চট্টগ্রামে ৩০টি পাহাড়ে চরম ঝুঁকিতে পাঁচ হাজার পরিবার
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২২ মে ২০১৮, ১১:৩৯ এএম
চট্টগ্রামের ৩০টি পাহাড়ে কমপক্ষে পাঁচ হাজার পরিবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন। যে কোনো সময় ঝড়বৃষ্টি বা অন্য যে কোনো কারণে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে এ ক্ষেত্রে। এর আগে বিভিন্ন সময়ে পাহাড় ধসের ঘটনায় হতাহতের ঘটনা রোধে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নানাবিধ উদ্যোগ নেয়া হলেও কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস। সম্প্রতি পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি চিহ্নিত ঝুঁকিপূর্ণ এ ৩০টি পাহাড়ের মধ্যে নগরীর মধ্যে পড়া ১১টির বেশি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে বসবাস করছে ৬৬৬টি পরিবার।
এর মধ্যে লালখান বাজার এলাকায় মতিঝর্ণা ও বাটালি হিল পাহাড়ে ৩২০টি, এ কে খানের মালিকানাধীন পাহাড়ে ১৮৬টি, ইস্পাহানী পাহাড়ের দক্ষিণ পাশে ৫টি, লেকসিটি এলাকায় ১২টি, কৈবল্যধাম বিশ^কলোনি এলাকায় ২৭টি, আকবর শাহ আবাসিক এলাকার পাহাড়ে ২২টি, সিটি করপোরেশনের পাহাড়ে ১১টি, ফয়স লেক আবাসিক এলাকার কাছের পাহাড়ে ৯টি, ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট একাডেমির উত্তরে মীর মোহাম্মদ হাসানের মালিকানাধীন পাহাড়ে ৩৮টি, নাসিরাবাদ শিল্প এলাকা সংলগ্ন পাহাড়ে ৩টি ও জালালাবাদ হাউজিং সোসাইটি সংলগ্ন পাহাড়ে ৩৩টি পরিবার বসবাস করছে। তবে পাহাড়ে বসবাসকারী পরিবারের প্রকৃত সংখ্যা এই পরিসংখ্যানের চেয়ে অনেক বেশি।
এদিকে গতকাল রবিবার সকালে নগরীর আকবর শাহ থানার রেলওয়ে পাহাড়ে ঝুঁকিপ‚র্ণ বসতি উচ্ছেদে অভিযান চালায় জেলা প্রশাসন। এ সময় ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ১০০ বসতি ও স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। উচ্ছেদ অভিযানে থাকা জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার (ভ‚মি) শেখ জোবায়ের আহমেদ বলেন, প্রায় ১০০ স্থাপনা উচ্ছেদ করেছি। টানা বৃষ্টি হলে পাহাড় ধসে ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা আছে যেসব স্থাপনাই সেখান থেকে বাসিন্দাদের সরিয়ে দিতে এ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। অভিযানে পাহাড়ের নিজে ঝুঁকিপূর্ণভাবে গড়ে তোলা বাসার চালা, টিন এবং ত্রিপল কেটে দেয়া হয়। বৈদ্যুতিক মিটারের তার কেটে সেগুলো অকেজো করে দেয়া হয়।
চট্টগ্রামে প্রতিবার বর্ষা মৌসুম এলে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে তোলা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ এবং অবৈধ এসব বসত-বাড়িতে দেয়া বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু তারপর আবার পুরনো অবস্থায় ফিরে যায়। স্থায়ী কোনো সমাধান হয়নি বা লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। এমন অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন দেখা দেয়, কয়েকটি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার মধ্যেই কি প্রশাসনের কার্যক্রম সীমিত? যারা পাহাড় দখল করে বা পাহাড় কেটে অবৈধ বসতি নির্মাণ করে ফায়দা লুটছে এবং নি¤œআয়ের মানুষদের ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা
নিচ্ছে না প্রশাসন? এমন প্রশ্ন সচেতন মহলের। বিভিন্ন সরকারি সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা ও রাজনৈতিক চাপের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি সরিয়ে নেয়া ও পুনর্বাসনে সফলতা আসছে না। চট্টগ্রামে গত ১০ বছরে নগরী ও তার আশপাশের এলাকায় ভয়াবহ পাহাড় ও দেয়াল ধসের ঘটনায় মারা গেছেন ২৫০ জনের অধিক।
পরিবেশবিদ ও সচেতন মহলের অভিযোগ, তথাকথিত প্রবাবশালী মহল যারা, অবৈধ বসতি নির্মাণ করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়া পর্যন্ত পাহাড় ধসে প্রাণহানি রোধ করা সম্ভব নয়। উচ্ছেদে গেলেই ‘ওপরমহল’ থেকে শুরু হয় তদবির। ফলে প্রশাসনের ইচ্ছা থাকা সত্তে¡ও অনেক অভিযান নিষ্ফল হয়। অভিযোগ রয়েছে, রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে পাহাড়ের পাদদেশে অবৈধভাবে ঘরবাড়ি ও বস্তি তৈরি করে এসব কম টাকায় ভাড়া দেয় প্রভাবশালীরা। প্রশাসন বলছে, সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে পাহাড় মালিকদের উদাসীনতা, বিভিন্ন সরকারি সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা ও রাজনৈতিক চাপের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি সরিয়ে নেয়া ও পুনর্বাসনে সফলতা আসছে না। পাহাড় ধসের প্রাণহানির ঘটনা এড়াতে গঠিত শক্তিশালী পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সিদ্ধান্ত কার্যত কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। বড় ধরনের দুর্ঘটনার পর কিছুদিন এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে তোড়জোড় দেখা গেলেও পরবর্তী সময়ে তা ফাইল চাপা পড়ে যায়। এতে পাহাড় ধসে প্রাণহানির ঘটনা এড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। ২০০৭ সালে পাহাড় ধসে ১২৯ জনের প্রাণহানির ঘটনার পর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে একটি কমিটি ২৮টি কারণ নির্ধারণ করে ৩৬টি সুপারিশ প্রণয়ন করলেও তা আজো বাস্তবায়ন হয়নি।
