×

জাতীয়

দৃশ্যমান হচ্ছে মেট্রোরেল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ এপ্রিল ২০১৮, ১০:৪৮ এএম

দৃশ্যমান হচ্ছে মেট্রোরেল
যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুগান্তকারী উন্নয়ন ও ঢাকা মহানগরীতে যানজট নিরসনে সরকারের মেগা প্রকল্প মেট্রোরেল এখন আর স্বপ্ন নয়, রূপ নিচ্ছে বাস্তবে। রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ী থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এ প্রকল্পের ৩ ও ৪ নং প্যাকেজে মহাকর্মযজ্ঞ চলছে। দিনরাত ২৪ ঘণ্টায় দুই শিফটে কর্মব্যস্ত সময় পার করছেন শ্রমিক ও প্রকৌশলীরা। যার ফলে ক্রমশই দৃশ্যমান হচ্ছে ঢাকাবাসীর স্বপ্নের মেট্রোরেল। এরই মধ্যে উত্তরার দিয়াবাড়ীতে ৩০ মিটার দূরত্বে দুটি পিয়ার (পিলার বা খুঁটি) সংযুক্ত করে বসানো হয়েছে কংক্রিটের একটি স্প্যান। চলতি মাসের শেষের দিকে আগারগাঁও পয়েন্টে বসবে দ্বিতীয় স্প্যানটি। জানা গেছে, আগামী ২০ এপ্রিল দিয়াবাড়ীতে স্প্যান বসানোর কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্ধোধন করবেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। প্রকল্পের একাধিক প্রকৌশলী বলছেন, উত্তরার দিয়াবাড়ী থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ৩৭৭টি পিয়ারের ওপর এরকম ৩৭৬টি স্প্যান বসে বিস্তৃত হবে ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটারের মেট্রোরেল। তবে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ দশমিক ১ কিলোমিটার দীর্ঘ এই উড়াল রেলপথে মোট ৭৭০টি স্প্যান বসবে। প্রথম পর্যায়ে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত চলাচলের লক্ষ্য নির্ধারণ করে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে এ প্রকল্পের কাজ। নির্ধারিত সময়ের আগেই এ অংশ ট্রেন চলাচলের জন্য প্রস্তুত হবে বলে আশা করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হলে প্রতিঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী উভয় দিক থেকে আসা যাওয়া করবে মেট্রোরেলে চড়ে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, মূলত দুটি অংশে ভাগ করে মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ চলছে। মূল ডিপো নির্মাণ এবং চলাচলের লাইন। এরই মধ্যে আগারগাঁও পর্যন্ত পাইলিং শেষ হয়েছে। এখন মাটির উপরের অংশে পিলার নির্মাণ করে তার উপর একের পর এক বসানো হবে স্প্যানগুলো। অন্যদিকে উত্তরার দিয়াবাড়ীতে প্রায় ৫৯ একর জায়গার ওপর নির্মিত হচ্ছে মেট্রোরেলের মূল ডিপো। যেখান থেকে প্রতি ৪ মিনিট ১৯ সেকেন্ড পর পর ছেড়ে যাবে ৬ জোড়া বগি নিয়ে ১৪টি বিদ্যুৎচালিত অত্যাধুনিক ট্রেন। এ ট্রেনের গতি হবে ঘণ্টায় গড়ে ৩২ কিলোমিটার। নির্ধারিত সময়ের আগেই ডিপোর কাজ শেষ হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। গত মঙ্গলবার সরজমিন দিয়াবাড়ীতে মেট্রোরেল প্রকল্পের ডিপোতে গিয়ে দেখা যায়, ভূমি থেকে ১০ মিটার উঁচুতে বসানো স্প্যানের বাকি অংশ স্থাপনে ব্যস্ত রয়েছেন শ্রমিক ও প্রকৌশলীরা। দিন-রাতে দুই শিফটে চলছে নির্মাণযজ্ঞ। পুরো প্রকল্প এলাকার বিভিন্ন স্থানে বসানো হয়েছে বিশাল আকৃতির ক্রেন, অ্যাসকেভেটর। শ্রমিক ও প্রকৌশলীদের কোনো দল স্প্যান বসানোর কাজ, কোনো দল পাইলিংয়ের কাজ, আবার কোনো দল মোটা লোহার রডের খাঁচা তৈরির কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। পাশাপাশি সড়কে যানজট নিরসনেও কাজ করছেন প্রকল্পের শ্রমিকরা। দিয়াবাড়ী ডিপোর পাশেই পঞ্চবটিতে বিশাল কাস্টিং ইয়ার্ডে চলছে ভায়াডাক্ট (গাডার) তৈরির কাজ। এই কাস্টিং ইয়ার্ড থেকেই গাডার নিয়ে উভয় দিক থেকে একের পর এক স্প্যান বসানো হবে বলে জানিয়েছেন প্রকৌশলীরা। মেট্রোরেল বাস্তবায়নকারী ‘ঢাকা ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’ (ডিএমআরটিডিপি)-এর একজন (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ভোরের কাগজকে বলেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ করার লক্ষ্য নিয়ে উত্তরা-আগারগাঁও পয়েন্টে প্যাকেজ-৩ ও প্যাকেজ-৪ এর কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। শ্রমিক-প্রকৌশলীরা দিন-রাত কাজ করছেন। ইতোমধ্যে ৮০০-র মতো পাইল শেষ হয়েছে। জুলাইয়ের মধ্যে বাকি পাইলিংয়ের কাজ শেষ হবে। তবে কিছু এলাকায় বিদ্যুতের তার ও খুঁটির কারণে কাজ কিছুটা বিলম্বিত হয়েছে। সেগুলো অপসারণ করা হচ্ছে। অন্যদিকে আগরগাঁও অংশের প্যাকেজ-৪ আওতায় সিংহভাগ পাইলিংয়ের কাজ শেষ হয়েছে। এখনকার রিগ অ্যাসকেভেটরসহ ভারী যন্ত্রপাতি পল্লবী ও মিরপুরের দিকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। ক্রমান্বয়ে সেদিকে শুরু হবে পাইলিং কাজ। আর মাটির উপরের পিলারের কাজ করার জন্য ক্রেনসহ আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি আনা হচ্ছে। পুরো প্রকল্প এলাকার কাজ নির্বিঘ্ন করা ও দুর্ঘটনা এড়াতে রাস্তার মাঝামাঝি এলাকায় সিমেন্টের বড় ব্লুক রেখে তার ওপর লোহার ফ্রেম দিয়ে এলাকা সংরক্ষণ করা হয়েছে। কাজের সুবিধার্থে নিরাপত্তা হেলমেট, উজ্জ্বল ইউনিফর্ম ও পতাকা হাতে প্রকল্প এলাকাজুড়ে নিয়োজিত আছেন অসংখ্য কর্মী। মেট্রোরেল প্রকল্পের অগ্রগতি জানতে চাইলে ডিএমআরটিডিপির পরিচালক (লিগাল অ্যাফেয়ার্স এন্ড পাবলিক রিলেশন) খান মো. মিজানুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, অগ্রগতি অনেক ভালো। ধীরে ধীরে মেট্রোরেল দৃশ্যমান হতে চলছে। উত্তরা দিয়াবাড়ী ডিপোতে একটি স্প্যান বসানোর কাজ শেষের পথে। পুরো কাজ শেষ হতে ২০ থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। স্প্যানটি বসানোর কাজ পুরো শেষ হলে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের স্প্যান বসানোর কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন। এ ছাড়া চলতি মাসের শেষের দিকে প্রকল্পের আগারগাঁও এলাকায় দুই পিয়ারের ওপর আরেকটি স্প্যান বসবে বলে আশা করা হচ্ছে। খান মো. মিজানুল ইসলাম বলেন, প্রকল্পের মোট ৮ প্যাকেজের মধ্যে ৪টি প্যাকেজের কাজ চলছে। কোনো প্যাকেজের শতভাগ কাজ শেষ হয়েছে, আবার কোনো প্যাকেজের ৩০ বা ৩৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এখন পর্যন্ত প্রকল্পের