×

মুক্তচিন্তা

সংসদ নির্বাচনের আগে সরকার ও বিরোধী দলকে সমাধানের পথ বের করতে হবে

Icon

মুক্তচিন্তা কলাম লেখক

প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ০৮:২৮ পিএম

সংসদ নির্বাচনের আগে সরকার ও বিরোধী দলকে সমাধানের পথ বের করতে হবে
সংসদ নির্বাচনের আগে সরকার ও বিরোধী দলকে সমাধানের পথ বের করতে হবে
সংসদ নির্বাচনের আগে সরকার ও বিরোধী দলকে সমাধানের পথ বের করতে হবে

বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর দৃষ্টি এখন বাংলাদেশের দিকে। পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কীভাবে অনুষ্ঠিত হবে, সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হতে পারবে কি না, এসবের ওপর এ দেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। এ ব্যাপারে সরকার ও বিরোধী দল উভয়কেই সংবেদনশীল হয়ে যৌক্তিকভাবে সমাধানের উপায় বের করতে হবে।

সময়ের প্রয়োজনে

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাকে বিএনপি কোনো নির্বাচন হিসেবে গণ্য করেনি। এই নির্বাচন সম্পর্কে যে উদাহরণটি তারা সবাই দিয়ে থাকেন যে, ১৫৩ জন সাংসদ যে নির্বাচনে এমনিতেই নির্বাচিত হয়েছেন; ভোট দেয়ার প্রয়োজন হয়নি, তাকে তারা নির্বাচন হিসেবে গণ্য করেনি। কিন্তু কী কারণে যে ক্ষমতাসীন দলের ১৫৩ জন সাংসদ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলো, সে ব্যাপারে তারা নীরব হয়ে থাকে। বাংলাদেশের সংসদীয় ধারায় মুখ্যত দুটি দল প্রতিদ্বন্দ্বি হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে আসছে। একটি আওয়ামী লীগ ও অপরটি বিএনপি। ধারাটি প্রায় এরূপ, একবার ক্ষমতায় যায় আওয়ামী লীগ, আরেকবার বসে বিরোধী দলে। বিএনপির বিষয়ে তাই ঘটে থাকে। তবে পার্থক্য এইটুকু, আওয়ামী লীগ কখনো নির্বাচনের মাধ্যম ছাড়া ক্ষমতায় আসেনি। আর বিএনপির জন্মই হচ্ছে স্বৈরশাসনের গর্ভে। জেনারেল জিয়া বিএনপির স্রষ্টা। তার শাসনামলে যতগুলো নির্বাচন করেছিলেন, তার কোনোটিই প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন ছিল না। অথচ খালেদা জিয়াকে ভালোই হোক আর মন্দই হোক নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যেতে বাধ্য করেছে। মুখ্যত শেখ হাসিনার কারণেই খালেদা জিয়াকে আন্দোলনে বা নির্বাচনে অংশ নিতে হয়েছে।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার আহ্বান জানান। বিএনপি তখন নির্বাচনে অংশ নেয়নি বরং শর্ত দেয় নির্বাচন যাতে অনুষ্ঠিত হতে না পারে। যেভাবে দেশ সাংবিধানিক সংকটে নিমজ্জিত হয় এমনটাই করতে চেয়েছিলেন। তাই সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে আওয়ামী লীগকে ৫ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে হয়। আর বিএনপি ও তার জোট শুধু নির্বাচন বর্জনই নয়, প্রতিহত করার জন্য এমন সহিংসতার আশ্রয় নেয়, এমনভাবে নিরীহ মানুষকে হত্যা করে, হাজার হাজার যানবাহন ধ্বংস করে, শত শত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ করে, আইনশৃঙ্খলার সদস্য ও নির্বাচনে দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের হত্যা নির্মমভাবে করেছিল। বলতে গেলে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ধ্বংস করা যায় এবং এসব করা হয়েছিল নির্বাচন প্রতিহত করার জন্য। তার পরেও কিন্তু বিএনপির পক্ষে নির্বাচন প্রতিহত করা সম্ভব হয়নি। এরূপ একটা নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর শেখ হাসিনা কিন্তু আত্মতুষ্টি লাভ করতে পারেননি। তিনি বলেছিলেন যে, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে ও দেশকে অবৈধ সরকারের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ওই নির্বাচন করতে হয়েছে। ওই নির্বাচন ছিল সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার নির্বাচন। প্রয়োজন হলে আবার নির্বাচন করা যেতে পারে। কিন্তু সে প্রয়োজন পড়েনি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিধ্বস্ত হওয়ার কারণে দেশে তখন যে বাস্তবতা বিদ্যমান ছিল, এত দ্রুততার সঙ্গে তখনকার নির্বাচিত সরকার নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হলেন এবং এত দ্রুততার সঙ্গে উন্নয়নের গতিধারা এগিয়ে নিয়ে গেলেন, এ দেশের জনগণ কেন, বহির্বিশ্বের যেসব সরকার ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে আপত্তি তুলেছিলেন, তারা নবনির্বাচিত সরকারকে শুধু বৈধ বলেই গণ্য করেননি, প্রয়োজনীয় সহযোগিতাও অব্যাহত রেখেছেন। চরম বিশৃঙ্খলার অবসান ঘটিয়ে যখন ওই সরকার দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে নিয়ে আনল, জনগণ আশ্বস্ত হলেন, তখন ভুলেও কেউ আর মধ্যবর্তী নির্বাচনের কথা বলেননি। বিএনপি প্রায়ই বলে থাকে বিগত ৪ বছর যে সরকার দেশ পরিচালনা করেছেন, তারা অবৈধ। কেননা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে তারা নির্বাচিত হননি। তাদের এ বক্তব্য সঠিক নয়। আইনের বিচারে সরকার কখনো অবৈধ নয়। বিএনপি একদিকে সরকারকে অবৈধ বলছেন, অন্যদিকে সরকার যে নিয়মতান্ত্রিকতা প্রতিষ্ঠা করেছেন, বিরোধী দল হিসেবে তার অংশীদারিত্ব ভোগ করছেন।

