×

জাতীয়

পাহাড়ে আধিপত্যের লড়াই

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ মে ২০১৮, ১১:৩৬ এএম

পাহাড়ে আধিপত্যের লড়াই
পার্বত্য শান্তিচুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার কারণেই অশান্ত হয়ে উঠেছে পার্বত্য অঞ্চল। পাহাড়ে আধিপত্যের লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছে আঞ্চলিক দল ও গোষ্ঠীগুলো। বেড়েছে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার। ঝরছে রক্ত। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চাঁদাবাজি, অবৈধ মাদকের ব্যবসা এবং স্বার্থান্বেষী মহলের ইন্ধন। এমনই অভিমত স্থানীয় সুশীল সমাজের। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তিচুক্তির পর পাহাড়িদের দুটি অংশ এর পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নেয়। তখন থেকেই সশস্ত্র হানাহানি, অপহরণ ও চাঁদাবাজির কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে একটা যুদ্ধ যুদ্ধ পরিবেশ বিরাজ সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া বহিরাগত সন্ত্রাসীরাও পাহাড়ি ভ‚মি দখল, চাঁদাবাজি, মাদক ও অস্ত্র ব্যবসা, অপহরণ বাণিজ্য এবং এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ে। পাহাড়ে দল-উপদলীয় কোন্দলে বর্তমানে ৪টি সশস্ত্র গ্রæপ সক্রিয়। পাহাড়ের বিবদমান দুটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলই ৪ উপদলে বিভক্ত হয়ে সশস্ত্র তৎপরতায় লিপ্ত। মূলত এদের হানাহানিতেই আবারো অশান্ত হয়ে উঠেছে পাহাড়। সন্তু লারমার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে অস্ত্র সমপর্ণ করে। সেই সময় এর বিরোধিতা করে জন্ম নেয় পাহাড়ের আরেক আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। এর নেতৃত্ব দেন প্রসিত বিকাশ খীসা ও সঞ্জয় চাকমা। শান্তিচুক্তির শর্ত মোতাবেক পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ গঠিত হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদে চেয়ারম্যান পদে আসীন হন, যা দীর্ঘ ২০ বছর ধরে এখনো বহাল রয়েছে। সন্তু লারমার নেতৃত্বধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি শুরু থেকেই ইউপিডিএফের রাজনীতি ও মতাদর্শকে মানতে পারেনি। ফলে উভয় সংগঠনের মধ্যে প্রতিনিয়ত ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত লেগেই আছে। এতে প্রাণ হারান অসংখ্য মানুষ। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরূপা দেওয়ান বলেন, পার্বত্য শান্তিচুক্তির দীর্ঘসূত্রতার কারণে পাহাড়ে সংঘাত বাড়ছে। তিনি বলেন, যে ঘটনা ঘটেছে তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমরা এ ধরনের হত্যাকাÐ কোনোভাবেই সমর্থন করি না। তিনি বলেন, পার্বত্য শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে পাহাড়ের সংগঠনগুলোর মধ্যে অবিশ্বাস বাড়ছে। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন হলেই পাহাড়ের শান্তি ফিরে আসবেÑ এমন মন্তব্য করে এ ব্যাপারে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেন তিনি। বাঙালি সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও সাবেক ছাত্র নেতা জাহাঙ্গীর আলম মুন্না বলেন, আমরা কোনোভাবেই এই হানাহানি মেনে নিতে পারি না। আমরা সবাই শঙ্কিত এবং আতঙ্কিত। এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর বক্তব্য স্পষ্ট হওয়া উচিত। বাংলাদেশের এই অংশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা আমাদের সবারই দায়িত্ব। এই অংশ বিচ্ছিন্ন করার যে ষড়যন্ত্র চলছে তা বন্ধ হওয়া দরকার। যারা সুশীল সমাজ ও দেশপ্রেমিক আছেন, সবাইকে মুখ খুলতে হবে। তিনি বলেন, পার্বত্য অঞ্চলের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের জন্য আমরা প্রতিনিয়ত বলছি। সরকার এই অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এখনই দ্রæত পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি পার্বত্য অঞ্চলের সন্ত্রাসীদের দমনে র‌্যাবের ইউনিট স্থাপনের দাবি জানান। এদিকে সাবেক গেরিলা নেতা সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি