×

মুক্তচিন্তা

চলার পথে চাই নারীদের জন্য নিরাপত্তা

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ মে ২০১৮, ০৭:৪২ পিএম

দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হচ্ছে তা খুঁজে বের করা দরকার। রাস্তায় নারীদের নিরাপদ চলাচলের জন্য সরকার কর্তৃক পরিবহন আইনে নারীদের জন্য বিশেষ ধারা প্রণয়ন করা যেতে পারে, সব রুটে পৃথক নারী পরিবহন চালু করতে হবে এবং তা যথাযথ কর্তৃপক্ষের নজরদারিতে রাখতে হবে। ব্যক্তিমালিকানাধীন গণপরিবহনে নারীরা সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করতে সরেজমিন তদারকি করতে হবে।

জননী, কন্যা, অর্ধাঙ্গিনী যে উপমায় তাকে ডাকা হোক, তার পরিচয় একটাই তিনি একজন নারী। যুগের সঙ্গে নারী জাগরণের উন্নতি হলেও অনেক ক্ষেত্রেই উন্নতি হয়নি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মন মানসিকতার। এখনো পদে পদে নারীকে পুরুষ কর্তৃক হেয় হতে হয় জীবনের নানা বাঁকে। নেপোলিয়ন বুনোপোর্ট বলেছিলেন ‘আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও আমি একটি শিক্ষিত জাতি দিব’। শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জন করলেই কি তাকে শিক্ষিত জাতি বলা যায়? মানুষ শিক্ষিত হয় মন মানসিকতার উন্নয়নের সঙ্গে মূল্যবোধ অর্জনের মাধ্যমে।

বিংশ শতাব্দী চলছে, এই সময়টিতে যেমন দ্রুত উন্নয়ন হচ্ছে নারীদের, তেমনি নারী হয়রানিও বাড়ছে। নারীদের নিরাপদ চলাচলের জন্য সারা বিশ্বের অনেক দেশে মহিলাদের জন্য পৃথক পরিবহন সেবা চালু রয়েছে। ইউনাইটেড কিংডম ১৮৭৪ সাল, মেক্সিকো ও জাপান ২০০০ সাল, ব্রাজিল ও ইরান ২০০৬ সাল, মিসরে ২০০৭ সাল, থাইল্যান্ড ২০১৪ সাল থেকে নারীদের জন্য পৃথক পরিবহন ও একই পরিবহনে পৃথক সেবা চালু করে এ ছাড়া আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের দিল্লি, বম্বে, কলকাতা ও চেন্নাই শহরেও রয়েছে এ সেবা।

সারা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশের উন্নয়ন ঘটছে, বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশ হতে চলছে, সড়ক ও পরিবহনে এসেছে আধুনিকতার ছোঁয়া, ঢাকা শহরে চালু হতে যাচ্ছে মেট্রো রেল সেবা আরো কত কী। কিন্তু আমাদের পরিবহন ব্যবস্থায় নারীদের জন্য নেই তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা, নেই যানবাহনে চলাচলে নিরাপত্তা। বিআরটিসি প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী ‘ঢাকাসহ, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও সাভার থেকে আগত ঢাকাগামী মোট মহিলা বাস সংখ্যা ১৫টি। এ ছাড়া চট্টগ্রামে চালু রয়েছে আরো ২টি মহিলা বাস’ সার্ভিস। বিদ্যালয়, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও চাকরিজীবী নারীদের নিরাপদে আসা-যাওয়ার ২০১২ সালে প্রথম ৮টি বাস নিয়ে মহিলা বাস সেবা চালু করে, তবে তা অচিরেই বিলীন হয়ে যায়। এরপর আবার ২০১৪ সালে নতুন করে বাস ও রুট সংখ্যা বাড়ানো হয়। পরিতাপের বিষয় এই যে, অধিকাংশ মহিলা বাস সেবাই এখন বন্ধ আছে।

বিআরটিসির তথ্যানুযায়ী বর্তমানে মতিঝিল ডিপোর আওতায় ৪টি রুটে ৫টি মহিলা বাস সার্ভিস চালু আছে। সে অনুযায়ী খিলগাঁও তালতলা থেকে গুলিস্তান সকাল ৯টা ৫ মিনিটে ২টি, নতুন বাজার থেকে মতিঝিল সাড়ে ৮টায় ১টি, বনশ্রী থেকে মতিঝিল সকাল সাড়ে ৮টায় ১টি এবং নতুন বাজার থেকে গুলশান-২ হয়ে মতিঝিল আরো একটি বাস থাকার কথা রয়েছে। একইভাবে বাসগুলো যাত্রী নিয়ে আবার ফিরে আসার কথা। কিন্তু হতাশার বিষয় এই যে এই রুটে মহিলা বাস নামে কোনো বাস চলতে দেখা যায়নি। স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের একটি দল গত সপ্তাহে ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে মহিলা বাসের সন্ধান করে দেখে শুধু মিরপুর থেকে মতিঝিল এই রুটে সকাল ৮টায় ১টি এবং ৮টা ১০ মিনিটে ১টি মহিলা বাস চলাচল করে খিলগাঁও তালতলা হয়ে গুলিস্তান রুটে ১টি মহিলা বাস মাঝে মাঝে দেখা যায় কিন্তু ওই বাসে মহিলার বদলে পুরুষ যাত্রী চলাচল করে।