বিএনপির কাছে প্রশ্ন আপনাদের দল ওই নির্বাচনে যদি অংশ নিতেন, তাহলে ক্ষমতাসীন দলের ১৫৩ জন সাংসদ এভাবে নির্বাচিত হতে পারতেন না। তারা আর একটা বক্তব্য দেন- ওই নির্বাচনে নাকি ৫% ভোটও পড়েনি। অথচ নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ফলাফল ঘোষণায় বলা হয়েছে, কম হলেও ৪০-৪২% লোক ভোট দিয়েছে। সাধারণত বাংলাদেশের নির্বাচনে ৬০-৬৫% সাধারণ ভোটাররা ভোট দেয়। ২০১৪ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৪২%। অথচ মোট ভোটের ২৩% কম। সাধারণ ভোট প্রদানের অনুপাত হচ্ছে- আওয়ামী লীগ ৩০-৩৫%, বিএনপি ২৫-৩০% আর ভাসমান ভোট কম হলেও ১৫%। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ ও ভাসমান ভোট একত্রিত করলে দেখা যায়, সে ভোট নির্বাচনে প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু বিএনপি নির্বাচন বর্জন করায়, তাদের সমর্থিত ভোট পড়েনি। বিএনপির দাবি ৫% লোকও ভোট দেয়নি, এই কথা ডাহা মিথ্যা।