জেএসএসের মুখপাত্র সজীব চাকমা বলেন, আমরা বারবার দাবি জানিয়ে আসছি, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন করতে হবে। সেটি যত বিলম্বিত হচ্ছে ততই পরিস্থিতি খারাপের দিকে এগুচ্ছে। এটা আমাদের কারো জন্যই মঙ্গলজনক কিছু নয়। তিনি বলেন, পাহাড়ের এসব কর্মকাÐ বন্ধ করতে অবিলম্বে পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। চুক্তি বাস্তবায়নই এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ। নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান কোয়ালিটি চাকমা বলেন, একজন নারী জনপ্রতিনিধি হয়ে বর্তমানে অত্যন্ত কঠিন সময় পার করছি। আমাদের অবস্থা এখন অত্যন্ত শোচনীয়। চেয়ারম্যানকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা পর এখন তিনিও আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন জানিয়ে কোয়ালিটি বলেন, আমরা আমাদের অবস্থান সম্পর্কে যদি বুঝেও না বুঝার ভান করি, তাহলে পৃথিবীর কোনো শক্তিই আমাদের বোঝাতে বা সঠিক পথে ফেরাতে পারবে না। রাঙ্গামাটি আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এডভোকেট মোখতার আহমেদ বলেন, আমাদের এক সহকর্মী আইনজীবী নিহত হওয়ার ঘটনায় গোটা আইজীবী সমাজ বিক্ষুব্ধ। তিনি বলেন, আমরা বরাবরই সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে এসেছি, পাহাড়ে যৌথ বাহিনীর চিরুনি অভিযানের মাধ্যমে অস্ত্র উদ্ধার করাসহ প্রতিটি হত্যাকাÐের সঙ্গে জড়িত সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। অন্যথায় পাহাড় শান্ত হবে না। তিনি বলেন, আগামী নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে হলে পাহাড় থেকে প্রত্যাহার করা সেনাক্যাম্পগুলো প্রতিস্থাপন করা এখন সময়ের দাবি। এটা শুধু আমরাই দাবি করছি না, এই দাবি পার্বত্য এলাকার সরকারি দলের নেতাদের পক্ষ থেকে বারবার উচ্চারণ করা হয়েছে। তারপরও সরকার কেন বুঝতে পারছে না তা আমাদের বোধগম্য নয়। রাঙ্গামাটি চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি বেলায়েত হোসেন ভ‚ঁইয়া বলেন, আমরা ব্যবসায়ীরাসহ আপামর রাঙ্গামাটিবাসী পাহাড়ের অবৈধ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার এবং অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের দাবি জানিয়ে আসছি। আমাদের দাবিগুলো আমলে নিয়ে যদি কাজ শুরু হতো, তাহলে আজকের দিনের নৃশংস পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হতো না। রাঙ্গামাটি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজি মূছা মাতব্বর বলেন, এ ধরনের সশস্ত্র তৎপরতার মুখে পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন কিভাবে সম্ভব? রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে বিগত কয়েক বছর ধরেই পাহাড় থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের দাবি জানিয়ে আসছে। যদি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হতো তাহলে আজকের দিনে এত প্রাণহানির দৃশ্য আমাদের দেখতে হতো না। এদিকে রাঙ্গামাটির পুলিশ সুপার আলমগীর কবির বলেন, শুক্রবার একদিনেই পাঁচটি হত্যাসহ গুলিবিদ্ধের ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় আইনানুগ পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, অবৈধ অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়া যায় সে বিষয়ে আমরা সকলের সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেব। পাহাড়ের সন্ত্রাস দমনে পুলিশের সক্ষমতাসংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে এসপি বলেন, পাহাড়ে কর্মরত পুলিশ সদস্যদের যুগোপযোগী করে গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। তিনি বলেন, সমতলের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে পাহাড়ের পুলিশ বাহিনীকে তৈরি করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় লজিস্ট্রিক সাপোর্ট দিতে হবে। তবেই এই ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাÐের বিপরীতে পুলিশ ত্বরিতভাবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App