×

মুক্তচিন্তা

পরিচয়মার্কা রাজনীতির মহাবিপদ

Icon

মুক্তচিন্তা কলাম লেখক

প্রকাশ: ২০ জানুয়ারি ২০১৮, ০৭:৩৪ পিএম

পরিচয়মার্কা রাজনীতির মহাবিপদ
পরিচয়মার্কা রাজনীতির মহাবিপদ
পরিচয়মার্কা রাজনীতির মহাবিপদ
পরিচয়মার্কা রাজনীতির মহাবিপদ
পরিচয়মার্কা রাজনীতির মহাবিপদ
পরিচয়মার্কা রাজনীতির মহাবিপদ

এ ধরনের রাজনীতির মন্দ দিকই বেশি। কোনো গোষ্ঠী-পরিচয় বা পরিচয়বোধ মানুষের মাঝে ঐক্যের বোধ তৈরি করে সত্যি, তবে সে সঙ্গে গোষ্ঠীর বাইরের মানুষের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করে আরো বেশি এবং মানবতাকে বিভক্ত করতে ভ‚মিকা রাখে। গোষ্ঠী-পরিচয়ের রাজনীতি সহজেই মানুষকে রক্তপিপাসু জন্তুতে পরিণত করতে পারে।

পৃথিবীতে রাজনীতির একটা বড় নিয়ন্ত্রক- গোষ্ঠী-পরিচয়। গোষ্ঠী গঠনের ভিত্তি বহুরকম। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, গাত্রবর্ণ, বংশ, ভূখণ্ড, ভাষিক পরিচয়, নৃতাত্তি¡ক পরিচয় ইত্যাদি। পরিচয়ের ভিত্তি আরো বিচিত্র হতে পারে। আর ভিন্ন ভিন্ন পরিচয় ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক সত্তা গঠন করতে পারে। মানুষে মানুষে কোনোরকম পার্থক্য অবলম্বন করে বৈষম্য সৃষ্টির মাধ্যমে শোষণ, আবার কোনো সংগঠিত শোষণ থেকে মুক্তির আকাক্সক্ষায় সমাজে এই ‘আমরা’ ও ‘ওরা’র ভেদ তৈরি হয়। মানুষে মানুষে বিভেদের ভিত্তি আরো অনেক কিছু হতে পারে। এই যে মানুষকে নানা পরিচয়ে আলাদা করে সামাজিক ও রাজনৈতিক ঐক্য ও বিভক্তি সৃষ্টি করা হয়, একে বলা যায় পরিচয় ছাপের রাজনীতি। গোষ্ঠী রাজনীতির মতোই। তবে যেহেতু ‘আইডেন্টিটি পলিটিক’স নামে একটি বিশেষ ধারার রাজনীতি নিয়ে ইদানীং দুনিয়ায় খুব আলোচনা হচ্ছে, আমরা একে পরিচয়মার্কার রাজনীতি বলতে পারি। এ ধরনের রাজনীতি নিয়ে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের ‘আইডেন্টিটি এন্ড ভায়োলেন্স : দি ইল্যুশন অব ডেসটিনি’ (২০০৬ সালে পেঙ্গুইন কর্তৃক প্রকাশিত) নামে একটি বই আছে। শুরুর অধ্যায়েই তিনি লিখেছেন, ‘পরিচয়ের একটি বোধ কেবল আনন্দ ও অহংকারেরই নয়, শক্তি ও আত্মবিশ্বাসেরও উৎস হতে পারে। প্রতিবেশীকে ভালোবাসার শিক্ষা থেকে শুরু করে উচ্চতর পর্যায়ে সামাজিক মূলধন ও সম্প্রদায়গত আপনতা সৃষ্টি- সবক্ষেত্রেই এটি যে ব্যাপক প্রশংসার তা আশ্চর্যের নয়।’

‘আবার পরিচয়ছাপের রাজনীতি হত্যাও করতে পারে- আর তা নিষ্ঠুরভাবে। কোনো একটি গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হওয়ার শক্তিশালী বোধ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অন্য গোষ্ঠীর সঙ্গে দূরত্ব ও পার্থক্যের বোধ তৈরি করে। গোষ্ঠীর ভেতরকার একতাবোধ একইভাবে গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে অনৈক্যবোধও তৈরি করতে পারে।’