এখন আসা যাক, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে। এবারো খালেদা জিয়ার একই দাবি। এ পর্যন্ত তিনি যা কিছু বলে আসছেন, সহায়ক সরকার ছাড়া তার দল নির্বাচনে অংশ নেবে না। তবে এ কথা ঠিক, ২০১৪ সালের মতো অত কঠিন অবস্থান তাদের আছে বলে মনে হচ্ছে না। কেননা দলের অধিকাংশ নেতাকর্মী আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে চায়। খালেদা জিয়ার বক্তব্য নির্বাচনকালে শেখ হাসিনার সরকার থাকলে, নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে না, ভোটে কারচুপি হবে। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনুরূপে একটা সরকার দরকার। অবশ্য ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ বলছে, সাংবিধানিক ধারা অনুযায়ীই দেশে নির্বাচন হবে। তাদের মতে, দেশে যখন সংবিধান আছে, তখন সংবিধান মেনেই তো নির্বাচন হতে হবে। এর বিকল্প তো কিছু করা যাবে না। বিএনপি যদি মনে করে সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন, তবে কী করে তা বাস্তবায়িত করবে? সংসদে তো তারা নেই। সংবিধান সংশোধন করার জন্য প্রয়োজনে তাদের মতে ও পথে সক্ষম নয়। সে সুযোগ তো ক্ষমতাসীনদের হাতে। বিরোধী দলের রাজনৈতিক প্রয়োজন মিটাতে ক্ষমতাসীন দল কেন তাদের প্রয়োজন মিটাতে যাবে? আওয়ামী লীগ নিশ্চিত যে, বিরোধী দল বিএনপি এমন একটা পরিস্থিতি দেশে সৃষ্টি করতে পারবে না যে, সংবিধান পরিবর্তন করার দরকার হবে। অনেকেই মনে করেন, সাংবিধানিক ধারায় বর্তমান সংকট নিরসন সম্ভব। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান শেখ হাসিনাকে রেখেই সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।

একটা ব্যাখ্যা উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ দিয়েছেন। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সম্পর্কে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কী ভাবছেন, তা এখনো জানা যায়নি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শুধু সরকারপ্রধান নন, জাতির জনকের কন্যাও। এখন তিনি বিশ্বনেত্রীর পর্যায়ের এক নেতা। তার দেশের রাজনৈতিক সংকট তিনি কীভাবে সমাধান করতে চান এবং বিরোধী দল তার সঙ্গে একমত হয়ে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছে কি না, এসব বিষয়ে হয়তো আলোচনার দ্বার তিনি রুদ্ধ করে দেননি। তবে শর্ত দিয়ে আলোচনার কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। সংবিধানকে অগ্রাহ্য করে নতুন কোনো প্রস্তাব বিরোধী দল দিলেও তা কার্যকর করা সম্ভব না। সংবিধানের আওতাধীন থেকে এমন কোনো উপায় বের করা যায় কি না, যা অন্তত সবার অংশগ্রহণমূলক একটা নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে সাহায্য করবে।

দেশ ও জাতিকে পরিচালনার দায়িত্ব যার হাতে, প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতায় যার সমকক্ষ কেউই নয়, বিরোধী দল যদি তার ওপর নির্ভর করতে রাজি থাকে ও তার সিদ্ধান্ত মেনে নেয়, তাহলেই কেবল বর্তমান সংকট দূর হবে। আসলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সহযোগী সরকার হিসেবে কাজ করবে। নীতিগত কোনো সিদ্ধান্ত তারা নেবে না। নির্বাচনকালীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করার ক্ষমতা ও তার দিকনির্দেশনা তো সংবিধান দিয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান যিনিই হন না কেন, তার পক্ষে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার কোনো সুযোগ নেই।

কোনো গণতান্ত্রিক দেশে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সংলাপ অনুষ্ঠানের সুযোগ চিরতরে অবাঞ্ছিত বলে বিবেচিত হতে পারে না। তবে পূর্ব শর্ত দিয়ে সংলাপ সমীচীন নয়। তাই বিরোধী দল যদি সাংবিধানিক ধারায় সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করতে রাজি হয়, তাহলে সরকারও হয়তো তার সিদ্ধান্তে অনড় নাও থাকতে পারে। ২০১৪ সালের মতো বিরোধী দল যদি অনড় থাকে ও ষড়যন্ত্রমূলকভাবে বিধ্বংসী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কিছু অর্জন করতে চায় ও সরকার সে সম্পর্কে সঠিক তথ্য পেয়ে থাকেন, তাহলে সরকারের পক্ষে কঠোর অবস্থান থেকে সরে আসা সম্ভব হবে না।

বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর দৃষ্টি এখন বাংলাদেশের দিকে। পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কীভাবে অনুষ্ঠিত হবে, সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হতে পারবে কি না, এসবের ওপর এ দেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। এ ব্যাপারে সরকার ও বিরোধী দল উভয়কেই সংবেদনশীল হয়ে যৌক্তিকভাবে সমাধানের উপায় বের করতে হবে।

ডা. এস এ মালেক : রাজনীতিক ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App