×

জাতীয়

আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীদের মনোনয়ন যুদ্ধ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ মার্চ ২০১৮, ০১:৪১ পিএম

আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীদের মনোনয়ন যুদ্ধ
গাজীপুর সিটি করপোরেশন (গাসিক) নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের মনোনয়ন যুদ্ধ শুরু হয়েছে। কেউ কাউকে বিনা যুদ্ধে ছাড় দিতে রাজি নন। তারা এখন নিজেদের মাঠ গোছাতে গাজীপুর চষে বেড়াচ্ছেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে মনোনয়ন পাওয়ার জন্য জোর লবিংও চালিয়ে যাচ্ছেন। এ ছাড়া সম্ভাব্য প্রার্থীদের গণসংযোগও চলছে পুরোদমে। এদিকে ভোটাররাও প্রার্থীদের নিয়ে নানান ধরনের জল্পনা-কল্পনা শুরু করেছেন। মেয়র পদে কোন কোন নেতা প্রতিদ্ব›িদ্বতার আভাষ দিয়ে নির্বাচনী ময়দানে নেমেছেন, কোন প্রার্থী আওয়ামী লীগের শীর্ষ মহলে জোর লবিং চালাচ্ছেন, কোন প্রার্থী টাকা খরচ করছেন, কে চূড়ান্ত দলীয় মনোনয়ন পেতে পারেন- এসব নিয়েই এখন গাজীপুরের সর্বত্র চুলছেঁড়া বিশ্লেষণ চলছে। সম্ভাব্য প্রার্থীদের দোষ-ত্রুটি নিয়েও আলোচনা-সমালোচনা বাদ যাচ্ছে না। এলাকা ঘুরে জানা গেছে, এবারো গাসিক নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগে রীতিমতো মনোনয়ন যুদ্ধ শুরু হয়েছে। গাজীপুরের প্রায় সর্বত্রই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রস্তুতিমূলক তৎপরতা চোখে পড়ে। রাস্তার দুপাশে আগ্রহী মেয়র প্রার্থীদের বড় বড় পোস্টার দেখা গেছে। দলীয়ভাবে এখনো প্রার্থিতা ঘোষণা করা না হলেও গাজীপুরের বাতাসে এখন ক্ষণে ক্ষণে নানা ধরনের গুজব রটছে। কোনো কোনো প্রার্থী দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন বলেও দলীয় কর্মী-সমর্থকদের কাছে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইতোমধ্যেই প্রচার করেছেন। এ ধরনের প্রচার-প্রচারণা নিয়েও নেতাকর্মীদের মধ্যে পরস্পরবিরোধী মন্তব্য শোনা গেছে। আওয়ামী লীগ থেকে মেয়র প্রার্থী হিসেবে এখন পর্যন্ত ৬ জনের নাম শোনা গেছে। তারা হলেন- সাবেক টঙ্গী পৌরসভার দীর্ঘ ১৮ বছরের মেয়র ও বর্তমানে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ এডভোকেট আজমত উল্লাহ খান, গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট মো. জাহাঙ্গীর আলম, মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সাইফুল ইসলাম, যুবলীগ নেতা রাসেল সরকার, আওয়ামী লীগ নেতা ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর আসাদুজ্জামান কিরন ও মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান মতি। তারা সবাই এখন মেয়র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনী প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নেমেছেন। দলীয় মনোনয়ন লাভের ব্যাপারে তারা সবাই দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। সরেজমিন গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে মনোনয়ন দৌড়ে আজমত উল্লাহ খান ও জাহাঙ্গীর আলমের শক্ত অবস্থানই দেখা গেছে। সবাই ধারণা করছেন শেষ পর্যন্ত এ দুজনের যে কোনো একজন আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন লাভ করবেন। এদিকে গাজীপুরে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও পারস্পারিক বিরোধিতাপূর্ণ ক্ষোভের তীব্র বহিঃপ্রকাশও লক্ষ্য করা গেছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে এখনই এসব সমস্যার সমাধান না হলে নৌকার প্রার্থীকে বড় ধরনের খেসারত দিতে হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। নৌকার বিজয় নিশ্চিত করতে হলে এখনই সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ উদ্যোগ দেখা যায়নি। আওয়ামী লীগের প্রধান দুই সম্ভাব্য প্রার্থী আজমত উল্লাহ খান টঙ্গী ও জাহাঙ্গীর আলম গাজীপুর এলাকার বাসিন্দা। নিজ নিজ এলাকায় তাদের