চট্টগ্রামে সরকারি ছয় সংস্থার মালিকানাধীন বেশ কয়েকটি পাহাড় আছে। রেলওয়ে, চট্টগ্রাম ওয়াসা, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, সিডিএ, সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের মালিকানাধীন এসব পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে গড়ে উঠেছে অবৈধ স্থাপনা। অবৈধভাবে দখলে রেখে সংঘবদ্ধ কয়েকটি চক্র এসব পাহাড় থেকে ভাড়ার নামে প্রতি মাসে আয়ও করছে। কিন্তু এসব পাহাড়ের মালিকরাই অবৈধ স্থাপনা নিয়ে উদাসীন। তত্ত¡াবধানকারী সরকারি ছয় সংস্থাই অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে নীরব ভ‚মিকা পালন করছে বলে অভিযোগ আছে। সরকারি সংস্থাগুলোর নীরবতার পরিপ্রেক্ষিতে ছয় সংস্থাকে নিজস্ব ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে পাহাড়গুলো থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে চিঠি দেয় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন।
বিভিন্ন সময়ে চিহ্নিত ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলোর মধ্যে রয়েছে, বেসরকারি মালিকানাধীন এ কে খান এন্ড কোম্পানির পাহাড়, ইস্পাহানি কর্তৃপক্ষের নাসিরাবাদ প্রোপার্টিজের পাহাড় এবং ইস্পাহানি পাহাড়ের পার্শ্ববর্তী হারুন খানের মালিকানাধীন পাহাড়ের পশ্চিমাংশ, ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের উত্তর পাশের মীর মোহাম্মাদ হাসানের মালিকানাধীন পাহাড়, লালখান বাজার, চান্দমারী রোড সংলগ্ন মুছা বিন আজাহার, জামেয়াতুল উলুম ইসলামী মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের পাহাড়, চট্টেশ^রী রোডে অবস্থিত জেমস ফিনলের (বর্তমানে জে এফ বাংলাদেশ লি.) মালিকানাধীন পাহাড় এবং সিডিএ এভিনিউ রোডের পাশে সৈয়দ জিয়াদ হোসেনের মালিকানাধীন বেøাসোম গার্ডেনের পাহাড়। এ ছাড়া সরকারি পাহাড়গুলোর মধ্যে রয়েছে গণপূর্ত অধিদপ্তরের মালিকানাধীন বাটালি হিলের পাহাড়, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন বাটালি হিল, টাইগার হিল, লেকসিটি আবাসিক এলাকার পাহাড় ও ভিআইপি হিল, চট্টগ্রাম ওয়াসার মতিঝর্ণা এলাকার পাহাড়। এ ছাড়া সিআরবি এলাকায় রেলওয়ের মলিকানাধীন বেশ কয়েকটি পাহাড় রয়েছে।
গত ২২ এপ্রিল চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে আয়োজিত এক কর্মশালায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেছিলেন, পাহাড় দখলকারীরা যতই প্রভাবশালী, যত বড় নেতাই হোক ও যতই শক্তিশালী হোক কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। পাহাড়ের পাদদেশ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের উচ্ছেদ করার ব্যাপারে কারো হস্তক্ষেপ সহ্য করা হবে না। জেলা প্রশাসন যাতে এ ব্যাপারে কোনো নেতা বা প্রভাবশালীকে তোয়াক্কা না করে তাদের কাজ সঠিকভাবে করেন।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস ভোরের কাগজকে গতকাল বলেন, ‘পাহাড়ের মালিক স্ব স্ব উদ্যোগে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত অনেক আগের। পাহাড়ের পাদদেশে অবৈধভাবে বসবাসকারীদের গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি সংযোগ না দেয়ারও সিদ্ধান্ত বহাল থাকলেও একটিও বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার জবাবদিহিতা নেই। সিদ্ধান্ত অমান্যকারী কোনো সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতাও জেলা প্রশাসনের নেই। কিন্তু সব ক্ষেত্রে দায়-দায়িত্ব ও জবাবদিহিতা রয়েছে জেলা প্রশাসনের। সেবামূলক সংস্থাগুলো যদি অসহযোগিতা করে তাহলে জেলা প্রশাসনের একার পক্ষে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস সরানো সম্ভব নয়। কিন্তু উদ্যোগ বা পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে প্রশাসন কোনো ত্রæটি রাখছে না। আমাদের কাজ আমরা করছি।’
এদিকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সামসুদ্দোহা রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে প্রভাবশালী মহল পাহাড় কেটে অবৈধ বসতি স্থাপন করছে বলে স্বীকার করলেও ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস এড়াতে বা বিভিন্ন সেবা সংযোগের ক্ষেত্রে নিজেদের দায় এড়িয়েছেন। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, ‘বিভিন্ন সেবামূলক সংযোগ দেয় দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো। এ ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের কিছু করার থাকে না। ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস এড়াতে জেলা প্রশাসন নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে। আমরা প্রশাসনকে নানাভাবে সহযোগিতা করি।’ তিনি ‘বলেন, পাহাড় ধসে প্রাণহানি রোধে সব সংস্থাকে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে। সম্মিলিতভাবে দায়বদ্ধতা-জবাবদিহিতার মধ্যে পরিকল্পিতভাবে কাজ করতে না পারলে কারো একার পক্ষে এটি সম্ভব নয়।’