অমর্ত্য সেন ১৯৪০-এর দশকে ভারতে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গাকালে যা ঘটেছিল তা স্মৃতি থেকে রোমন্থন করে লিখেছেন, ‘আমার মনে পড়ছে কী দ্রুততার সঙ্গে জানুয়ারি মাসের উদার মানবসত্তা জুলাই মাসে পরিণত হলো নির্দয় হিন্দু ও ক্রুদ্ধ মুসলমানে।’

পরিচয়ছাপের রাজনীতির এই হলো ভালো ও মন্দ দিক। তবে দুদিক ঠিকভাবে ওজন করলে দেখা যাবে এ ধরনের রাজনীতির মন্দ দিকই বেশি। কোনো গোষ্ঠী-পরিচয় বা পরিচয়বোধ মানুষের মাঝে ঐক্যের বোধ তৈরি করে সত্যি, তবে সে সঙ্গে গোষ্ঠীর বাইরের মানুষের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করে আরো বেশি এবং মানবতাকে বিভক্ত করতে ভূমিকা রাখে। গোষ্ঠী-পরিচয়ের রাজনীতি সহজেই মানুষকে রক্তপিপাসু জন্তুতে পরিণত করতে পারে। বিশ্বরাজনীতি এই গোষ্ঠী-পরিচয়ের রাজনীতিকে ঘিরেই ঘুরপাক খাচ্ছে। তবে শ্রেণি সংঘাতের রাজনীতিও এর নিচে দিয়ে বয়ে চলেছে অন্তঃসলিলার মতো, যদিও গোষ্ঠী-পরিচয়ের রাজনীতিই বহু বছর ধরে মূলধারার রাজনীতি হিসেবে কাজ করছে।

কিন্তু যেসব ভিত্তিকে অবলম্বন করে এ পরিচয়ছাপের রাজনীতি গড়ে ওঠে তা গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে বৈষম্য ও বিভক্তির মৌলিক উপাদান। মানবাধিকার সম্পর্কে আধুনিক চিন্তাভাবনা ও আন্তর্জাতিক চুক্তি ও সনদের সঙ্গে যা খাপ খায় না। তাই বলে গোষ্ঠী-পরিচয়ের রাজনীতি শক্তি হারাচ্ছে না, বরং দিনে দিনে আরো শক্তিশালী হচ্ছে। গোষ্ঠী-পরিচয়ের রাজনীতি যেন মানুষের স্বভাবের অন্তর্গত হয়ে গেছে, আর স্বভাব তো সহজে মরে না। ট্রাম্পের মুসলিমবিদ্বেষী রাজনীতি এর জ্বলন্ত উদাহরণ। মোদি, ট্রাম্প, সু কি প্রমুখ এখন বিশ্বে এ ধরনের রাজনীতির কর্ণধার।

এই গোষ্ঠী-পরিচয়ের রাজনীতিই ভারতকে বিভক্ত করেছে। ব্রিটিশ শাসকরা ভারতের রাজনীতিতে এ বীজ বপন করেছিল। ভারত এখন এ পথে আরো জোরেশোরে চলছে। এর বিষবাষ্প এখন দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় বইছে। এটি বহু গবেষণার বিষয় যে, তৎকালীন ভারতের অসামান্য নেতারা ব্রিটিশের পাতা গোষ্ঠী-পরিচয়ের রাজনীতির ফাঁদে কী করে পা দিলেন ও ফেঁসে গেলেন। কেবল বাম নেতারাই তখন ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠী-পরিচয়ের ফাঁদে আটকে পড়েননি, কিন্তু জাতীয় রাজনীতিতে তারা নিয়ন্ত্রক হতে পারেননি।