ভোট ব্যাংক। কিন্তু দুজনের কেউই নিজ এলাকার বাইরের ভোটারদের মন এখনো জয় করতে পারেননি। এদের মধ্যে একজন দলীয় মনোনয়ন লাভ করলে অন্যজন তার নিজ এলাকায় দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করবেন না বলেও এলাকাবাসী মনে করেন। গাজীপুরের বাসিন্দারা মনে করেন, জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে জাহাঙ্গীর আলমের অবস্থা ভালো। তিনি যোগ্য প্রার্থী। তাই তাকেই এবার দলীয় মনোনয়ন দেয়া উচিত। অন্যদিকে টঙ্গী এলাকার বাসিন্দারা মনে করেন, আজমত উল্লাহ খানের জনপ্রিয়তা বেশি। দক্ষতা ও যোগ্যতার দিক থেকে তিনিই যোগ্য প্রার্থী। এ জন্য তাকেই দলীয় মনোনয়ন দেয়া উচিত। স্থানীয় বাসিন্দারা এভাবেই প্রার্থী মনোনয়ন করছেন। তবে গাজীপুর জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা এবারো আজমত উল্লাহ খানের পক্ষে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন। গাজীপুর আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দলের বিষয়টি কেন্দ্রীয়, জেলা ও মহানগর পর্যায়ের নেতাদের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার পরও তারা মনে করেন, মেয়র পদে মনোনয়নের বিষয়টি পুরোপুরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে। তিনি মনোনয়ন বোর্ডের সঙ্গে আলোচনার পর চূড়ান্ত মনোনয়ন ঘোষণা করবেন। গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য এডভোকেট আব্দুল হাদী শামীম বলেন, দক্ষ ও যোগ্যতার নিরিখে আজমত উল্লাহ খান মনোনয়ন পাওয়ার অন্যতম দাবিদার। আবার জাহাঙ্গীর আলম সব সময় মাঠে ছিলেন। দুজনেরই জনপ্রিয়তা আছে। বড় দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকবে। এখানেও আছে। তবে গতবারের পরাজয়ের কারণে আওয়ামী লীগের অনেক ক্ষতি হয়েছে। গতবার অনেক ভুলত্রুটি ছিল। এবার তা হবে না। আমরা মনে করি, যার ওপর আস্থা রাখা যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমন একজনকেই গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দেবেন। সবাই যদি রাগ-ক্ষোভ ভুলে এক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করতে পারেন, তাহলে এবার বিপুল ভোটের ব্যবধানে নৌকার বিজয় হবে। গাজীপুর মহানগর ও জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করেন, নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসবে নৌকার জনপ্রিয়তা ততই বাড়বে। মেয়র মান্নান গত ৫ বছরে এলাকার উন্নয়নে কোনো একটি উল্লেখযোগ্য প্রকল্প হাতে নেননি। কোথাও কোনো উন্নয়ন কাজ হয়নি। এলাকার মানুষ উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত রয়েছে। এ কারণে এবার আওয়ামী লীগের ওপর ভোটারদের আস্থা বেড়েছে। তা ছাড়া গাজীপুরের নির্বাচনের ফলাফল আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে বলেও তারা ধারণা করেছেন। সম্ভাব্য প্রার্থীরা কেউ প্রকাশ্যে, কেউ ঘরোয়াভাবে আবার কেউ কেউ বিচ্ছিন্নভাবে ভেতরে ভেতরে প্রচারণা চালাচ্ছেন। গাজীপুরের সর্বত্র আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের তৎপরতা সবচেয়ে বেশি নজরে এসেছে। টঙ্গী থেকে গাজীপুর সদর পর্যন্ত আজমত উল্লাহ খান, জাহাঙ্গীর আলম, সাইফুল ইসলামের বড় বড় পোস্টার রাস্তার দুপাশে শোভা পেতে দেখা গেছে। আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের মধ্যে গতবারের পরাজিত প্রার্থী আজমত উল্লাহ খান প্রচার-প্রচারণা ও দলীয় লবিংয়ে বেশ এগিয়ে আছেন। প্রতিদিন ভোর থেকেই আজমত উল্লাহ খানের বাসার চেম্বারে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও শুভাকাক্সক্ষীদের ভিড় দেখা যায়। প্রতিদিনই তিনি শত শত নেতাকর্মীর সঙ্গে নির্বাচনী বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন। গত ২৪ মার্চ সকালে গাজীপুরের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজনকে ফুলের তোড়া দিয়ে শুভেচ্ছা জানাতে দেখা যায়। আজমত উল্লাহ খানের দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত হওয়ার খবর পেয়েই নেতাকর্মীরা তাকে ফুলের শুভেচ্ছা জানান বলে কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। নেতাকর্মীরা ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ তথ্য ও ছবি প্রচার করছেন। আজমত উল্লাহ খান সবাইকে নৌকার পক্ষে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। দলের ভেতরে যেন কোনো ধরনের বিরোধ না থাকে সে লক্ষ্যে তিনি গাজীপুর জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গেও আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। ভোরের কাগজ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, আমি এবারো দলীয় মনোনয়ন পাব বলে আশাবাদী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে এলাকায় কাজ করতে বলেছেন। কে দলীয় প্রার্থী হবেন তা প্রধানমন্ত্রীই চূড়ান্ত করবেন। আমি নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। এদিকে আওয়ামী লীগ দলীয় মনোনয়নের অন্যতম দাবিদার গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমও প্রচার-প্রচারণায় পিছিয়ে নেই। গাজীপুরের বিভিন্ন স্থানে তিনি বেশ জোরেসোরেই প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার ঘনিষ্ঠজনেরা জানিয়েছেন, জাহাঙ্গীর আলম সম্প্রতি দলের ভেতর থেকে সবুজ সংকেত পেয়েছেন। তাকে এলাকায় কাজ করতে বলা হয়েছে। বিভিন্ন ওয়ার্ডে তিনি ও তার সমর্থক নেতাকর্মীরা প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। ভোরের কাগজের সঙ্গে আলাপকালে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, গাজীপুরের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের আমি নৌকার পক্ষে ঐক্যবদ্ধ করেছি। নির্বাচনের ব্যাপারে সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। গত নির্বাচনে প্রার্থী হতে না পারলেও দলের জন্য সব সময় কাজ করেছি। গত ৫ বছর আমি মাঠেই ছিলাম। বিভিন্ন সামাজিত ও দলীয় কার্যক্রম চালিয়েছি। ‘জাহাঙ্গীর আলম শিক্ষা ফাউন্ডেশনের’ মাধ্যমে শিক্ষা, যানজট নিরসন ও দরিদ্র মানুষের জন্য অনেক কাজ করেছি। যানজট নিরসনে এই ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে বিপুলসংখ্যক কর্মী বাহিনী রাস্তায় নামিয়েছি। দরিদ্র মানুষকে সব ক্ষেত্রে সহযোগিতার চেষ্টা করেছি। গাজীপুরে দলের সব কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম। আমি সব সময়ই মাঠে ছিলাম। দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে ছিলাম। আমিই নৌকার বিজয় নিশ্চিত করতে পারব। এসব কারণেই আমি এবারো প্রার্থী হয়েছি। এবার দল থেকে আমাকেই গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেয়া হবে বলে আমি আশা করি। মনোনয়ন দৌড়ে পিছিয়ে নেই যুবলীগ নেতা সাইফুল ইসলাম। সাবেক এই ছাত্রলীগ নেতাও এবার প্রথমবারের মতো দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার জন্য জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে তিনি আত্মবিশ^াসী। আধুনিক গাজীপুর গড়ার প্রত্যয় নিয়ে অনেকদিন ধরেই সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে উন্নয়নমূলক কাজ চালিয়ে আসছেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর চেতনায় অন্তরে ধারণ করে গাজীপুরে টেকসই উন্নয়ন করার জন্য ভোটারদের কাছে অঙ্গীকার করছেন। আরেক যুবলীগ নেতা রাসেল সরকার, মেয়র এম এ মান্নানের অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ওয়ার্ড কাউন্সিলর আসাদুজ্জামান কিরন, মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও প্রয়াত আহসান উল্লাহ মাস্টারের ছোট ভাই মতিউর রহমান মতিও এবার গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন দৌড়ে রয়েছেন। তবে শেষ পর্যন্ত কার ভাগ্যে শিকে ছিঁড়বে তা দেখার জন্য আরো কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App