×

মুক্তচিন্তা

পর্যটনের নতুন দিগন্ত

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ এপ্রিল ২০১৮, ০৭:৫৯ পিএম

পর্যটনের নতুন দিগন্ত
পর্যটনের নতুন দিগন্ত
  উপকূলবর্তী জেলা ভোলা যাওয়ার ইচ্ছা ছিল অনেক দিনের। যাই যাই করেও যাওয়া হচ্ছিল না। অবশেষে সেটি সম্ভব হলো। না, কেবল জেলা সদর ঘুরেফিরে দেখা উদ্দেশ্য না; উদ্দেশ্য ছিল ইতোমধ্যে সুপরিচিত হয়ে ওঠা পার্শ্ববর্তী কয়েকটি চরাঞ্চল সম্পর্কে ধারণা নেয়া। সে লক্ষ্যে পুরনো সহকর্মীদের সঙ্গে পরামর্শ করে বেছে নিই মনপুরা, চরফ্যাশন ও চরকুকরী-মুকরীকে। সহকর্মী ওই বন্ধুদের সহযোগিতা ছাড়া অন্তত চর কুকরী-মুকরীতে যাওয়া সম্ভব হতো না। এই কুকরী-মুকরীতে কিছুদিন আগে রাত্রিযাপন করে এসেছেন আমাদের রাষ্ট্রপতি মহোদয়। ওখানে বন বিভাগের একটি চমৎকার গেস্ট হাউস আছে, উনি সেখানে ছিলেন। আমরাও জায়গা পাই ওখানে থাকার। তবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সরকারি গেস্ট হাউসে থাকার অভিজ্ঞতা যাদের আছে তাদের জ্ঞাতার্থে বলি, এটি কিঞ্চিত ব্যতিক্রম; তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল; বিদ্যুতের সমস্যা আছে, তবে পরিচ্ছন্ন। মনপুরা ও চরফ্যাশন জলবেষ্টিত ও অরণ্যঘন হলেও এখন আর চিরায়ত প্রকৃতির চর নয়; দুটিই কর্মচঞ্চল জনপদ। তবে সরকার আগেই হাত লাগালে দুটি স্থানই হতে পারত পর্যটনের কেন্দ্র। বসতি ও বিভিন্ন স্থাপনা পরিকল্পনামাফিক হলে সৌন্দর্যের আঁধার হতো একেকটি। তবে বিলম্বে হলেও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি দৃষ্টি দিয়েছেন চরফ্যাশনে। তৈরি করা হয়েছে একটি দৃষ্টিনন্দন টাওয়ার, যার নাম দেয়া হয়েছে ‘জ্যাকব টাওয়ার’। সেই টাওয়ারটিকে ঘিরে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে একটি বলয়ের, যেখানে পার্কসহ আছে কিছু স্থাপনা। গণমাধ্যমের কল্যাণে ইতোমধ্যে দেশময় পরিচিতি লাভ করেছে টাওয়ারটি। ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে পরিচর্যার ওপর, যার ঘাটতি এখনই চোখে পড়ার মতো। টাওয়ারে আরোহনের টিকেট উচ্চমূল্যের হওয়ায় গরিব মানুষ অন্য সব ক্ষেত্রের মতো এখানেও বঞ্চিত হবেন। চর কুকরী-মুকরী প্রাকৃতিকভাবে সত্যিই অসাধারণ। সুন্দরবনের আদল আছে কিছুটা এতে। যাতায়াতের মাধ্যম খাল, আর উপায় ট্রলার। অরণ্য ঘেরা চতুর্দিক, জনবসতি থাকলে থাকতেও পারে; আমাদের চোখে পড়েনি। বনটি হরিণের আবাসস্থল হিসেবে খ্যাত। বনায়ন হয়নি এমন ভূমিও আছে পর্যাপ্ত পরিমাণ, যেখানে বিচরণ শত-সহস্র গরু মহিষের। আছে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি। এখনই সময় সমুদ্রের কূলঘেঁষা এ এলাকাটিকে নিয়ে একটি উপযুক্ত পরিকল্পনা