×

মুক্তচিন্তা

সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনে দুর্বৃত্তায়ন

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ০৭:৫২ পিএম

মূল্যবোধ স্খলিত লোকজনের সমাজে প্রভাব-প্রতিপত্তির দাপট মূল্যবোধের কফিনে শেষ পেরেকটি মারছে। মূল্যবোধ ধ্বংসের ব্যবস্থাদি ধারণ-লালনের নেতিবাচক প্রভাবে সামাজিক অবক্ষয় ভয়াবহ রূপে আবির্ভূত হয়েছে এই ফেসবুক-সভ্যতার কালে। সামাজিক অবক্ষয় যেভাবে বাড়ছে তা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে সমাজ আরো ভেঙে পড়বে।

রাজনীতিতে তো বটেই, বাংলাদেশের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এখন রীতিমতো দুর্বৃত্তায়ন শুরু হয়েছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ভাড়াটে লোক নিয়ে আসা হচ্ছে। যারা আসলে সাহিত্য-সংস্কৃতির কিছুই জানে না। বুঝে না। এমন কিছু নব্য ‘সাহিত্যিক-সংস্কৃতিসেবী’ তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের সর্বত্র। তারা অর্থের বিনিময়ে পদক দিয়ে থাকেন। কিন্তু সাহিত্য-ভাষা-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ভাড়া করে লোক নিয়ে আসা বাংলাদেশে নতুন সংযোজন।

সম্প্রতি এমন একটি ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। বাংলাদেশের শীর্ষ কয়েকজন বুদ্ধিজীবী-ভাষা সৈনিককে সংবর্ধনা দিয়েছে ‘বাংলাদেশ ইতিহাস ঐতিহ্য কেন্দ্র’ নামের একটি সংগঠন। এর সভাপতি জনৈক সরদার সেলিম রেজা। জিটিভি তা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রচার করেছে। তাতে দেখা যায়, দর্শক সারিতে হাতে গোনা কয়েকজন লোক বসে আছেন। তাদের দেখতেই ছিন্নমূল মনে হয়। তারা টিভিকে জানান, তারা ৫০ থেকে ১০০ টাকা পেয়ে এমন অনুষ্ঠানে ভাড়ায় আসেন। ফুটেজে দেখা যায় আহমদ রফিক, কামাল লোহানীর মতো বরেণ্য ব্যক্তিরা বসে বক্তব্য রাখছেন। আর দর্শক-শ্রোতারা বসে নেশাচ্ছন্ন মানুষের মতো ঝিমোচ্ছেন। গুগল আর্কাইভ থেকে দেখা যায় এর আগে এই সংগঠনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে বক্তব্য রেখেছেন রাহাত খান, ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, অধ্যাপক ড. নিগার চৌধুরী প্রমুখ। আমার প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের বরেণ্য ব্যক্তিরা আয়োজকদের বিষয়ে বিস্তারিত না জেনে এমন অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন কী করে?

বাংলাদেশে পদক ব্যবসা নতুন নয়। অনেক আজব আজব নামে এই ব্যবসা শুরু হয়েছে বেশ আগে থেকেই। শেরেবাংলা পদক, অতিশ দীপঙ্কর পদক, সোহরাওয়ার্দী পদক, এম এ জি ওসমানী স্বর্ণপদক, ইবনে বতুতা স্বর্ণপদক, মাদার তেরেসা স্বর্ণপদক, কাজী নজরুল ইসলাম স্বর্ণপদক, মহাকবি কায়কোবাদ স্বর্ণপদক, নবাব সিরাজউদ্দৌলা স্বর্ণপদক, বিজ্ঞানী স্যার জগদীশচন্দ্র বসু স্বর্ণপদক, এমন অনেক নামের পদক এখন বাংলাদেশে। আমরা জানি, এসব পদক ও পুরস্কারের অনেকগুলোরই জাতীয় কোনো মর্যাদা নেই। ঘরের শোভা বৃদ্ধি ছাড়া এসব পুরস্কারের কোনো সামাজিক মূল্যও নেই। যেসব প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এসব পুরস্কার দেয়া হয় সেসব প্রতিষ্ঠানকে কেউ চিনেও না। এরপরও এক শ্রেণির মানুষ সামাজিক স্বীকৃতি হিসেবে এসব পুরস্কার গ্রহণ করছে। এক শ্রেণির মানুষ এদের ডোনার। তারা বড় বড় অর্থ চাঁদা দিয়ে থাকেন। কেন তারা এই অর্থ ব্যয় করেন, তা তারাই জানেন। নিশ্চয় এর পেছনে কোনো মতলব রয়েছে।

