×

ফিচার

ঋতুস্রাবে পুরনো কাপড় ব্যবহার বাড়ায় জরায়ু ক্যান্সারের আশঙ্কা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ এপ্রিল ২০১৮, ০৩:৩৫ পিএম

ঋতুস্রাবে পুরনো কাপড় ব্যবহার বাড়ায় জরায়ু ক্যান্সারের আশঙ্কা
ঋতুস্রাব বা মাসিক নিয়ে ভুল ধারণা ও চর্চা বাংলাদেশের নারীদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকে আরো জটিল করে তুলেছে। শতকরা ৩৬ জন কিশোরী প্রথম মাসিকের আগে এ সম্পর্কে জানে না। এ ছাড়া ৮৬ ভাগ নারী মাসিকের সময় স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার না করে পুরনো কাপড়, তুলো বা অন্যান্য উপকরণ ব্যবহার করেন। সচেতনতার অভাবে এ সময়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার দিকেও নজর দেয়া হয় না। ফলে জরায়ুমুখ ও প্রজনন অঙ্গে বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ দেখা দেয়। যার দীর্ঘমেয়াদি কুফল বয়ে বেড়াতে হয় সারা জীবন। তা ছাড়া অপরিষ্কার কাপড় ব্যবহারে মেয়েদের জরায়ু ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চন্দ্র মাস অনুয়ায়ী মেয়েদের জরায়ু যে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায় এবং প্রতি মাসে হরমোনের প্রভাবে মেয়েদের যোনিপথ দিয়ে যে রক্ত ও জরায়ু নিঃসৃত তরল পদার্থ বের হয়ে আসে তাকেই মাসিক বা ঋতুস্রাব বলে। এ সময় পুরনো কাপড় বা ন্যাকড়া ব্যবহার করা অনুচিত। এর ফলে নারী ও কিশোরীরা নানা ধরনের সংক্রমণের শিকার হতে পারে। আর সংক্রমণ দীর্ঘদিনের হলে প্রজনন অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যা থেকে দেখা দিতে পারে বন্ধ্যত্ব। এর ফলে সাদাস্রাব বা লিকোরিয়া নামের একটা রোগ হতে পারে, যা নারীর মনোবল ভেঙে দেয়, তাকে হতাশার দিকে ধাবিত করে। তাই পরিবার থেকে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। মাসিক সম্পর্কে স্কুল-কলেজে এ বিষয়ে বিস্তারিত ধারণা দিতে হবে। যাতে মেয়েরা শারীরিকভাবে সুস্থ থাকে। রিপ্রোডাকটিভ হেলথ সার্ভিসেস ট্রেনিং এন্ড এডুকেশন প্রোগ্রামের পরিচালক ডা. এলভিনা মুসতারী ভোরের কাগজকে বলেন, পিরিয়ডের সময় অপরিষ্কার পুরনো কাপড় ব্যবহার করলে জ্বর, তলপেটে ব্যথা ও মূত্রনালীতে সংক্রমণ হতে পারে। এ ছাড়া জরায়ুতে ইনফেকশন হতে পারে। ইনফেকশন দীর্ঘদিন থাকলে পরবর্তী সময়ে সেটি জরায়ুর ক্যান্সারে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। পুরনো, অপরিষ্কার কাপড় ব্যবহারে পিরিয়ডের সময় অতিরিক্ত রক্তপাতের সম্ভাবনাও থাকে। তিনি বলেন, দামের কারণে যারা স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করতে পারেন না তারা পুরনো কাপড় ব্যবহার করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য নেয়া কাপড়টি অবশ্যই পরিষ্কার হতে হবে। তারপর ব্যবহারের পর সেটি সাবান ও গরম পানি দিয়ে খুব ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে এবং কড়া রোদে শুকিয়ে নিতে হবে। এরপর ইস্ত্রি করে কাপড়টি জীবাণুমুক্ত করার ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়া কয়েকবার ব্যবহারের পর কাপড়টি ফেলে দিতে হবে। নইলে ইনফেকশনের আশঙ্কা থাকবে। পুরনো কাপড়ের সমস্যার কথা বলতে গিয়ে ডা. এলভিন মুসতারী বলেন, তিনবারের বেশি এক কাপড় ব্যবহার করা যাবে না। এ ছাড়া সেই কাপড় স্যাঁতসেঁতে জায়গায় শুকানো যাবে না। এতে করে জীবাণু সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে। বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাইজিন বেইসলাইন সার্ভের দেয়া তথ্য মতে, বাংলাদেশের স্কুলগুলোতে মাসিকের সময় প্রায় এক-চতুর্থাংশ মেয়েরাই স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। স্কুলে মাসিকবান্ধব টয়লেট না থাকা, মেয়েদের জন্য আলাদা কমনরুম না থাকা, মাসিকের রক্ত লেগে যাওয়ার ভয়, সহপাঠীরা টিজ করবে সেই লজ্জায় মাসিকের দিনগুলোতে স্কুলে যেতে এমনকি ঘর থেকে বের হতেও অস্বস্তিবোধ করে অনেক মেয়েই। ২০১৩ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের শতকরা ৮৬ ভাগ নারী