প্রণয়নের, যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকবেন বনবিভাগ ও পর্যটন করপোরেশনের কর্মকর্তারা। বাংলাদেশে দৃশ্যমান এমন অনেক চরের কথা আমরা শুনি যা দেশের উন্নয়ন সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। নিঝুম দ্বীপের কথা আমরা জানি, জানি স্বর্ণদ্বীপ, ভাসান চর, বঙ্গবন্ধু চর ইত্যাদির কথা। পরিকল্পিত উপায়ে এগুলোকে কাজে লাগানো গেলে অনেক সমস্যারই সমাধান হতে পারে। দেশে ভূমির সমস্যা প্রকট। ভূমিহীনদের ওখানে কর্মসংস্থান নিয়ে খুব বেশি ভাবতে হবে বলে মনে হয় না। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হলে তারা নিজেরাই কাজ জুটিয়ে নিতে পারবে। তা ছাড়া অধিকাংশ চর বেশ ফলবতী, পলিজনিত উর্বরতার গুণে নানান ফসলের জন্ম দেয় সে মাটি। সমস্যা হলে তা কাটিয়ে নেয়ার ক্ষমতা রাখেন আমাদের কৃষক ও কৃষিবিজ্ঞানীরা যা নানান উদাহরণে প্রমাণিত। মানুষের ভ্রমণপ্রবণতা বেড়েছে। সাধ্যে যাদের কুলোচ্ছে তারা বিদেশে যাচ্ছেন, যাদের সামর্থ্য অতটা নেই তারা যাচ্ছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, একান্তই ব্যক্তিগত উদ্যাগে। কেউ কেউ ট্যুর অপারেটরদের সহায়তা নিচ্ছেন, কিন্তু পর্যটন করপোরেশনকে পাশে পাচ্ছেন না। পর্যটন করপোরেশন অনুধাবন করতে পারছে কি যে তাদের সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অপেক্ষমাণ? মনে হয় না, অথবা এমনো হতে পারে সব জেনে-বুঝেও তারা মুখ লুকিয়ে রাখছে বালিতে। কর্মকর্তারা কেবল বিদেশি পর্যটকদের গোনায় ধরছেন, নতুন সামর্থ্য অর্জিত দেশীয় ভ্রমণপিপাসুদের দিকে তাকাচ্ছেন না। বিদেশি পর্যটকদের প্রাধান্য দেয়ার বেলায়ও করপোরেশনের অবলম্বন পুরনো সব স্পট; সেই কক্সবাজার, সুন্দরবন, সেন্টমার্টিন, পার্বত্য চট্টগ্রাম, ময়নামতি, বরেন্দ্র অঞ্চল, সিলেটের চা বাগান-মাজার ও বৃহত্তর সিলেটের চতুর্দিক, মসজিদের নগর ঢাকা, কুয়াকাটা ইত্যাদি। এর বাইরে কিছুটা সুদূর ও নিকট-অতীতে আবিষ্কৃত বিভিন্ন মনোরম জায়গার দিকে তাদের দৃষ্টি প্রসারিত কিনা বোঝা মুশকিল, সে রকম কোনো তৎপরতা দেখি না। বিদেশি পর্যটকদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি নিক্ষেপ অবশ্যই কাক্সিক্ষত; এতে দেশের ভাবমূর্তি বাড়ার সম্ভাবনা থাকে, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। বাস্তবতা হলো- বাইরের পর্যটক তেমনভাবে আসছেন না, ফলে সুফলও মিলছে না আশানুরূপ। অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার ঘাটতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভঙ্গুরতা, যানজট, পরিবেশ দূষণ ইত্যাদি তো আছেই; তার ওপর আছে দৃষ্টি আকর্ষণের অপারগতা। আরেকটি অনুষঙ্গকে ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে প্রধান মনে হয়, তা হলো সন্ধ্যার পরের নির্জনতা। দিনের আলো নেভার সঙ্গে সঙ্গে পর্যটকদের ঘরে গিয়ে বসে থাকা ছাড়া উপায় থাকে না। নিয়মিতভাবে বিভিন্ন অনুষ্ঠান, প্রদর্শনী ইত্যাদির আয়োজন দ্বারা এ সমস্যার সমাধান করা যায়; যা করতে হবে করপোরেশনকেই। বাংলাদেশ নদ-নদী, হাওর-বাঁওড় ও সবুজের দেশ, এই পরিচয়টি তুলে ধরা হচ্ছে না কোথাও; অথচ খুবই ব্যতিক্রমী দিক এটি। সিলেটের টাঙ্গুয়ার হাওরের মতো অসাধারণ সুন্দর জলাধার পৃথিবীর অন্য কোথাও আছে কিনা সন্দেহ আছে। শুধু টাঙ্গুয়ার হাওর কেন; কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে যে হাওর-বাঁওড়গুলো আছে সেগুলোর সৌন্দর্য মন কেড়ে নেয়ার মতো। বছরের অর্ধেক সময় জুড়ে হাওরগুলো পানিতে পূর্ণ থাকে। তখন তার চোখ ধাঁধানো রূপ নজর কাড়ে। শুষ্ক মৌসুমের বাকি অর্ধেক সময়ের একাংশজুড়ে করা হয় বোরো ধানের আবাদ; সবুজে সবুজময় হয়ে উঠে তখন চতুর্দিক। জীবন-জীবিকাও সেখানে ভিন্নতর। দেশি-বিদেশি কোনো পর্যটকের কাছেই এ সৌন্দর্য তুলে ধরার ব্যবস্থা নেই। সে ব্যবস্থা করা গেলে আকর্ষণের কেন্দ্র বাড়ত, পর্যটকরাও পেতেন নতুন আস্বাদ। এ প্রসঙ্গে আরেকটি কথা বলি : সব পর্যটক কেবল চোখের দেখা দেখতে আসেন না, জীবন-জীবিকাও জানতে চান সেখানকার। পর্যটন শিল্পের বিকাশ চাইলে এ কথাও মনে রাখতে হবে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পর্যটক দ্বীপ অথবা চরাঞ্চলের মতো প্রত্যন্ত এলাকায় যেতে চান, কিন্তু থাকার জায়গার ব্যাপারে অনিশ্চয়তার আশঙ্কায় সাহস করেন না। জেলা পরিষদ, কিংবা বনবিভাগের মতো কোনো কোনো বিভাগের ডাকবাংলো আছে বেশকিছু জায়গায়; সেগুলোতে বুকিং পাওয়া সাধারণ মানুষের জন্য একেবারেই অনিশ্চিত। প্রত্যন্ত অঞ্চলের কথা বেশি করে বলার অন্য কারণও আছে। এসব এলাকার মানুষজন সার্বিক বিচারে দরিদ্র। পর্যটকের আনাগোনা বাড়লে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পেত, তার সুফল পেতে পারত স্থানীয়রা। আমাদের রাষ্ট্রপতি মহোদয় তৃণমূলের মানুষ হিসেবে তৃণমূলের সমস্যা ও সম্ভাবনা দুই-ই নিয়ে হয়তো ভাবিত। যে কারণে শীর্ষ প্রত্যন্ত স্থান বান্দরবনের নীলগিরি, ভোলার চরফ্যাশন-চরকুকরী-মুকরী, নোয়াখালীর স্বর্ণদ্বীপে গিয়ে জায়াগাগুলোকে হাইলাইট করার চেষ্টা করছেন। হাওর উনার নিজের অঞ্চল, সেখানকার কথা তো বলবেনই। শুধু সৌন্দর্য অবলোকন নয়, অর্থনৈতিক সম্ভাবনার বিষয়টি নিশ্চিত তার মনোলোকে ছিল। পর্যটন করপোরেশনের এরপর সেদিকে দৃষ্টি দেয়ার কথা। কেবল সুপরিচিত জায়গা নয়, দুর্গম এলাকার দৃষ্টিনন্দন স্থানের দিকে তাদের দৃষ্টি প্রসারিত হোক এ রকম প্রত্যাশা করি। মজিবর রহমান : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App