×

মুক্তচিন্তা

বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাভাষার ভবিষ্যৎ

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১০:৩৬ পিএম

দরকার নতুন সাহিত্য আন্দোলন এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে নতুন আন্দোলন। দরকার জাতির ও জনজীবনের, সভ্যতা ও সংস্কৃতির নবজন্ম। দরকার উন্নত নতুন ভবিষ্যৎ সৃষ্টির জন্য নতুন ইশতেহার ও নতুন কর্মযজ্ঞ। বাংলাদেশ, বাংলাভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির সামনে আছে অত্যুজ্জ্বল নতুন ভবিষ্যৎ।

নবযুগের প্রত্যাশায়

এক. ঐতিহাসিককালে মানব প্রজাতির বেলায়, জীবনের সঙ্গে ভাষার এবং ভাষার সঙ্গে জীবনের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। মানুষের জীবন ছাড়া ভাষা এবং ভাষা ছাড়া মানুষের জীবন কল্পনাতীত। মানুষের বেলায় জীবন উন্নত হলে ভাষা উন্নত হয়, ভাষা উন্নত হলে জীবনও উন্নত হয়। ভাষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান আর জ্ঞান-বিজ্ঞান ও ভাষা অবিচ্ছেদ্য- অভিন্ন। সাহিত্য, সঙ্গীত, চারুশিল্প ইত্যাদি সম্পর্কেও এ কথা প্রযোজ্য। ভাষা ও মানুষের জীবন এবং মানুষের জীবন ও ভাষা নিয়ে যতই চিন্তা করা যায়, তথ্য সন্ধান ও বিচার-বিশ্লেষণ করা যায়, ততই দুয়ের অবিচ্ছেদ্যতা ও অভিন্নতা সম্পর্কে ধারণা গভীর থেকে গভীরতর হয়।

মানুষ নিজের প্রয়োজনে, নিজের জৈবিক সামর্থ্যরে বলে, জীবনযাত্রার মধ্য দিয়ে নিজ নিজ ভাষা উদ্ভাবন করেছে এবং প্রয়োজনের তাগিদেই তাকে বিকশিত ও উন্নত করে চলছে। ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, রুশ, চীনা, জাপানি, সংস্কৃত, হিব্রু, লাতিন, বাংলা, উর্দু, ফারসি, আরবি প্রভৃতি ভাষার ইতিহাস সন্ধান করলে এটা বোঝা যায়। দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয় এমন মাত্র দুইশ ভাষা পৃথিবীতে আছে। এসব ভাষা বিকাশশীল। এ ছাড়া বিভিন্ন মহাদেশে অবস্থিত বিভিন্ন দেশে কয়েক হাজার ক্ষুদ্র, দুর্বল জনগোষ্ঠীর আছে যাদের ভাষা বিলীয়মান। বাংলাদেশে পঁয়তাল্লিশটি দুর্বল, ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর পঁয়তাল্লিশটি বিলীয়মান মাতৃভাষা আছে। এই পঁয়তাল্লিশটি জনগোষ্ঠীর মোট লোকসংখ্যা বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার এক শতাংশের সামান্য বেশি। পৃথিবীর এবং বাংলাদেশেরও বিলীয়মান মাতৃভাষাসমূহকে কি রক্ষা করা যাবে? বিভিন্ন মহাদেশে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর উন্নতির উপায় কী? সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো, জাতিসংঘ, ইউনেস্কো, সিভিল সোসাইটি অরগানাইজেশনগুলো ও এনজিও তাদের উন্নয়নের জন্য যে পথ প্রদর্শন করে, যেসব পরিকল্পনা গ্রহণ করে কার্যক্রম চালায়, তা কি তাদের উন্নতির ও আত্মবিকাশের সহায়ক? ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীসমূহকে নিজেদের উন্নতির জন্য পাশর্^বর্তী বৃহৎ জাতির সঙ্গে মিলে রাষ্ট্র গঠন করতে হয় এবং রাষ্ট্রভাষা শিখতে হয়। তাদের নিয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের, জাতিসংঘের ও ইউনেস্কোর নীতি ও কার্যক্রম ভুল ও অনুচিত।

বাংলাভাষাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা রূপে প্রতিষ্ঠা করার ও উন্নত করার প্রশ্ন বিবেচনা করার সময় ভাষা ও মানুষের জীবন সম্পর্কে পরিচ্ছন্ন ধারণা দরকার। তা ছাড়া মানুষের জীবনের ও ভাষার উন্নতির অর্থনৈতিক ভিত্তিও অবশ্য বিবেচ্য। কায়েমি-স্বার্থবাদীদের দিক থেকে আমাদের বিভ্রান্ত করার নানা আয়োজন আছে এবং আমাদের বিভ্রান্ত হওয়ারও অনেক সুযোগ আছে।

দুই. ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক বাস্তবতা এবং ভূরাজনৈতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া লক্ষ করে ১০৭০-এর দশকের শেষ দিক থেকেই কোনো কোনো চিন্তাশীল ব্যক্তি বলে আসছেন যে বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকার মতো (ঠরধনষব) নয়। তাদের মত কখনো আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। আমি সব সময় মনে করেছি এবং এখনো মনে করি, বাংলাদেশকে বাংলাদেশের জনগণের রাষ্ট্র রূপে গড়ে তোলা যাবে। বাংলাদেশকে বাংলাদেশের জনগণের প্রগতিশীল রাষ্ট্র রূপে গড়ে তোলার লক্ষ্যেই আমাদের সব চিন্তা ও কাজ।

তবে কিছু ঘটনা আমাদের মর্মাহত করে। সিভিল সোসাইটি অরগানাইজেশনগুলোর বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশের রাজনীতিকে বৃহৎ শক্তিবর্গের স্থানীয় দূতাবাসমুখী করে তোলেন। ক্ষমতার বাইরে থাকাকালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা সুষ্ঠু অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য ক্রমাগত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার (এবং ভারতেরও) স্থানীয় দূতাবাসগুলোতে ধরনা দেন। গত অন্তত ত্রিশ বছর ধরে দেখা যাচ্ছে শাসক শ্রেণির লোকেরা (সরকারি ও সরকারবিরোধী সব মহলের) তাদের ছেলেমেয়েদের যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্রের নাগরিক করে চলেছেন। এই ব্যক্তিরাই রাষ্ট্রব্যবস্থার ও ব্যবসা-বাণিজ্যের কর্তৃত্বে আছেন। এসব ঘটনা বাংলাদেশের ভ‚ভাগে জাতি গঠনের ও রাষ্ট্র গঠনের সম্পূর্ণ প্রতিকূল।

এসব প্রতিকূলতা সত্ত্বে নতুন রেনেসাঁস ও তার ধারাবাহিকতায় নতুন গণজাগরণ এবং উন্নত চরিত্রের নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্ব সৃষ্টি করা গেলে অবশ্যই বাংলাদেশকে বাংলাদেশের জনগণের প্রগতিশীল রাষ্ট্ররূপে গড়ে তোলা যাবে। রাষ্ট্র গঠনের সঙ্গে রাষ্ট্রভাষা রূপে বাংলা ভাষাকে উন্নত ও সমৃদ্ধ করার ব্যাপারটি অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে যুক্ত। রাষ্ট্র গঠনের জন্যই রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রতিষ্ঠা ও উন্নতি দরকার। কোনো বিদেশি ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা করে বাংলাদেশের ভ‚ভাগে রাষ্ট্র গঠন সম্ভব হবে না।

তিন. বাংলাদেশকে বাংলাদেশের জনগণের রাষ্ট্ররূপে গড়ে তোলার এবং বাংলাভাষাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা রূপে প্রতিষ্ঠা করার পথে বিরাজিত অন্তরায়গুলো দূর করতে হবে।

সদিচ্ছার ও আন্তরিকতার অভাব দূর করতে হবে। যারা দ্বৈত নাগরিক, যাদের স্ত্রী অথবা স্বামী অথবা সন্তান দ্বৈত নাগরিক কিংবা বিদেশি নাগরিক, তারা যাতে বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপসচিব থেকে সচিব, জজকোর্ট থেকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ইত্যাদি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হতে না পারেন, সংবিধানে তার বিধান রাখতে হবে। যারা তাদের সন্তানদের বিদেশে নাগরিক করার জন্য কিংবা বড় চাকরির জন্য ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা দিতে চান, তাদের জন্য ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ব্রিটিশ কাউন্সিলের মাধ্যমে ও-লেভেল, এ-লেভেল ইত্যাদি পড়ার সুযোগ অব্যাহত রাখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র, ও আরো কোনো কোনো রাষ্ট্র বাংলাদেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালাচ্ছে। সেগুলোকেও চলতে দিতে হবে। তবে ইংলিশ ভার্সন বিলুপ্ত করতে হবে এবং ইংরেজি ও আরো কয়েকটি ভাষা ভালো করে শেখার ব্যবস্থা সরকারি উদ্যোগে বাংলাদেশে করতে হবে। দেশের গোটা শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষানীতিকে উন্নত করতে হবে। পাঠ্যসূচি, পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক উন্নত করতে হবে।

