে যে প্রার্থীর যত বেশি টাকা আছে, তার বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি। ফলে রাজনৈতিক দলগুলো ব্যবসায়ীদের নিজ দলে টানছে, মনোনয়নও দিচ্ছে। রাজনীতিতে অতিমাত্রায় ব্যবসায়ীদের আসায় সুশীল সমাজ অনেকটা দায়ী মন্তব্য করে এই বিশ্লেষক আরো বলেন, আমাদের দেশের রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণ বেড়ে যাওয়ার পেছনে রাজনৈতিক দলগুলো যতটা না দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী সুশীল সমাজের প্রভাবশালী একটি অংশ। তারা এসব বিষয়ে সোচ্চার না হয়ে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের দ্বারা একটি অনির্বাচিত সরকার গঠনের বিষয়ে বেশি তৎপর। অথচ তারা যদি ব্যবসায়ী, আমলা ও সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের রাজনীতিতে না আসার বিষয়ে আলোচনা করতেন, তাহলে এই তৎপরতা অনেকটা কমে যেত।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App