×

মুক্তচিন্তা

মহাকাশে বাংলাদেশ এ মর্যাদা জাতির

Icon

মুক্তচিন্তা কলাম লেখক

প্রকাশ: ১২ মে ২০১৮, ০৯:৫৭ পিএম

আমাদের দেশে ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে যাচ্ছে। সে টাকা উদ্ধার হচ্ছে না। দেশ থেকে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণও একেবারে কম নয়। অর্থ পাচার বন্ধেও কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই। এ সব দুর্নীতি দূর করতে পারলে বিজ্ঞান ও কারিগরি দক্ষতা বাড়ানোর কাজে অর্থ ব্যয় করতে সমস্যায় পড়তে হবে না। অবকাঠামো উন্নয়ন করতে হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের দিকেও মনোযোগ দিতে হবে।

চলতি হাওয়া

স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১-এর সফল উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে মহাকাশ অধিকারে বাংলাদেশ এক নতুন উচ্চতায় উপনীত হলো। শুক্রবার (১১ এপ্রিল) রাত ২টা ১৪ মিনিটে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে স্যাটেলাইটটি মহাকাশের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ করে বাংলাদেশ স্যাটেলাইটের অভিজাত ক্লাবে যুক্ত হলো বাংলাদেশ। এর আগে ৫৬টি দেশ স্যাটেলাইটের মালিক ছিল। বাংলাদেশ ৫৭তম দেশ হিসেবে স্যাটেলাইটের অধিকারী হলো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবাইকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন, ‘মহাকাশে আজ উড়ল বাংলাদেশের পতাকা। আজ থেকে আমরাও স্যাটেলাইট ক্লাবের গর্বিত সদস্য হলাম’।

এটা ঠিক যে, গুটিকয়েক বিদ্বেষপরায়ণ ও সংকীর্ণ স্বার্থ চিন্তার মানুষ ছাড়া বাংলাদেশের এই অর্জনে বাংলাদেশি নাগরিক মাত্রই আনন্দিত এবং উৎফুল্ল। আমাদের দেশে একশ্রেণির মানুষ আছেন যারা প্রাণ খুলে হাসতে পারেন না। মুক্ত মনে কারো প্রশংসা করতে পারেন না। তারা চেপে হাসেন, মেপে হাসেন। ক্যালকুলেটর কিংবা গজ ফিতা নিয়ে বসে যান লাভ-ক্ষতির হিসাব কষতে। এই ধরনের অতি সাবধানী ও হিসাবি মানুষরা বাংলাদেশের এই মহাকাশ অভিযান নিয়ে বাঁকা মন্তব্য করলেও বাকি সবাই এই বিজয়গর্বে বুক উঁচু করতে দ্বিধাবোধ করছেন না।

ঝুঁকি না নিলে বড় কিছু অর্জন করা যায় না। আবার সব বড় কাজেরই কিছু না কিছু ঝুঁকি থাকে। ‘সদা ভয়, সদা লাজ’ নিয়ে পৃথিবীর কোনো মহৎ কাজ হয়নি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঝুঁকি নিয়েছিলেন বলেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। আমরা পাকিস্তানের জিঞ্জির ভাঙতে সক্ষম হয়েছি। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাও ঝুঁকি নিতে পছন্দ করেন। দেশকে নিয়ে আছে তার আছে বিশাল স্বপ্ন। তার স্বপ্ন ‘দিন ভিক্ষা, তনু রক্ষা’ নয়। তিনি দেশকে এগিয়ে নিতে চান সমৃদ্ধির পথে। তবে আত্মমর্যাদা বিকিয়ে দিয়ে নয়। তিনি ঝুঁকি নিতে পারেন বলেই বাংলাদেশ আজ আর ভিক্ষুকের জাতি নয়। বাংলাদেশ এখন অনেকেরই মনোযোগ আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে। পদ্মা সেতু যে আজ বাস্তবে রূপ নিতে চলেছে তা তো শেখ হাসিনার সাহসী মনোভাবের কারণেই। ২ হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা খরচের হিসাবকে যারা সামনে এনে বিরূপতা প্রকাশ করছেন তারা জানেন না যে সব কিছু টাকার অঙ্কে বিচার করলে কোনো জাতি তার সম্মান ও মর্যাদাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে পারবে না। অপচয়, অপব্যয়, দুর্নীতি অবশ্যই সমর্থনযোগ্য নয়। তবে আমাদের দেশে সব ক্ষেত্রেই তো প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়ে প্রকৃত ব্যয় বেশি হয়। উন্নয়নকাজের দুর্নীতি কমাতে বা বন্ধ করতে পারি না বলে তো আর আমাদের দেশে উন্নয়নকাজ থেমে নেই।