খুবই হতাশার কথা হচ্ছে, এক শ্রেণির তথাকথিত সাংবাদিক এবং পেশাজীবী সংগঠনের নামে রাজনৈতিক সুবিধাবাদী গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। এ তথাকথিত সংগঠনগুলোর নীতি-আদর্শ বলতে কিছু নেই। সরকার দলের কর্মী ও অনুসারী পরিচয় দিয়ে নানা ধরনের সুবিধা আদায়ের অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে কিছু ব্যক্তি। আসলে তারা কোনো প্রকৃত সাংবাদিক নয় কিংবা সরকারি দলের কোনো নেতা বা কর্মীও নয়। তাদের মূল লক্ষ্য হলো এর মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করা। পদক কিংবা সংবর্ধনা দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে উঠতি কিছু স্বঘোষিত নেতা ও ব্যবসায়ীর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে পদক বাণিজ্যে লিপ্ত রয়েছে এ রকম অনেক সংগঠন। এরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মন্ত্রী, এমপিকে নিয়ে আসে। আবার এরা মন্ত্রী, এমপিদের নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি করে চলে। সরকার দলের কোনো মন্ত্রী, এমপি এসব চাঁদাবাজদের আমন্ত্রণ গ্রহণ করে তাদের ধান্ধাবাজির অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি বা বিশেষ অতিথির আসন অলঙ্কৃত করলে ভুঁইফোড় সংগঠনগুলো এক ধরনের বৈধতা লাভ করে।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এখন রাষ্ট্রক্ষমতায়। এর আগে বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন তাদের নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অনেকেই এমনটি করেছে। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলের সহযোগী ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন রয়েছে নয়টি। এর বাইরে অন্য কোনো সংগঠনের দলীয় পরিচয় ব্যবহার করার কারো এখতিয়ার নেই। অথচ অনেক ভূঁইফোড় সংগঠন দলের সহযোগী ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন হিসেবে দাবি করে।

আসলে এসব কী হচ্ছে? এর কোনো জবাব নেই। কেউ জানে না এরা আসলে কেমন সংস্কৃতিসেবী। আরো ভয়াবহ কথা হচ্ছে- মাদক, ইয়াবা, অস্ত্র ব্যবসায়ী, ভূমিদস্যু, চাঁদাবাজ, নামধারী শিক্ষক, সন্ত্রাসীকে টাকার বিনিময়ে এওয়ার্ড প্রদান করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এসব পদক দেয়া হয় তাদের কাছ থেকে ওই সংগঠনের নেতারা মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন। স্বর্ণপদক দিতে ৫০ হাজার, রৌপ্যপদক দিতে ৩০ হাজার আর সম্মাননা ক্রেস্ট দেয়া হলে তার জন্য ১০/১৫ হাজার টাকা করে নেয়া হয়। তবে কথিত স্বর্ণপদকে এক রতি, রৌপ্য পদকে ৪ আনা রুপা দেয়া হয়। আর ক্রেস্ট তৈরিতে লাগে ৫০০-৮০০ টাকা। এমন খবর বিভিন্ন মিডিয়ায় বারবার ছাপা হয়েছে। খরচ বাদে পুরোটাই যায় আয়োজকদের পকেটে। ভুঁইফোড় পদক কমিটির একাধিক সদস্য বলেছেন, অনেক ব্যক্তি আছে যাদের অপকর্ম আড়াল করতে এই পদক নিচ্ছে এবং দিচ্ছে। কারণ তাদের সমাজে সুখ্যাতি কম। তারা সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী ও বিশিষ্ট জনদের হাত থেকে পদক নিয়ে ‘গর্বিত’ হন। ব্যক্তিগত সম্পর্কের সূত্র ধরে অতিথি নির্বাচন করে আমন্ত্রণ জানানো হয়। হলরুম ভাড়া করা হয়। ছাপানো হয় আমন্ত্রণপত্র। পদক বিতরণের আগের দিন সব গণমাধ্যমে চিঠি পাঠিয়ে রিপোর্টার ও ক্যামেরাম্যান এসাইনমেন্ট চাওয়া হয়।

দুর্বৃত্তায়নের অর্থনীতি বাঙালির মূল্যবোধকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। মূল্যবোধ স্খলিত লোকজনের সমাজে প্রভাব-প্রতিপত্তির দাপট মূল্যবোধের কফিনে শেষ পেরেকটি মারছে। মূল্যবোধ ধ্বংসের ব্যবস্থাদি ধারণ-লালনের নেতিবাচক প্রভাবে সামাজিক অবক্ষয় ভয়াবহ রূপে আবির্ভূত হয়েছে এই ফেসবুক-সভ্যতার কালে। সামাজিক অবক্ষয় যেভাবে বাড়ছে তা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে সমাজ আরো ভেঙে পড়বে।

