×

মুক্তচিন্তা

প্রশ্নফাঁস আর কোচিং বাণিজ্যে শিক্ষায় অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

Icon

মুক্তচিন্তা কলাম লেখক

প্রকাশ: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১০:৩৮ পিএম

শিক্ষায় সরকারের নতুন নতুন উদ্যোগ সত্তে¡ও প্রত্যাশিত অর্জন ব্যাহত করছে কিছু ক্ষতি অনুষঙ্গযুক্ত হওয়ায়। এসব ক্ষতির অনুষঙ্গ থেকে পরিত্রাণে সরকারি উদ্যোগকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে। এর একটি হচ্ছে কোচিং বাণিজ্য। সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে যুক্ত হয়েছে পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস। বিশেষ করে প্রাথমিক (পিইসি), অষ্টম শ্রেণি (জেএসসি), এসএসসি, এইচএসসিসহ প্রায় সব পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এখন দেশব্যাপী এসএসসি পরীক্ষা চলছে। এই পরীক্ষায়ও চলছে প্রশ্নফাঁসের মহড়া। অবশ্য শিক্ষামন্ত্রী প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে ৫ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। পরীক্ষা শুরুর আগেই ঘোষণা দিয়ে কোচিং সেন্টার বন্ধ করা হলেও বাস্তবে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়নি। এ দুটোর কোনোটিই কার্যকর হয়নি।

কোচিং ও প্রশ্নফাঁসের এই সর্বনাশা খেলায় পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ এবং বিতর্কিত করে তুলেছে। এ কারণে প্রকৃত মেধা, সৃজনশীলতার বিকাশকেও বাধাগ্রস্ত করছে। কোচিং বাণিজ্য, গাইড বই বাণিজ্য, প্রশ্নফাঁস প্রভৃতির ভয়াল থাবা সুদূর শহর থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চল অবধি বিস্তৃত। এতে শহর আর গ্রাম সর্বত্রই শিক্ষায় বিপর্যয়, মেধা মননের বিপর্যয়কে প্রতিহত করে প্রকৃত মেধার বিকাশের ক্ষেত্রে অনৈতিকভাবে সর্বনাশা এসব প্রবণতা অব্যাহত থাকায় ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি দুষ্ট ক্ষত নিয়েই বেড়ে উঠছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থী, অভিভাবক, তথা ধ্বংসের পথে পুরো জাতি। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, শিক্ষাব্যবস্থার জন্য দুষ্ট ক্ষত কোচিং বাণিজ্য। বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা-সমালোচনা চলছে, চলছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রভৃতি। সর্বনাশা কোচিং বাণিজ্য এবং প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে কার্যকর উদ্যোগ অপরিহার্য হলেও বাস্তবে এর প্রতিফলন নেই।

এটি সত্য যে, শিক্ষকদের বড়সড় অংশ এই শিক্ষাবাণিজ্যে, কোচিং বাণিজ্যে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে অধিকাংশ শিক্ষকনীতি, নৈতিকতা, বিধিবিধান পরিপন্থী পথে শুধু নিজের অর্থ, বিত্ত, বৈভব গড়ার স্বার্থের কাছে দেশের সম্ভাবনাময় তরুণ, যুবগোষ্ঠীকে ঠেলে দিচ্ছে কোচিংয়ের মতো বাণিজ্যের দিকে। এসব শিক্ষক তাদের ওপর অর্পিত গুরুদায়িত্ব বাদ দিয়ে, স্কুলে পাঠদানের পরিবর্তে কোচিং, গাইড বাণিজ্য, গাইড রচনায় লিপ্ত। এ কারণে মনোযোগ দিচ্ছে না ক্লাসে শিক্ষাদানে। একইভাবে পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণে নতুন প্রজন্মকে প্রকৃত মেধা, মনন যাচাইয়ের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করছে।

