×

জাতীয়

নিরাপত্তা নয় মুনাফায় নজর বেসরকারি বিমান সংস্থার

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ মার্চ ২০১৮, ১০:৪৩ এএম

নিরাপত্তা নয় মুনাফায় নজর বেসরকারি বিমান সংস্থার
দেশের বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলো যাত্রীদের নিরাপত্তার চেয়ে নিজেদের মুনাফাকেই বড় করে দেখছে। কম বিনিয়োগে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের জন্য পুরনো এয়ারক্রাফট আনা, কম অভিজ্ঞতাসম্পন্ন পাইলট, ফার্স্ট অফিসার নিয়োগ, ঝুঁকিপূর্ণভাবে অতিরিক্ত ফ্লাইট পরিচালনাসহ নানা অভিযোগ উঠেছে সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে। গত সোমবার নেপালে ইউএস-বাংলার বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার পর এসব আলোচনা এখন সামনে চলে এসেছে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) ভূমিকা নিয়েও। অভিযোগ রয়েছে, বিমান প্রতিষ্ঠানের সুনাম রক্ষা ও মুনাফার জন্য পাইলটদের মানসিক, ব্যক্তিগত, পারিবারিক চাপ কিংবা শারীরিক অসুস্থতাকে আমলে নেয়া হচ্ছে না। এতে বিমান চালনায় ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। দুর্ঘটনার দিন গত সোমবারই ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতান ঢাকা-চট্টগ্রামের আরো দুটি ফ্লাইট পরিচালনা করেছিলেন। এরপর ওই দিনের তৃতীয় ফ্লাইট নিয়ে তিনি নেপালের কাঠমান্ডুর উদ্দেশে রওনা হন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অভিজ্ঞ পাইলট জানান, কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ একটি বিমানবন্দর। পাহাড়ঘেরা এই বিমানবন্দরে বিমান ওঠানামা করাতে গিয়ে পাইলটকে বেশ দক্ষতার পরিচয় দিতে হয়। এ জন্য তাকে মানসিক ও শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ প্রস্তুত ও স্বাচ্ছন্দ্য থাকতে হয়। যেদিন ত্রিভুবন বিমানবন্দরে ফ্লাইট থাকে সে দিন আর কোনো ফ্লাইট পরিচালনা করেন না তারা। একান্তই যদি করতে হয় তবে সেখান থেকে ফিরে অন্য কোনো রুটের রওনা করেন। কখনোই আগে নয়। কিন্তু ক্যাপ্টেন আবিদকে আগে দুটি ফ্লাইট পরিচালনার পরও কেন ত্রিভুবনে পাঠানো হলো- সে প্রশ্ন থেকেই যায়। তিনি বলেন, দুর্ঘটনার আগে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সঙ্গে পাইলটের কথোপকথন শুনে তার মনে হয়েছে, ওই দিন ক্যাপ্টেন আবিদ মানসিক ও শারীরিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন। যে কারণে তিনি ঠিক মতো টাওয়ারের কথাগুলো ধরতে পারছিলেন না। এর আগে তিনি ইউএস-বাংলা থেকে পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন বলে শোনা যাচ্ছে। যদি এমনটি হয়, তবে ওই দিন তাকে ফ্লাইটটি পরিচালনা করতে দিয়ে ইউএস-বাংলা কর্তৃপক্ষ খুবই গর্হিত কাজ করেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। বিমান-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে বেশ কয়েকটি নতুন বিমান থাকলেও দেশের অন্য সব বিমান ও হেলিকপ্টারই পুরনো। উন্নত বিভিন্ন দেশে ১৫-২০ বছর ব্যবহারের পর তাদের কাছ থেকে ভাড়ায় এনে বা কম দামে কিনে এয়ারক্রাফট নিয়ে আসে দেশের বিমান সংস্থাগুলো। ফলে প্রায় সময়ই ছোট-খাটো অনেক দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু মুনাফার জন্য বিমান সংস্থাগুলো যেভাবে নিরাপত্তার বিষয়ে আপস করে চলেছে, তাতে যে কোনো সময় বড় দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা ক্রমেই বাড়ছে। অবসরপ্রাপ্ত বৈমানিক ইকরামুল ইসলাম রানা জানান, দেশে সরকারি বিমান সংস্থার সঙ্গে বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলোর বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা রয়েছে। যাত্রীসেবার মান ও মুনাফার দিক দিয়ে বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলো অনেক এগিয়ে। কিন্তু নিরাপত্তার ঝুঁকিতেও এগিয়ে রয়েছে তারা। তিনি বলেন, বাংলাদেশ বিমানের লাভক্ষতি নিয়ে সরাসরি পাইলটদের চাপে ফেলতে পারে না কর্তৃপক্ষ। ফলে সামান্য ঝুঁকি দেখলেও বাংলাদেশ বিমানের পাইলটরা বিমান পরিচালনা করতে আপত্তি জানাতে পারেন। কিন্তু বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলোর পাইলটরা এ ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের ব্যাপক চাপে থাকেন। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া, কুয়াশা বা নিজের নানা অসুবিধা থাকলেও তাদের ঝুঁকি নিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করতে হয়। ফ্লাইট বাতিল হলে প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষুণœ হওয়ার দায় নইলে তাদের ঘাড়েই বর্তায়। সূত্রমতে, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স ২০১৪ সালের ১৭ জুলাই প্রথমে যশোর-ঢাকা-যশোর রুটে ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করে। বর্তমানে অভ্যন্তরীণ রুটে তাদের ৩২টি ফ্লাইট চলাচল করছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক ফ্লাইটও রয়েছে তাদের। তাদের বহরে নতুন কোনো বিমান নেই। বিমানের তুলনায় পাইলট ও কর্মকর্তার সংখ্যাও কম বলে জানা গেছে। আরেকটি বেসরকারি সংস্থা নভোএয়ার ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে যাত্রা শুরু করে। এর উড়োজাহাজের সংখ্যা ৫টি। দৈনিক পাঁচটি অভ্যন্তরীণ রুটে তাদের ১৬টি ফ্লাইট চলছে। নভোএয়ারের বিমানগুলো ৮ থেকে ১৬ বছরের পুরনো। একই অবস্থা রিজেন্টএয়ারসহ কার্গো পরিচালনাকারী দেশের অন্য বিমান সংস্থাগুলোরও। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সাবেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এয়ার কমোডর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী বলেন, একটি বিমান চলাচলের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ ও বাইরের অনেক বিষয় যুক্ত থাকে। এর মধ্যে বিমানের কারিগরি দিক, পাইলটের দক্ষতা, বাইরের আবহাওয়া ইত্যাদি রয়েছে। এসবই নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত। তিনি বলেন, পুরনো বিমান হলেও যদি আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী বিমানটিকে ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় তবে তা নিরাপদ হতে পারে। কিন্তু যদি পাইলটের মানসিক বা শারীরিক অবস্থা ঠিক না থাকে, তবে তো ঝুঁকি থাকবেই। আবার দেখা গেল পাইলট দক্ষ ও মনোযোগী, কিন্তু আবহাওয়া বিরূপ। তখন ঝুঁকির প্রশ্ন আসবে। মোট কথা, যে কোনো ক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিষয়কে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে কিনা তা আগে দেখতে হবে। মুনাফা এখানো মুখ্য হতে পারে না বলে মন্তব্য করেন তিনি। বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে যাত্রীবাহী এয়ারলাইন্স ব্যবসা পরিচালনার প্রথম অনুমতি দেয়া হয় ১৯৯৬ সালে। বেসরকারি খাতে যাত্রীবাহী এভিয়েশন ব্যবসার ২০ বছরের যাত্রায় এ পর্যন্ত মোট ৯টি এয়ারলাইন্স কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি পায়। তবে অপেশাদারি মনোভাব, পুরনো উড়োজাহাজ দিয়ে ব্যবসা পরিচালনার পরিকল্পনা, এভিয়েশন ব্যবসায় অনভিজ্ঞতা, দুর্বল পরিচালনা, প্রতিক‚ল সরকারি নীতিসহ নানা কারণে বন্ধ হয়ে যায় ছয়টি এয়ারলাইন্স। এখন ইউএস-বাংলা, নভোএয়ার ও রিজেন্টএয়ার যাত্রী পরিবহন করছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App