×

জাতীয়

৫ বছরে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি গাজীপুরে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ এপ্রিল ২০১৮, ০১:০২ পিএম

গাজীপুর সিটি করপোরেশনে সমস্যার পাহাড় জমেছে। গত ৫ বছরে এখানে উন্নয়নের ছিটেফোঁটাও লাগেনি। নগরীর বাসিন্দারা সব ধরনের নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। প্রত্যেকটি ওয়ার্ডে বাসিন্দাদের মধ্যেই এখন তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে। টঙ্গী ও গাজীপুর সদর থেকে কিছুটা দূরের ওয়ার্ডগুলোর অবস্থা বেশি খারাপ। জলাবদ্ধতা, বিকল ড্রেনেজ ব্যবস্থা, অপরিচ্ছন্নতা, যানজট, শহর এলাকার ফুটপাত দখল, বিদ্যুৎ ও বিশুদ্ধ পানির অভাব, বাড়ি তৈরির অনুমোদন না পাওয়ার অভিযোগ গাজীপুরের প্রায় সর্বত্র। এমনকি নিয়মিত নাগরিক সুবিধাগুলো পর্যন্ত গাজীপুর সিটি করপোরেশন নিশ্চিত করতে পারেনি। এসব কারণে গাজীপুরের মানুষের মাঝে এখন তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। আগামী নির্বাচনে জনগণের এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটবে বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন ওয়ার্ডে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ এলাকাতে এখনো গ্রামীণ জনপদের ছাপ স্পষ্ট। বিশাল শিল্প ও বাণিজ্যিক এলাকা হওয়ার পরও বেশিরভাগ বাসিন্দার জীবনমানের উন্নতি হয়নি। ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং প্রত্যাশিত নাগরিক সুবিধা নিয়ে অভিযোগের যেন শেষ নেই। গাজীপুরের উন্নয়ন না হওয়ার পেছনে অনেকে বর্তমান মেয়র এম এ মান্নানের গ্রেপ্তার হয়ে দীর্ঘদিন দায়িত্বের বাইরে থাকার বিষয়টিকে অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। টঙ্গী, চেরাগআলী, ছয়দানা, বাসন, চান্দনা ও গাজীপুর সদর এলাকার অনেক বাসিন্দা অভিযোগ করেন- বিশাল গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকার কোনো উন্নয়ন হয়নি এটা ঠিক। তবে মেয়র মান্নান গ্রেপ্তার না হলে গাজীপুরের উন্নয়নে তিনি কাজ করতে পারতেন। তাকে কাজ করার সুযোগ দেয়া হয়নি। অন্যদিকে অনেকেই আবার এই যুক্তি খণ্ডন করে বলেছেন, মেয়র মান্নান দুই বছর জেলে ছিলেন। বাকি তিন বছর তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। এই সময়েও গাজীপুরের কোথাও কোনো উন্নয়ন হয়নি। আসলে তিনি উন্নয়নের কোনো পরিকল্পনা প্রণয়ন ও প্রকল্প গ্রহণ করতে পারেননি। এটা তার ব্যর্থতা। এম এ মান্নান জেলে থাকার সময় দায়িত্বরত ভারপ্রাপ্ত মেয়রের সময়ে রাস্তার সংস্কারের কিছু উন্নয়ন কাজ হয়েছে। গাজীপুর পৌর মার্কেটের সামনে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহমান মাস্টারের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। নগরীর উন্নয়ন সম্পর্কে জানতে চাইলে ক্ষোভের সঙ্গে তিনি বলেন, এলাকার এমনই উন্নয়ন হয়েছে যে, নৌকায় চলাফেরা করতে হয়। আর কিছুদিন পরে জলাবদ্ধতার কারণে বাসা থেকে বের হওয়া যাবে না। পুলিশ প্রশাসনের ইমেজ ভালো না। তারা চাঁদাবাজি করে। গাজীপুর ৫ বছর আগে যেমন ছিল, এখনো তেমনই আছে। কিছু কিছু জায়গায় নাগরিকদের সমস্যা আগের চেয়ে বেড়েছে। নতুন রাস্তার নির্মাণ ও পুরনো রাস্তাগুলোর সংস্কার হয়নি। গাজীপুরের মানুষ চরম অবহেলার শিকার হয়েছে। এডভোকেট মো. শফিকুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, এই নগরীর সমস্যার শেষ নেই। গাজীপুরে মেয়র আছে কিনা এলাকার মানুষের উপলব্ধিতে তা নেই। মেয়র বাইরে নাকি জেলের ভেতরে তাও জানে না। রাজনীতিবিদরা জনগণের সবচেয়ে বেশি কল্যাণ করতে পারে। কিন্তু গাজীপুরে এখন পর্যন্ত তা দেখা যায়নি। জলাবদ্ধতা ও যানজট সবচেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। অল্প বৃষ্টিতেই নগরীর বেশিরভাগ এলাকা জলাবদ্ধ হয়ে পড়ে। ড্রেনেজ ব্যবস্থা একেবারেই ধ্বংস হয়ে গেছে। গত ৫ বছরে কোথাও নতুন ড্রেন নির্মাণ ও পুরনো ড্রেনের সংস্কার হয়নি। পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় গাজীপুর একটি জলাবদ্ধ শহরে রূপ নিয়েছে। বর্ষা হলে এলাকার লোকজনের চলাফেরা দায় হয়ে পড়ে। ওয়ার্ডগুলোতে অবকাঠামো উন্নয়নে নতুন করে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এর সঙ্গে