মোট কাজের গড়ে ১৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত প্যাকেজ-৩ ও প্যাকেজ-৪ এর কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। দিয়াবাড়ী এবং আগারগাঁও উভয় দিক থেকে স্প্যান বসানোর কাজ সমানতালে চলবে, মাঝামাঝি স্থান পল্লবীতে এসে উড়াল রেলপথ এসে মিলবে। মানুষের ভোগান্তি যাতে কম হয় সে জন্য দ্রুত কাজ শেষ করার চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, আগামী বছর জাপানের গাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান কাওয়াসাকি-মিৎসুবিশি থেকে ৬টি কোচ আমদানি করা হবে। বিদ্যুৎচালিত এই ট্রেনে সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সুবিধা নিশ্চিত করতে দুটি প্লান্টও নির্মাণ করা হচ্ছে। ডিএমআরটিডিপি সূত্র জানায়, মেট্রোরেল প্রকল্পের এমআরটি লাইন-৬ এর পুরো কাজ ৮টি প্যাকেজে ভাগ করা হয়েছে। প্যাকেজ-১ এর আওতায় দিয়াবাড়ীতে ডিপোর ভূমি উন্নয়ন কাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। প্যাকেজ-২ এর আওতায় ডিপো এলাকায় নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রসহ বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো নির্মাণকাজ চলমান, যার প্রথম পর্যায়ের কাজ ২০১৯ সালের অক্টোবরে ও দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ ২০২০ সালের ডিসেম্বরে শেষ করার কথা। প্যাকেজ-৩ ও প্যাকেজ-৪ এর আওতায় উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দমিক ৭৩ কিলোমিটার পর্যন্ত উড়ালপথ ও ৯টি স্টেশন নির্মাণ করা হবে। পরে এ উড়ালপথের ওপরই ট্রেনের লাইন বসবে। এ প্যাকেজের মেয়াদ ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। আর প্যাকেজ-৫ ও ৬ এর আওতায় আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ট্রেন লাইন ও ৭টি স্টেশন নির্মাণ করা হবে। এ অংশের কাজের মধ্যে প্রকল্প এলাকায় অবস্থিত বিভিন্ন সংস্থার মাটির নিচের লাইন সরানোর কাজ শুরু হয়েছে। প্যাকেজ-৭ এর আওতায় ইলেকট্রিক্যাল এন্ড মেকানিক্যাল সিস্টেমের কাজ এবং প্যাকেজ-৮ এর আওতায় রেল কোচ ও ডিপো ইকুইপমেন্ট সরবরাহের কাজ চলমান রয়েছে, যা সম্পন্ন হবে ২০২০ সালের মধ্যে। জানা গেছে, মেট্রোরেল লাইন-৬ উত্তরা থেকে মিরপুর, আগারগাঁও, ফার্মগেট, শাহবাগ হয়ে মতিঝিলে গিয়ে শেষ হবে। ২০ দশমিক ১ কিলোমিটার এ রুটে স্টেশন থাকবে মোট ১৬টি। প্রস্তাবিত নকশা অনুযায়ী প্রতিটি স্টেশনের দৈর্ঘ্য হবে প্রায় ১৮০ মিটার। স্টেশনগুলো হলো উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, মিরপুর-১১, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কারওয়ানবাজার, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ সচিবালয় এবং মতিঝিল। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৬ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে জাপান আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা (জাইকা)। বাকি ৫ হাজার ৩৯০ কোটি টাকার জোগান আসবে সরকারি তহবিল থেকে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App