সামাজিক অবক্ষয় থেকে রক্ষা পেতে পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রকেই দায়িত্বশীল হতে হবে। মূল্যবোধের অবক্ষয়ের গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেয়াতেই আজকের এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ সব সময়ই খ্যাতি চায়। কিন্তু এর প্রক্রিয়া কী? আধুনিকতা ও প্রগতিশীলতার দোহাই দিয়ে বহু ক্ষেত্রে মূল্যবোধের অবক্ষয় উৎসাহিত করা হচ্ছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে চাওয়া-পাওয়ার বাসনার অদম্যতা সমাজকে অস্থির করে তুলেছে। মানুষ সামাজিক জীব। সামাজিক জীব মানুষ সমাজে শান্তিপূর্ণ বসবাস চায়। কিন্তু তা যেন রহিত হয়ে পড়ছে দিনে দিনে খ্যাতির তালাশে। আমরা ভুলিনি, সামাজিক প্রয়োজনেই সামাজিক অবক্ষয়ের আগ্রাসন থেকে সমাজকে রক্ষা করতে হয়। কিন্তু খ্যাতি খোঁজে অবক্ষয় যেভাবে বাড়ছে তাতে উদ্বিগ্ন না হয়ে উপায় নেই। একই অবস্থা বিদেশেও। অর্থের কাছে মেধা হেরে যাচ্ছে। অর্থ দিয়ে পদক কেনা হচ্ছে বিদেশেও। বয়স তার বিশের কোটায়। অথচ নিজেই লিখে ফেলছে নিজের আত্মজীবনী।

আমাদের বড় বড় লেখকরা খুব সহজেই কোনো অখ্যাত কাউকে ‘প্রিয় লেখক অমুক’ বলে অটোগ্রাফ দিয়ে দিচ্ছেন। এভাবে সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে পরগাছা বাড়ছে। অথচ মেধাবীরা আজীবন লেখালেখি করেও সামান্যতম সামাজিক স্বীকৃতি পাচ্ছেন না। বিত্তের কাছে পরাজিত সভ্যতা নিয়ে কোনো জাতি এগোতে পারে না। বাংলাদেশ আজ তেমনি একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। বিশ্বজুড়েই এক স্থবিরতা চলছে। এমন ক্রান্তিকালে মানুষে-মানুষে, শ্রেণিতে-শ্রেণিতে মানুষের মানবিক বোধ জাগ্রত করতে হবে। বিবেকবান মানুষকে সেই লড়াই-সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। শুধু অতীতের ঐতিহ্য নয়, ভবিষ্যৎ সাহিত্য-শিল্পের পথ দেখাতে বুদ্ধিজীবীদের এগিয়ে আসতে হবে।

সাংস্কৃতিক গণজাগরণ ছাড়া আমাদের সামাজিক উন্নতি সম্ভব নয়। সংস্কৃতির ব্যাখায় ড. আহমদ শরীফ আরো লিখেছিলেন- ‘বাঞ্ছিত সংস্কৃতি হচ্ছে সমাজে স্বাধিকারে সমস্বার্থে সহিষ্ণুতায় সহযোগিতায় সহাবস্থানের আগ্রহ নিয়ে আবিষ্কারে, উদ্ভাবনে, নির্মাণে কিংবা গ্রহণে-বর্জনে নব নব চিন্তা-চেতনার অনুশীলনে মানবসম্পদ বৃদ্ধির এবং যন্ত্রের ও বস্তুর উৎকর্ষযোগে ব্যবহারিক জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য-স্বাচ্ছল্য সুরুচি-সৌন্দর্য বৃদ্ধির প্রয়াস চালানো এবং ভাব-চিন্তা-কর্ম-আচরণে হিংসা-ঘৃণা-ঈর্ষা-অসূয়া-জুলুম প্রভৃতির প্রভাবমুক্ত থাকা। এ অর্থে সক্রিয় সৌজন্যই সংস্কৃতি। যুক্তিনিষ্ঠ ন্যায়বানই সুজন এবং সুজনমাত্রই তাই সংস্কৃতিবান’।

আমাদের আজকের বাংলাদেশে তা কতটা প্রতিপালিত হচ্ছে? আমাদের রাজনীতিক, অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, পেশাজীবীরা তা কতটা মানছেন! বাংলাদেশে সংস্কৃতির সংগ্রাম শেষ হওয়ার নয়। কালো শক্তিকে দমাতে গণমানুষকে মাঠে থাকতে হবে। সংস্কৃতির নতুন এ ‘স্বাধীনতা সংগ্রামের’ জন্য দেশের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ধর্ম ব্যবসায়ীরা টাকার বিনিময়ে মানুষ কিনছে। এটি দেশের সংস্কৃতির জন্য বড় বিপদের কথা। সংস্কৃতি কর্মীদের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষদের কাছে যেতে হবে।

এই ভাষা আন্দোলনের মাসে সাংস্কৃতিক দুর্বৃত্তায়ন ঠেকানোই হোক আমাদের প্রত্যয়।

ফকির ইলিয়াস : কবি, সাংবাদিক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App