আছে ভয়াবহ যানজট সমস্যা। যানজট নিরসনে টঙ্গী থেকে গাজীপুর পর্যন্ত কোথাও কোনো পরিকল্পনা নেয়া হয়নি। অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইকের দাপটে গাজীপুরবাসী প্রতিনিয়ত ভোগান্তির মধ্যেই দিন কাটায়। প্রতিদিন হাজার হাজার বাস-ট্রাক গাজীপুরের ওপর দিয়ে চলাচল করে। অথচ এখানে বাস ও ট্রাকের জন্য কোনো টার্মিনাল নেই। রাস্তার ওপর এগুলো পার্কিং করে রাখা হয়। শহরের ডিসি অফিসের সামনে, জোরপুকুর পাড় এলাকায় অবৈধ সিএনজি স্ট্যান্ড তীব্র যানজটের সৃষ্টি করে। সিটি করপোরেশনের ভেতরে থেকেও নাগরিকদের গ্যাস, বিদ্যুৎ সুবিধা নেই। ঢাকা থেকে গাজীপুরে আসার একটি মাত্র রাস্তা। আজ পর্যন্ত বিকল্প কোনো সড়ক তৈরি হয়নি। রেললাইনের দুই পাশ দিয়ে অনেক জায়গা দখল হয়ে গেছে। এই জায়গার ওপর দিয়ে বিকল্প রাস্তা করা যায়। কিন্তু এ ব্যাপারে কারো কোনো উদ্যোগ নেই। তিনি আরো বলেন, গাজীপুরে বাড়ি বানানোর অনুমোদনের জন্য লোকজনকে রাজউকে যেতে হয়। এতে মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছে। যাদের টাকা আছে তারা ঘুষ দিয়ে প্ল্যান পাস করে নিয়ে আসছে। নগরীর গ্রামীণ অংশের নাগরিকরা সিটি করপোরেশনের সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না। চাপুলিয়া, ভানুয়া, পাগুলিয়া, ভুরুলিয়া, অরিনাল, মিলেরপাড়া, কানাইয়াসহ বহু গ্রামের বাসিন্দারা এখনো গ্রামীণ জীবনমানের মধ্যেই আছে। এরা সবচেয়ে বেশি সুবিধাবঞ্চিত। অথচ সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত হারে ট্যাক্স দিতে হচ্ছে। তিনি বলেন, সিটির ভেতরে তুরাগ, চিলাই ও শীতলক্ষ্যা তিনটি নদী আছে। এগুলো দখল হয়ে যাচ্ছে। অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে সিটি করপোরেশনের কোনো উদ্যোগ গত ৫ বছরে দেখা যায়নি। গাজীপুর রেলক্রসিংয়ের কারণে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। ট্রেন যাতায়াতের কারণে জনগণ ভোগান্তির শিকার হয়। এখানে একটি ফ্লাইওভার নির্মাণের জন্য বহুদিন থেকেই এলাকাবাসী দাবি জানিয়ে আসছে। মুক্তিযোদ্ধা ও গাজীপুর জেলা আওয়ামী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি মো. হাতেম আলীর ক্ষোভের সঙ্গে জানান, সিটি করপোরেশন গাজীপুরবাসীর জন্য গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে। ট্যাক্স বেড়েছে। নাগরিক সুবিধা একবিন্দুও বাড়েনি। জনগণের প্রত্যাশিত উন্নয়নের একটিও পূরণ হয়নি। অনেকেই জমির উন্নয়ন কাজ করতে পারছে না। রাজউকে যেতে হয়, টাকা দিতে হয়। এখন অনেকের জন্য জমি রক্ষা করাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্যাস-বিদ্যুৎ সুবিধার আওতার বাইরে রয়েছে অনেক এলাকা। এসব দেখার কেউ নেই। মেয়রের অবহেলা ও অবজ্ঞার কারণেই আজ গাজীপুরের এমন দুদর্শা। গাজীপুর জেলা সুজন সভাপতি, টিআইবির সহসভাপতি, দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও ভাষাশহীদ কলেজের অধ্যক্ষ মুকুল কুমার মল্লিক বলেন, বৃহৎ শিল্প এলাকা এবং রাজধানীর সবচেয়ে কাছের জেলা হয়েও গাজীপুর প্রকৃতপক্ষে একটি পিছিয়ে পড়া জনপদ। সিটি করপোরেশন হওয়ার পরে আমাদের জীবনমানের এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন একেবারেই হয়নি। তবে জীবনযাত্রার খরচ বেড়েছে। হোল্ডিং ট্যাক্স বেড়েছে। যানবাহনের সংখ্যা বেড়ে যানজট বেড়েছে। কিন্তু সমাধানের কোনো উদ্যোগ নেই। গাজীপুর আদালত এলাকায় দাঁড়িয়ে দেলোয়ার হোসেন জানান, সিটি করপোরেশনের ভেতরে থেকেও আমাদের সুবিধা বাড়েনি। আগে যেমন ছিলাম তেমনই আছি। কোথাও কোনো শৃঙ্খলা নেই। নগরীর মোড়ে মোড়ে যত্রতত্র ইজিবাইক স্ট্যান্ড। ইজিবাইকের বেপরোয়া চলাচলের কারণে রাস্তা পাড় হওয়াই কঠিন। গাজীপুরের বিভিন্ন স্থানে মাদকের জমজমাট ব্যবসা চলছে। কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। চেরাগআলী বাজার এলাকার ব্যবসায়ী মশিউর রহমান জানান, জমি কেনাবেচা করতে গেলেও বড় অঙ্কের ট্যাক্স দিতে হচ্ছে। বাড়ি করার জন্য করপোরেশন প্ল্যান দিতে পারে না। রাজউক থেকে প্ল্যান পাস করিয়ে আনতে হয়। সিটি করপোরেশন হওয়ার পর থেকে এই সমস্যা এখন আমাদের জন্য জুলুমের পর্যায়ে পৌঁছেছে। এটা আমরা মেনে নিতে পারছি না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App