বিলীয়মান মাতৃভাষাসমূহকে রক্ষা করার চেষ্টা কারো জন্যই কল্যাণকর নয়। ‘আদিবাসী’দের চিরকালের জন্য ‘আদিবাসী’ করে রাখার সাম্রাজ্যবাদী নীতি পরিহার্য। বাংলাদেশে পঁয়তাল্লিশটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর জনসংখ্যা বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার এক শতাংশের সামান্য বেশি। তাদের আছে পঁয়তাল্লিশটি ভাষা। যে সব ভাষার উন্নতি সাধন সম্ভব হবে না। এসব জনগোষ্ঠীর সার্বিক উন্নতির জন্য দরকার আর্থসামাজিক-সাংস্কৃতিক সর্বাঙ্গীণ উন্নতির পরিকল্পনা ও কার্যক্রম। তাদের সন্তানদের জন্য বাংলা ও ইংরেজি শেখার সুযোগ বাড়াতে হবে এবং উন্নত করতে হবে।

চার. রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন পর্যায়ে এবং বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর প্রথম দুই দশকে (১৯৭২-৮২) বাংলা ভাষার উন্নতি এবং রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার প্রচলন অনেকটুকু হয়েছে। কিন্তু ১৯৯১ সালের নির্বাচিত সরকার থেকে আজ পর্যন্ত যে ধারা চলছে তাতে বাংলা প্রচলনের ধারাবাহিকতা আর বজায় নেই। এখন অসমাপ্ত কাজগুলো সমাপ্ত করার এবং নতুন সৃষ্টির কাজে অগ্রসর হতে হবে। সে ধারায় দরকার বিচার ব্যবস্থায় বাংলা প্রচলন এবং নতুন আইন বাংলায় করা। বিচার ব্যবস্থার ভেতরে যারা আছেন, বিচারক ও কৌশলী তাদের সামর্থ্য আছে একাজে সাফল্য অর্জনের। আরজি পেশ, সওয়াল জবাব, রায় লেখা- সবই তারা পারবেন। আইন যেহেতু ইংরেজিতে সে জন্য বাংলা লেখার ভেতরে ইংরেজি উদ্ধৃতি রাখতে হবে। আইনের ভলিয়মগুলো পর্যায়ক্রমে বাংলায় অনুবাদ করতে হবে। কাজে অগ্রসর হলে সমস্যা বোঝা যাবে, সমাধানের উপায়ও বের করা যাবে।

ব্যাংকের কাজকর্মে বাংলা চালু করতে হবে। মনোযোগী ও পরিশ্রমী হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা পর্যায়ক্রমে এ কাজ সাফল্যের সঙ্গে করতে পারবে। উচ্চশিক্ষায় ও গবেষণার কাজেও বাংলা প্রচলনে সাফল্য ছিল। কিন্তু ১৯৯১ সাল থেকে এতে ভাটা দেখা দিয়েছে এবং উল্টো হাওয়া বইছে। সরকার ও শিক্ষিত সমাজ যদি এ ব্যাপারে আগ্রহী হয় এবং সহায়তা প্রদান করে তা অবশ্যই এ ক্ষেত্রে সাফল্য ও সৃষ্টিশীলতা দেখা দেবে। দরকার নতুন সাহিত্য আন্দোলন এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে নতুন আন্দোলন। দরকার জাতির ও জনজীবনের, সভ্যতা ও সংস্কৃতির নবজন্ম। দরকার উন্নত নতুন ভবিষ্যৎ সৃষ্টির জন্য নতুন ইশতেহার ও নতুন কর্মযজ্ঞ। বাংলাদেশ, বাংলাভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির সামনে আছে অত্যুজ্জ্বল নতুন ভবিষ্যৎ।

আবুল কাসেম ফজলুল হক : চিন্তাবিদ, লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App