একটি মর্যাদা ও আত্মপ্রত্যয়ের বিষয়টি সব সময় আলাদা গুরুত্ব দিয়েই দেখতে হয়। এটা ঠিক যে, এই স্যাটেলাইট নির্মাণ প্রতিক্রিয়ায় ফ্রান্সের নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমাদের দেশের বিজ্ঞানীরা যুক্ত থাকার সুযোগ পেলে বেশি ভালো হতো। তারা হাতে কলমে শিখতে পারতেন। ১৫ বছর পর যখন আবার নতুন স্যাটেলাইট নির্মাণ প্রয়োজন হবে তখন যাতে আমাদের বিদেশনির্ভর থাকতে না হয় সেটা এখন থেকেই নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে আগ্রহী ও উৎসাহী বিজ্ঞানীদের গবেষণা কাজে সহযোগিতার জন্য অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে।

আমাদের ১৮ জন তরুণ এখনই স্যাটেলাইট পরিচালনা করার দক্ষতা অর্জন করছেন। নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ফ্রান্সের থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেস এদের প্রশিক্ষিত করে তুলছে। এটা একটি বড় বিষয়। আমাদের দেশে ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে যাচ্ছে। সে টাকা উদ্ধার হচ্ছে না। দেশ থেকে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণও একেবারে কম নয়। অর্থ পাচার বন্ধেও কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই। এ সব দুর্নীতি দূর করতে পারলে বিজ্ঞান ও কারিগরি দক্ষতা বাড়ানোর কাজে অর্থ ব্যয় করতে সমস্যায় পড়তে হবে না। অবকাঠামো উন্নয়ন করতে হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের দিকেও মনোযোগ দিতে হবে। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে হলে গবেষণায় টাকা ঢালতেই হবে। কত বিনিয়োগ করে কত লাভ হবে, প্রাথমিকভাবে সে হিসাব করে বুক কাঁপানোর দরকার নেই। কৃষি গবেষণায় টাকা ব্যয় করে আমরা কি লাভবান হইনি? এই যে আজ খাদ্যের জন্য পরনির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি, সেটা তো আমাদের কৃষি বিজ্ঞানীদের লাগাতার প্রচেষ্টারই ফল।

স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ এর জন্য আমরা যে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয় করলাম, এর থেকে আমাদের কোনো আয় হবে না, বিষয়টি কিন্তু মোটেও তেমন নয়। এর মধ্য দিয়ে বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি গবেষণার সর্বোচ্চ ধাপে পৌঁছানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের। এই মহাকাশ যাত্রা একদিকে আমাদের দেশের মর্যাদা বাড়াবে, অন্যদিকে অর্থ আয়ের পথও খুলবে। আমাদের দেশে চালু স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বিদেশ থেকে স্যাটেলাইট ভাড়া নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। এ জন্য মোটা অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা গুনতে হচ্ছে। এখন দেশের স্যাটেলাইট চালু হওয়ায় তাদের ব্যয় সাশ্রয় হবে, আবার বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ও বন্ধ হবে। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের ৪০টি ট্রান্সপন্ডারের মধ্যে ২০টি ভাড়া দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের সুযোগ আছে। কেউ হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন, এ সব আয় দিয়ে ১৫ বছরের আয়ুষ্কালের এই স্যাটেলাইটের জন্য ব্যয় করা তিন হাজার কোটি টাকা কি উঠে আসবে? প্রত্যক্ষভাবে যদি উঠে নাও আসে তবে পরোক্ষভাবে অবশ্যই উঠে আসবে। এই স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্য দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবেলায় আগাম সতর্কতা অবলম্বনে সহায়ক হবে এবং তাতে জীবন ও সম্পদের ক্ষয়-ক্ষতি রোধ করা সম্ভব হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিরাট পরিবর্তন আসবে। দুর্গম অঞ্চলেও যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে। এই স্যাটেলাইট ব্যবহার করে আর কি কি সুবিধা আমরা পেতে পারি সে বিষয়গুলো বিশেষজ্ঞরা ভালো বলতে পারবেন। তবে এর ফলে আমাদের দেশের যে মর্যাদা বাড়বে তার অর্থমূল্য নির্ধারণ করা কঠিন।

আমরা রাজনৈতিকভাবে চরম বিভক্ত বলে সব কিছু দলীয় রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করে থাকি। আমরা নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করতেও কসুর করি না। এখন ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ সরকার। শেখ হাসিনা দেশের প্রধানমন্ত্রী। আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনার যারা প্রতিপক্ষ তারা মনেপ্রাণে চায় না কোনো কিছুতে এই সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়ুক। তাই সরকারের যে কোনো সাফল্যে তারা ঈর্ষান্বিত হয়ে বিভিন্ন বিতর্কিত ও অযৌক্তিক বিষয় সামনে এনে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চায়। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বৃহস্পতিবার রাতে কিছু কারিগরি ত্রুটির কারণে নির্ধারিত সময়ে উৎক্ষেপণ সম্ভব না হওয়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক বিরোধীদের কিছুটা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করতে দেখা গেছে। পরের দিন ঠিকই সফল উৎক্ষেপণ হয়েছে। স্যাটেলাইট কক্ষপথে অবস্থান নিয়ে সব মিলিয়ে মাসখানেক সময় লাগবে। এই সময়টা যেন আমরা সবাই ধৈর্য ধরি এবং নিজের পায়ে কুড়াল মারার মতো সমালোচনা থেকে বিরত থাকি।

বিভুরঞ্জন সরকার : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App