মাসিকের সময় স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার না করে পুরনো কাপড় বা ন্যাকড়া অথবা তুলোর মতো অন্যান্য উপকরণ ব্যবহার করেন। এ ছাড়া ১০ শতাংশের কম নারী স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করে। যা অতি নগণ্য। এতে কিছু স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দিতে পারে বলে সতর্ক করে আসছেন চিকিৎসকরা। রেড অরেঞ্জ মিডিয়া এন্ড কমিউনিকেশনের হেড অব প্রোগ্রামস নকীব রাজীব আহমেদ ভোরের কাগজকে বলেন, আমরা কাজ করতে গিয়ে দেখেছি আমাদের দেশের মেয়েরা তাদের এই পরিবর্তনের খানিকটা ধারণা হয়তো পায় বড় বোন, বান্ধবী বা মায়েদের কাছ থেকে। তাও আবার অতি গোপনে, লুকিয়ে লুকিয়ে; যেন বাড়ির অন্যান্য বয়োজ্যেষ্ঠ বা পুরুষরা বিষয়টি জানতে বা বুঝতে না পারে। ফলে মেয়েরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাসিক সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পায় না। তিনি বলেন, উপরন্তু মায়েরা অনেক প্রথাগত ভুল ধারণা বা কুসংস্কার মেয়েদের ওপর চাপিয়ে দেন। যদিও স্কুলে এ সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা দেয়ার কথা। কিন্তু এ বিষয়ে শিক্ষকরা তা অনেক সময় পড়াতে ইতস্তত বোধ করেন। এ ছাড়া স্কুল, কলেজ ও পাবলিক টয়লেটগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মাসিকবান্ধব নয়। স্কুলপড়ুয়া মেয়েদের অর্ধেকরও বেশি স্কুলে নারীবান্ধব অবকাঠামো এবং নিরাপত্তার অভাবে মাসিকের কাপড় পরিবর্তন করতে পারে না। প্রায় অর্ধেক কিশোরীই মাসিকের সময় স্কুলে যেতে পারে না বা চায় না। তার মতে, এ সব বাধা দূর করতে ব্যাপক প্রচারণা ও সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজন। তাই এ জন্য সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে ব্যাপক উদ্যোগ প্রয়োজন। তিনি আরো বলেন, ২০১৬ সাল থেকে বাংলাদেশে নেদারল্যান্ডস এর দুতাবাসের অর্থায়নে ঋতু প্রকল্প মেয়েদের মাসিক স্বাস্থ্য ব্যাবস্থাপনা পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। ঋতু প্রকল্পে নেদারল্যান্ডস ভিত্তিক আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা সিমাভি লিড, রেড অরেঞ্জ মিডিয়া এন্ড কমিউনিকেশনস স্ট্র্যাটেজিক এন্ড কমিউনিকেশন পার্টনার, নেদারল্যান্ডস ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা টিএনও পার্টনার হিসেব আছে। এছাড়াও মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন পার্টনার হিসেবে কাজ করছে ডিওআরপি এবং বিএনপিএস। মেয়েদের মাসিক স্বাস্থ্য ব্যাবস্থাপনা পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য এরকম আরও বহু প্রকল্প বাংলাদেশে প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস এন্ড গাইনি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. কানিজ ফাতেমা ভোরের কাগজকে বলেন, মাসিক কোনো অসুখ নয়, এটি একটি প্রক্রিয়া যা মেয়েদের কৈশোর থেকে নারীত্বের পথে নিয়ে যায়। প্রতি মাসে ডিম্বাশয় একটি ডিম্বাণু উৎপাদন করে। এর পরে তা ডিম্বনালির মধ্য দিয়ে জরায়ুতে যায়। সে সময় জরায়ুর ভেতরে নরম, থিকথিকে রক্তে পরিপূর্ণ একটি তিনকণা স্তর তৈরি করে। সেখানেই ডিম্বাণুটি সুরক্ষিত থাকে। ছয় দিনের মধ্যে ডিম্বাণুটি শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত না হলে তা নষ্ট হয়ে যায়। ফলে রক্তের এ আবরণটি ভেঙে তা বের হয়ে আসে। এতে ভয়ের কিছুই নেই। তিনি বলেন, তবে এ সময়টি অনেক সচেতন থাকতে হবে। এ সময় সম্ভব হলে স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করতে হবে। সর্বদাই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। তিনি আরো বলেন, সাধারণত ৯ থেকে ১৩ বছরের মেয়েদের প্রথম মাসিক হয়ে থাকে। তবে শারীরিক গঠন ভেদে তারতম্য ঘটে থাকে। ডা. মাহমুদা আক্তার বলেন, মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তপাত, কালো ও জমাট রক্ত, অতিরিক্ত জ্বর, একাধিকবার রক্তপাত হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App