×

মুক্তচিন্তা

সামাজিক নিরাপত্তা কর আরোপ প্রসঙ্গে

Icon

মুক্তচিন্তা কলাম লেখক

প্রকাশ: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ০৭:১৫ পিএম

এ কথা জোর দিয়ে বলা যেতে পারে যে, আগামী বাজেটে সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর আরোপ করতে পারে। বাংলাদেশের সরকারি খাতের বেতন বেশ সন্তোষজনক। এ খাতের সবার উচিত সামাজিক নিরাপত্তা কর প্রদানের মাধ্যমে সমাজের সব শ্রেণির মানুষের কল্যাণে অংশ নেয়া। এর বাইরেও বিরাট জনগোষ্ঠী রয়েছে যাদের কাছ থেকে এই কর সংগ্রহ করা যেতে পারে।

যা বলিব সত্য বলিব

লেখার শুরুতে স্বীকার করছি যে, আজকের লেখার শিরোনাম এবং বিষয়বস্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞানের অধ্যাপক ধীমান চৌধুরীর লেখা থেকে নিয়েছি। আমার বিরুদ্ধে Plagiarism-এর অভিযোগ যেন না আসে তাই এই স্বীকারোক্তি।

প্রতি বছর সাধারণত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে বাজেট নিয়ে অনেক আগাম আলোচনা এবং প্রস্তাব পেশ করা হয়। বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংগঠন, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও অর্থনৈতিক বিষয়ে সংশ্লিষ্ট এনজিও থেকে অনেক পরামর্শ দেয়া হয়। বাজেট আলোচনার মৌসুম আগত প্রায়। যা হোক, বাণিজ্যিক সংগঠনের প্রস্তাব সাধারণত বিরাজমান করের হার কমানোর মধ্যে সীমিত থাকে। বলা হয়ে থাকে, কর কমানোর ফলে সংশ্লিষ্ট খাতের উন্নতি হবে। নতুনভাবে কোনো খাতে কর আরোপ করা যেতে পরে এ রকম কোনো প্রস্তাব চোখে পড়ে না। অধ্যাপক ধীমান চৌধুরী বাংলাদেশের জন্য নতুন একটি করারোপ খাতের প্রস্তাব করেছেন যা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। আমাদের সবার দায়িত্ব একে সমর্থন জানানো এবং সেই দৃষ্টিকোণ থেকে আমার এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। একটি ইংরেজে দৈনিকে তিনি এই নিবন্ধটি লিখেছেন যা অত্যন্ত তথ্যবহুল এবং দিকনির্দেশনামূলক। আমার এই লেখায় এসবের উল্লেখ করব। তিনি প্রথমে জানিয়েছেন যে, উন্নত দেশগুলোতে জিডিপির শতকরা ৯.১ ভাগ সামাজিক নিরাপত্তা কর হিসেবে সংগ্রহ করা হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, এসব দেশের মোট জিডিপির শতকরা ৩৩.৫ ভাগ কর আদায় করা হয়।