নিউইয়র্কের ক্যান্টোনে সেন্ট লরেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের সহযোগী অধ্যাপক ও আফ্রিকান স্টাডির সমন্বয়ক ম্যাট ক্যারোটেনুটো তার ‘চল্লিশজন বিলিওনিয়ার ও চল্লিশ মিলিয়ন ভিক্ষুক’ শীর্ষক রচনায় (জ্যাকোবিন সাময়িকী, ডিসেম্বর ২০১৭) লিখেছেন, ‘গণমাধ্যমের প্রতিফলন থেকে যদিও কেনিয়াকে জাতিগত দ্বন্দ্বে বিভক্ত একটি দেশ মনে হয়, এখানে আসলে দুটি জাতের বাস : ধনী ও গরিব।’ তিনি আরো লিখেছেন, ‘বিভক্ত করো ও শাসন করো- এই ঔপনিবেশিক ক‚টকৌশলকে উপনিবেশোত্তর বোতলে ভরে রাজনৈতিক ক্ষমতাশালীরা জাতিগত বিদ্বেষকে জারি রাখার মাধ্যমে শ্রেণিবিভক্তি থেকে মানুষের মনকে অন্যদিকে সরিয়ে রাখে। জাতিগত শত্রুতাকে অক্ষুণ্ন রেখে ক্ষমতাশালীরা তাদের সুবিধাজনক অবস্থান রক্ষা করে।’

জনাব ক্যারোটেনুটো ঠিকই বলেছেন যে, মানুষ প্রধান দুটি জাতিতে বিভক্ত- ধনী ও গরিব- পৃথিবীর সর্বত্র। এই মূল বিভক্তিকে অস্পষ্ট রাখার জন্যই অন্যান্য পরিচয়মার্কা রাজনীতি ও গোষ্ঠী দ্বন্দ্বকে মুখ্য করে তোলা হয়। গ্রিসের সাবেক অর্থমন্ত্রী ইয়ানিস ভারাওফ্যাকিস লিখেছেন, ‘আটলান্টিকের দুই পাড়ে জন্ম নেয়া যুদ্ধংদেহী সংকীর্ণ রাজনীতি নিয়ে মনোবিশ্লেষণমূলক, সাংস্কৃতিক, নৃতাত্তি¡ক, নন্দনতাত্তি¡ক এবং পরিচয়মার্কা রাজনীতি- এরকম সম্ভাব্য সব দৃষ্টিকোণ থেকে তদন্ত চলছে। যে দৃষ্টিকোণটি এ থেকে পুরোপুরি বাদ পড়ে যাচ্ছে অথচ যা এই চলমান পরিস্থিতি বোঝার চাবিকাঠি তা হলো : ১৯৭০-এর দশক থেকে গরিব মানুষের বিরুদ্ধে চালানো নিরবচ্ছিন্ন শ্রেণিযুদ্ধ।’ (শ্রেণিযুদ্ধ অস্বীকারের উচ্চমূল্য, ৮ ডিসেম্বর ২০১৭, প্রোজেক্ট সিন্ডিকেট) চলমান রাজনৈতিক খেলার আসল নামই হচ্ছে : শ্রেণি সংগ্রাম অস্বীকারের খেলা। সম্ভাব্য বিচিত্র রূপে পরিচয়মার্কা রাজনীতি মাঠ দখল করেছে ও পুরনো ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করে চলেছে। যখনই শ্রেণি সংগ্রাম মুখ্য হয়ে ওঠার বিপদ আসন্ন হয়, কোথাও নতুন শ্রেণি সংগ্রামের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে ওঠে ও ইতিহাসে সত্যিকারের পরিবর্তন সম্ভাব্য হয়- তখনই পরিচয়মার্কা রাজনীতির ধোঁয়া ছেড়ে জনগণকে প্রায়ান্ধ করে তোলার চেষ্টা হয়। এই পরিচয়মার্কা রাজনীতির সর্বশ্রেষ্ঠ বুদ্ধিবৃত্তিক রূপ হলো হান্টিংটনের ধর্মভিত্তিক ‘সভ্যতার সংঘর্ষ’ নামের রাজনৈতিক অপদর্শন। ‘সভ্যতার সংঘর্ষে’র স্থানীয় রূপ আছে সহস্র সহস্র। মানুষের মনকে আচ্ছন্ন করে রাখা হয়েছে এই হিংসাত্মক ও বিভেদাত্মক পরিচয়মার্কা রাজনীতির কালো ধোঁয়ায়। শ্রেণি সংগ্রামকে ক্ষুরধার না করলে এই পশ্চাৎধাবমান রাজনীতি থেকে বেরিয়ে প্রগতির সড়কে আসা সম্ভব নয়- কেননা শেষ পর্যন্ত বিশ্বের মানুষ যে দীর্ঘতম জাতিগত বিভাজনরেখায় বিভক্ত তার নাম : ধনী ও গরিব।

আলমগীর খান : লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App