এটা সত্যি যে, কোচিং বাণিজ্যের কাছে, কোচিং সেন্টারের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, স্কুল-কলেজে কোনোরকম হাজিরা দিয়েই শিক্ষার্থীদের ছুটতে হয় কোচিং সেন্টারে। অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে বলা যায়, বর্তমানে স্কুল-কলেজের বদলে কোচিং সেন্টারগুলোই হয়ে উঠেছে মূল ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান’। শিক্ষকদের একটি বড় অংশ জড়িয়ে পড়েছে এ ব্যবসায়। এতে লাভ বেশি, তাই তারা ক্লাসে শিক্ষা প্রদানে মনোযোগী নন। এ অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই ভেঙে পড়বে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। কারণ এর ফলে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ বাড়ছে। অপরদিকে মান কমছে শিক্ষার। কোচিং নির্ভরতার কারণে শিক্ষার্থীদের সৃজনী ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তবে স্বীকার করতে হয়, এ কালে পাঠ্য বিষয় বেড়েছে, সৃজনশীলতার নামে শিক্ষার্থীর ওপর চাপ বেড়েছে আগেকার তুলনায় অনেক বেশি। কিন্তু সে চাপ মুক্তির জন্য তো শিক্ষকরা রয়েছেন, বরং আগের তুলনায় এখন শিক্ষক, শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা প্রভৃতি বেড়েছে।

আবার অনেক সময় বছর বছর সিলেবাস পরিবর্তনের প্রতি বছর নতুন সিলেবাস, নতুন কারিকুলাম, সৃজনশীলের নামে শিক্ষার্থীদের ওপর নতুন করে বোঝা চাপিয়ে দিয়ে অনেকটা বাধ্য করা হয় গাইড, নোট প্রভৃতির দ্বারস্থ হতে। এ জন্যও অভিভাবকদের গুনতে হয় বিপুল অর্থ। সৃজনশীলের নামে প্রতি বছর নতুর নতুন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করায় অনেক গরিব, অসহায় মানুষ বাধ্য হয়ে তাদের সন্তানদের গাইড বই কেনা, কোচিং বাণিজ্যের মুখোমুখি হতে হয়। অনেক অভিভাবকের অভিযোগ, শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কোচিংবিষয়ক সরকারি নীতিমালা প্রকারান্তরে কোচিং বাণিজ্যকে সমর্থনই নয়, বরং নির্ভরশীল হতে সাহায্য করছে। এ কারণে শুধু যে অভিভাবকের ওপর অর্থনৈতিক চাপ বাড়ছে তাই নয়, শিক্ষার্থীর জ্ঞানও সীমাবদ্ধ হচ্ছে। আবার কোচিংয়ের আড়ালে নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ড চলছে। কোচিংয়ে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে রয়েছে ছাত্রীদের যৌন হয়রানির অসংখ্য অভিযোগ। কোচিং সেন্টার পরিচালনাকারীদের বিরুদ্ধে প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগ আছে। অনেক কোচিং সেন্টারের বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদসহ স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচারেরও অভিযোগ আছে।

২০১২ সালের ২০ জুন কোচিং বাণিজ্য বন্ধের নীতিমালার প্রজ্ঞাপন জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়, সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা নিজ প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের কোচিং করাতে বা প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না। উল্লেখ্য, পিইসি, জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি পর্যায়ে সর্বনাশা কোচিং বাণিজ্য, প্রশ্নফাঁসের বেড়াজালে আক্রান্ত। কিন্তু এ পথ বাস্তবিক অর্থে সাময়িক ভালো ফল হলেও কর্মজীবনে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পর্যায়ে কাজে আসে না। এমনি অবস্থায় প্রশ্নফাঁস, কোচিং বাণিজ্য বন্ধে প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন, প্রয়োজন সরকারের কঠোর হস্তক্ষেপ। নতুবা এ ব্যবস্থায় আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে উঠবে খোঁড়া প্রজন্ম হিসেবে আর শিক্ষাব্যবস্থাকে করছে প্রতিবন্ধী।

ফারিহা হোসেন : লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App