সামাজিক নিরাপত্তা শুধু সরকারের অনুদান হিসেবে পর্যাপ্ত হতে পারে না। বাংলাদেশে যেসব ভাতা যথা বয়স্কভাতা, মাতৃভাতা বা বিধবাদের জন্য ভাতা এর কোনোটাই পর্যাপ্ত নয়। বাঁচার জন্য যথেষ্ট নয়। অতএব রাষ্ট্রীয়ভাবে নিরাপত্তা কর সংগ্রহ করে এর প্রয়োজন মিটানো দরকার। এ প্রসঙ্গে করপোরেট করের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। আমাদের দেশে কয়েক বছর ধরে করপোরেট কর কমানোর কথা বলা হচ্ছে। কিছু কমানো হয়েছে। এই প্রস্তাবের কথা বলতে গিয়ে বারবার উন্নত দেশের উদাহরণ টানা হয় কিন্তু সেখানে সম্পূর্ণ চিত্র তুলে ধরা হয় না। ইউরোপে গড় করপোরেট ট্যাক্স শতকরা ২০ ভাগ কিন্তু সেখানে কোম্পানিগুলো গড়ে শতকরা ৬.৪ ভাগ সামাজিক নিরাপত্তা কর প্রদান করে। জামার্নিতে করপোরেট মুনাফা কর শতকরা ২৯.৮৭ ভাগ। তার সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তা কর যোগ হয় শতকরা ১২.৮ ভাগ, ফ্রান্সে করপোরেট মুনাফা কর শতকরা ৩৩ ভাগ, কোম্পানিকে আরো দিতে হয় শতকরা ২২ ভাগ সামাজিক নিরাপত্তা কর। তবেই না ওইসব দেশে সমাজের সব শ্রেণির মানুষ যেন মানুষ হিসেবে বাঁচতে পরে রাষ্ট্র সেই নিশ্চয়তা দিতে পারছে। আফ্রিকার বহু দেশে মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের চেয়ে কম। তারপরও সেখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের আয়ের শতকরা ৩ ভাগ সামাজিক নিরাপত্তা কর হিসেবে প্রদান করে।

অতএব এ কথা জোর দিয়ে বলা যেতে পারে যে, আগামী বাজেটে সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর আরোপ করতে পারে। বাংলাদেশের সরকারি খাতের বেতন বেশ সন্তোষজনক। এ খাতের সবার উচিত সামাজিক নিরাপত্তা কর প্রদানের মাধ্যমে সমাজের সব শ্রেণির মানুষের কল্যাণে অংশ নেয়া। এর বাইরেও বিরাট জনগোষ্ঠী রয়েছে যাদের কাছ থেকে এই কর সংগ্রহ করা যেতে পারে। আমরা পাকিস্তান আমলে শুনতাম ২২ পরিবারের কথা যারা অধিকাংশ সম্পদের মালিক। এখন বর্তমানে দেশে দশ হাজারের বেশি কোটিপতি রয়েছেন। শুধু কোটিপতি না তাদের কোটি কোটি টাকার মালিক বলা যেতে পারে। বিশ্বের সর্বত্র ধনী এবং দরিদ্রের বৈষম্য আকাশছোঁয়া হতে চলেছে, বাংলাদেশও রেহাই পায়নি। একদিকে যেমন ভাসমান মানুষ রয়েছে যাদের মাথায় ছাদ নেই, পেটে পর্যাপ্ত আহার নেই, শীতবস্ত্র নেই, আবার এমন এক শ্রেণি গড়ে উঠেছে যাদের কত সম্পদ তা বোধ হয় তারা নিজেরাও জানে না। তারা বৈধ-অবৈধভাবে বিদেশে টাকা পাচার করে সেখানে ঘরবাড়ি বানিয়েছেন। বস্তুত সেখানে তাদের সেকেন্ড হোম। বছরের পর বছর সপরিবারে থাকলেও অর্থের অভাব হয় না। কানাডাতে এক জায়গায় প্রবাসী ধনাঢ্য বাংলাদেশিরা অসংখ্য বিলাসবহুল আবাস তৈরি করেছেন যেটা এখন বেগমপাড়া নামে পরিচিত। মালয়েশিয়াতে প্রবাসী যারা ওখানে বসতি স্থাপন করেছেন তাদের ভেতর বাংলাদেশে স্থান দ্বিতীয়। চীনের পর বাংলাদেশের অবস্থান। মালয়েশিয়াতে বসতি স্থাপন করতে হলে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করতে হয় এবং সন্তোষজনক আয় দেখাতে হয় অর্থাৎ অতীব বিত্তশালীরা সেখানে যেতে পারেন। বাংলাদেশ থেকে গত দশকে অস্বাভাবিক পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। সরকার পদক্ষেপ নেয়ার কথা বললেও কার্যত কিছুই হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকও চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ।

