সড়ক ও জনপথ বিভাগ দুর্নীতির আখড়া : দুদক
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২০ এপ্রিল ২০১৮, ১১:০৬ এএম
সড়ক নির্মাণে পদে পদে অনিয়ম হচ্ছে। এসব অনিয়মের মধ্যে রয়েছে- সড়ক নির্মাণে নিম্নমানের ইট, খোয়া ও বিটুমিন ব্যবহার। ঠিকমতো মাটি ও বালু না ফেলা। সময়মতো কাজ শেষ না করে প্রকল্পের সময় ও ব্যয় বাড়ানো, দরপত্রের মাধ্যমে পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া। প্রভাবশালী ব্যক্তিদের চাপে ও কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে সরকারি টাকা আত্মসাৎ। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে ঠিকাদার নিয়োগ ও সড়ক নির্মাণে পদে পদে দুর্নীতি হওয়ায় বেড়ে চলেছে সড়ক দুর্ঘটনা।
দুর্নীতি প্রতিরোধের লক্ষ্যে গঠিত ‘সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর সংক্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিক টিমে’র অনুসন্ধানের মাধ্যমে বেরিয়ে এসেছে এসব তথ্য। সড়ক ও জনপথ বিভাগকে দুর্নীতির আখড়া উল্লেখ করে স্বাধীন সংস্থাটির গঠিত টিমের প্রতিবেদনে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র উপস্থাপনের পাশাপাশি সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের দুর্নীতি রোধে ২১ দফা সুপারিশও করা হয়েছে। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেদনটি মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে পাঠান দুদক সচিব মো. শামসুল আরেফিন।
প্রতিবেদনে অনিয়মের প্রধান খাত হিসেবে সড়ক নির্মাণ ও মেরামতকে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর এ জন্য সড়ক নির্মাণে এখন থেকে বিটুমিনের পরিবর্তে কংক্রিট ব্যবহারের জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সড়ক নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ইটের খোয়া ও পাথর। দরপত্রে উল্লিখিত ইট ও খোয়া না দিয়ে নিম্নমানের ইট ও খোয়া দেয়া হয়। এটি সওজ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ঠিকাদাররা করে থাকেন। এ ধরনের দুর্নীতি বন্ধে অধিদপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে দরপত্রে উল্লিখিত ইট ও খোয়া ঠিকাদার ব্যবহার করছেন কি না, তা প্রত্যয়ন করতে হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সড়ক নির্মাণে দরপত্রের শর্তানুযায়ী উন্নতমানের বালু ব্যবহৃত হয় না। এ দুর্নীতি বন্ধে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল বিভাগের অধ্যাপক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, নির্মাণকাজের বিশেষজ্ঞ ও এই অধিদপ্তরের সততার খ্যাতি রয়েছে- এমন প্রকৌশলীদের নিয়ে কমিটি গঠন করা যেতে পারে। এ কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন ব্যতীত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে চূড়ান্ত বিল ছাড় করা হবে না।
সড়ক নির্মাণের অন্যতম উপাদান বিটুমিন ব্যবহারেও অনিয়ম হয়। এ বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকার এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে মহাসড়কে ৬০-৭০ গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেছে। কিন্তু ঠিকাদাররা সড়ক-মহাসড়কে ৮০-১০০ গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার করছেন। উন্নতমানের বিটুমিন ব্যবহার করলে ভারি বৃষ্টিতেও সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে না বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। এ দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে হলে সংশ্লিষ্ট মাঠ প্রকৌশলীরা নির্মাণ সাইটে গিয়ে দৈবচয়নের ভিত্তিতে বিটুমিনের মান পরীক্ষা করবেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রকল্পের সময়সীমার মধ্যে কাজ শেষ না করে ব্যয় বাড়ানো হয়। এ ক্ষেত্রে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করা নিশ্চিত করতে হবে। কোনোভাবেই প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো যাবে না। প্রকল্পের ক্রয়, নির্মাণ, মেরামত ও সংস্কারকাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য প্রকল্পের সব অংশীজনকে নিয়ে ‘গণশুনানি’ ও ‘সামাজিক নিরীক্ষার’ আয়োজন করা যেতে পারে। সড়ক নির্মাণ স্থায়ী ও টেকসই করার জন্য বিটুমিনের বদলে কংক্রিট ব্যবহার করার সুপারিশ করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ গত ৪ এপ্রিল বঙ্গবভনে গিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করেন। ওইদিন রাষ্ট্রপতির হাতে দুদক চেয়ারম্যানের তুলে দেয়া বার্ষিক প্রতিবেদনে দেশের দুর্নীতি দমনে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। সেখানে সড়কের দুর্নীতি বন্ধে বিটুমিনের পরিবর্তে কংক্রিট ব্যবহারে দুদকের পক্ষ থেকে সুপারিশ করা হয়।
এর আগে ২০১৬ সালের ২ আগস্ট একনেক সভায় রাস্তাঘাটের স্থায়িত্ব বাড়াতে বিটুমিনের পরিবর্তে কংক্রিটের সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেদিন প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, বিটুমিনের রাস্তা তৈরি করলে সামান্য বৃষ্টিতেই তা নষ্ট হয়ে যায়। এতে জনগণের ভোগান্তি ও রাস্তা পুনঃনির্মাণের ব্যয় বাড়ে। এ জন্য কংক্রিটের রাস্তা তৈরি করতে হবে।
এদিকে গত ৮ এপ্রিল দশম জাতীয় সংসদের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির মতবিনিময় সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, সড়কে আর একচেটিয়াভাবে বিটুমিন ব্যবহার করা হবে না। দেশের হাওর, উপক‚লীয়, অতিবৃষ্টিপ্রবণ এলাকা এবং মহাসড়কের বাজার অংশে কংক্রিটের সড়ক নির্মাণ করা হবে।