মহিলা বাস নেই তাতে কি অন্যান্য বাস তো আছেই! অপ্রিয় হলেও সত্য যে, ঢাকা শহরের বেশিরভাগ বাসে নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য বরাদ্দকৃত আসন সংখ্যা ৩ থেকে ৯টির মধ্যে সীমাবদ্ধ। অথচ একটি বাসে আসন থাকে ৩৬ থেকে ৫২টি। তিন ধরনের যাত্রীর জন্য মাত্র ৩ থেকে ৯টি আসন। তাহলে বাকি আসনগুলো কি শুধু এক ধরনের যাত্রীর জন্য? মাঝে মাঝে এই সংরক্ষিত আসনগুলোতে বসে থাকে পুরুষরা। আর এই সুযোগ নেয় গাড়ির হেলপাররা, তাদের কথা একটাই ‘মহিলা সিট খালি নেই, ওঠা যাইব না’। এত স্বল্পসংখ্যক আসন থাকা সত্ত্বেও নারীরা নিয়মিত চলাচল করছে তাদের কর্মস্থলে, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং সম্মুখীন হচ্ছে যৌন হয়রানি, অহেতুক গায়ে হাত দেয়া, গাড়ির স্টাফ কর্তৃক অপদস্থ হওয়ার মতো নানাবিধ সমস্যায়। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় যখন অফিস ছুটি হয় একে তো গাড়িতে আসন সীমিত তার ওপর চলন্ত বাসে ওঠার জন্য লড়াই চলে, এ লড়াইয়ে পুরুষরাই জয়ী হয়, নারীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে কখন ফাঁকা বাস আসবে। বেসরকারি সংস্থা একশন এইডের এক গবেষণায় দেখা যায় যে, পাবলিক স্পেসে বহুমাত্রিক হয়রানির শিকার হয় নারী এবং ৫০ শতাংশ নারী কোনোরকম প্রতিবাদ ছাড়াই মুখ বুঁজে নির্যাতন সহ্য করে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জরিপ অনুযায়ী গণপরিবহনে যাতায়াত করেন এমন ৯৪ ভাগ নারীই যৌন হয়রানির শিকার। গত ২৫ এপ্রিল ২০১৮ তারিখে দৈনিক প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী চলন্ত বাসে ছাত্রী হয়রানির দাবিতে তুরাগ পরিবহনের ৩৫ বাস আটকিয়ে উত্তরা ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ করে এবং একই প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয় যে, টাঙ্গাইলে চলন্ত বাসে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের পর হত্যা।

বাংলাদেশ দণ্ডবিধি আইনের ২৯৪ ধারায় বলা হয়েছে ‘যে ব্যক্তি, অন্যদের বিরক্তি সৃষ্টি করিয়া (ক) কোনো প্রকাশ্য স্থানে কোনো অশ্লীল কার্য করে অথবা (খ) কোনো প্রকাশ্য স্থানে বা সন্নিকটে কোনো অশ্লীল গান, গাঁথা সঙ্গীত বা পদাবলি গায়, আবৃত্তি করে বা উচ্চারণ করে; সেই ব্যক্তি যে কোনো বর্ণনায় কারাদণ্ডে যাহার মেয়াদ ৩ মাস পর্যন্ত হইতে পারে বা অর্থদণ্ডে বা উভয়দণ্ডে দণ্ডনীয় হবে’।

এ সব ঘটনা সৃষ্টির জন্য দায়ী সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি, নারী জাগরণ বলে আসলে সত্যিকারে কতটুকু সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হচ্ছে তা খুঁজে বের করা দরকার। রাস্তায় নারীদের নিরাপদ চলাচলের জন্য সরকার কর্তৃক পরিবহন আইনে নারীদের জন্য বিশেষ ধারা প্রণয়ন করা যেতে পারে, সব রুটে পৃথক নারী পরিবহন চালু করতে হবে এবং তা যথাযথ কর্তৃপক্ষের নজরদারিতে রাখতে হবে। ব্যক্তিমালিকানাধীন গণপরিবহনে নারীরা সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করতে সরেজমিন তদারকি করতে হবে।

ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার এবং মারজিয়াত রহমান : লেখকদ্বয় যথাক্রমে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষণা শিক্ষার্থী।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App