নতুনভাবে কোনো কর আরোপ করা কঠিন এই বাংলাদেশে। কেননা আমাদের সাধারণ মানসিকতা কম কর প্রদান করা, আর একেবারে না দিতে পারলে তো আরো ভালো। ইউরোপের দেশগুলো অবাধ মুক্তবাজার অর্থনীতির। অথচ কীভাবে এবং কী হারে সেখানে সামাজিক নিরাপত্তা কর আদায় করা হচ্ছে তা ধীমানবাবুর লেখায় উল্লেখ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে চীনের বিষয়টিও উল্লেখ করার মতো। চীনের কর্মচারীরা শতকরা ৮ ভাগ বয়স্ক ভাতা, ২ ভাগ চিকিৎসা এবং ১ ভাগ বেকার ভাতা প্রদানের জন্য সর্বমোট শতকরা ১১ ভাগ কর প্রদান করে থাকেন। মালিক পক্ষ তথা নিয়োগ প্রদানকারীদের যথাক্রমে শতকরা ২০, ৮ এবং ২ ভাগ মোট ৩০ ভাগ সামাজিক নিরাপত্তা কর প্রদান করতে হয়। আমাদের সরকারকে ব্যবসা-বাণিজ্যবান্ধব হতেই হবে। কেননা সরকার তো মুক্তবাজার অর্থনীতির একনিষ্ঠ অনুসারী। সরকারের উদার নীতির ফলে বেশ কিছু খাতে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে এবং হচ্ছে। যেমন পোশাক শিল্প, চামড়া শিল্প, ওষুধ শিল্প ইত্যাদি।

সরকার ওষুধ শিল্পকে ২০১৮ সালে ‘প্রডাক্ট অফ দি ইয়ার’ ঘোষণা দিয়েছে, নিঃসন্দেহে এটা প্রশংসনীয়। কেননা আমাদের ওষুধ ইউরোপ-আমেরিকাসহ পৃথিবীর বহু দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এক সময় পোশাক শিল্পের বোতাম পর্যন্ত বাইরে থেকে আসত। এখন গার্মেন্টস এক্সেসরিজ শিল্পে প্রভৃত উন্নতি হয়েছে। বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন যে, গার্মেন্টস এক্সেসরিজ রপ্তানি করার জন্য নগদ প্রণোদনা প্রদানের ব্যাপারে সরকার সক্রিয়ভাবে চিন্তা করছে। এটা খুব ভালো উদ্যোগ। তবে এই প্রণোদনার কিছু অংশ যেন বেতনভাতা আকারে শ্রমিকদের কাছে পৌঁছায় সে ব্যাপারে লক্ষ রাখা প্রয়োজন। কেননা সব শ্রমিক-কর্মচারীকে যদি সামাজিক নিরাপত্তা কর প্রদান করতে হয়, তাহলে তাদের সেই অনুপাতে আয় করতে হবে। ওষুধ শিল্প সম্পর্ক একটা কথা বলতে হয়। এ বিষয়টি দেখাও সরকারের দায়িত্ব যে, দেশের অভ্যন্তরে কোম্পানিগুলো ইচ্ছা মতো ওষুধের দাম বৃদ্ধি করে চলেছে। সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তর একেবারে নির্লিপ্ত। মনে হয় দাম বাড়ানোর কোনো নিয়মনীতি নেই, একেবারে ফ্রি রাইড। এতে করে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ভার দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। পরিশেষে আবারো ধীমান বাবুকে ধন্যবাদ জানাই যে তিনি বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন খাত দেখিয়েছেন কর আরোপের। এ ধরনের কাজে বাধা আসবে। তবে সরকার যদি এর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে তা বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা পোষণ করে তাহলে কঠিন হবে না কাজটি। সমাজের যারা ভাগ্যবান এবং প্রভ‚ত সম্পদের মালিক তাদের উচিত বঞ্চিতদের জন্য কিছু ত্যাগ স্বীকার করা।

সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ : সাবেক ইপিসিএস, কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App