×

মুক্তচিন্তা

আবদি, পার্কার কিংবা আরন এবং ব্রিটেনের গৃহহীন মানুষ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ জানুয়ারি ২০১৮, ১২:২৯ পিএম

আবদি, পার্কার কিংবা আরন এবং ব্রিটেনের গৃহহীন মানুষ
গত বছরের মে মাসের একটা রাত ছিল ব্রিটেনের ইতিহাসে এক হৃদয় পোড়ানো কালোরাত। ২২ মে’র ওই রাতে ম্যানচেস্টার এরিনায় বোমা হামলা হয়, নিহত হন শিশু-নারীসহ ২২ জন মানুষ। খুনির তাণ্ডবে বিধ্বস্ত এরিনা আর ভিকটোরিয়া ট্রেন স্টেশন, রক্ত-চিৎকারে আকাশ বিদীর্ণ তখন। মানবতাবাদী মানুষ ছুটে আসে। যার যার জায়গা থেকে মানুষের সেবা প্রদানে একটা অভ‚তপূর্ব সাড়া পড়ে। ম্যানচেস্টারের সে সময়ের সেøাগান হয়ে যায় ‘আই লাভ ম্যানচেস্টার’। সেই সেøাগানটি এখনো দেখা যায় বিভিন্ন জায়গায় শোভিত হচ্ছে। এ ঘটনার পরপর মানবিক সহায়তায় ম্যানচেস্টারে এক নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। ঘটনার পরপরই মধ্যরাতে স্থানীয় হোটেলগুলো খুলে দেয়া হয়। ফুটবল ক্লাব ম্যানচেস্টার সিটি কর্তৃপক্ষ তাদের গ্রাউন্ডের একটা এরিয়া খুলে দেয়। স্বজনবিচ্ছিন্ন মানুষরা এখানে এসেছেন। থাকা-খাওয়া যোগাযোগ সবকিছুর ব্যবস্থা করেছে কর্তৃপক্ষ। স্থানীয় প্রভাবশালী দৈনিক ম্যানচেস্টার ইভিনিং নিউজ কর্তৃপক্ষ নিহত আহতদের সহায়তায় ৫ লাখ পাউন্ড সংগ্রহ করার ঘোষণা দিয়ে ২০ ঘণ্টার মাঝেই সংগ্রহ করেছে কাক্সিক্ষত অর্থের ৮৫ শতাংশ। এবং মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই ৪.৫ মিলিয়ন পাউন্ড সংগ্রহ করে চ্যারিটি সংস্থাগুলো। বাঙালি-পাকিস্তানি-কালো-সাদা-বাদামি নির্বশেষে সে ছিল এক অভ‚তপূর্ব মানবিকতা। মুসলমান শিশু-কিশোর-কিশোরীদের শোকর‌্যালি চোখ ভিজিয়েছে সে সময় ম্যানচেস্টারের মানুষদের। এই সে সময়ই একজন ক্রিস পার্কার লাইম লাইটে আসেন। তিনি হলেন গৃহহীন মানুষ। আহত মানুষদের পাশে দাঁড়ানো পার্কারের কথা তখন মিডিয়ায় ফলাও হয়। গৃহহীন এই তরুণের জন্য তখন মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। দীর্ঘদিন থেকে বাড়ির সঙ্গে বিচ্ছিন্ন পার্কারের মা ছুটে আসেন তাকে দেখতে। পার্কারের জীবনকে স্বাভাবিক করে তুলতে তখন একজন মানবতাবাদী মানুষ ৫০ হাজার পাউন্ডের ফান্ড সংগ্রহের ঘোষণা দেন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত এবং প্রচারিত ওই মানুষটির জন্য সে ফান্ড সংগ্রহ হয়েও যায় ইতোমধ্যে। দুই. ব্রিটেনের গৃহহীন প্রসঙ্গে একটু আলোচনা করা যেতে পারে। সবাই বলে এদের হোমলেস। যদিও এদের কাজ মূলত ভিক্ষেই করা, তবু তাদের বেলায় ভিখারি শব্দটা সাধারণত কেউই ব্যবহার করে না। রাস্তায় মানুষ হাঁটছে, তারা খুচরো পয়সার (কয়েন) জন্য বিনয়ের সঙ্গে অনুরোধ করবে পথিকদের। আমরা সবাই জানি তারা এ পয়সা দিয়ে একটু পরেই মদ কিনবে, বিয়ারের ক্যান নিঃশেষ করবে। তারপর আবারো সেই আগের মতোই বসে বসে বলবে ‘ক্যান আই হ্যাভ সাম কয়েন প্লিজ’ কিংবা শুধুমাত্র ‘কয়েন প্লিজ’। তাদের জীবনটা এভাবেই চলে। ভাবতে বিস্ময় লাগে ডিসেম্বরের কনকনে বাতাসে ঠাণ্ডায় হাড় কাঁপে, এ সময় এ মানুষগুলো ধুলোমাখা জিন্স পরে কখনোবা বৃষ্টি ভেজা কাপড় স্তরে স্তরে গায়ে দিয়ে কম্বলের নিচে এই ব্রিটেনে কীভাবে যে দিন কাটায়। ক’মাস আগে গিয়েছিলাম ব্রাসেলস। সে আরেক দৃশ্য। ইউরোপের প্রাণকেন্দ্র ব্রাসেলস। চাকচিক্যময় এই শহরটাতেও মনে হয়েছে ওই মানুষগুলোর যেন এক সুন্দর আবাস। দোকানের পাশঘেঁষে কিং-কুইন সাইজ বিছানা বিছিয়ে তিন-চারজনের পরিবার বাস করছে বিভিন্ন জায়গায়। সেজন্য এদের সুন্দর একটা শব্দ এরা ‘হোমলেস’। ভিখারি নয়, এরা গৃহহারা। লন্ডন থেকে শুরু করে ব্রিটেনের বড় বড় শহরগুলোতে এরকম দৃশ্য দেখা যায় প্রায়ই, কোনো কোনো রাস্তার মোড়ে, পাবের ধারে, রেস্টুরেন্টের আশপাশে। এমনকি রাতে সুন্দর ঝলমলে কোনো শোরুমের পাশেও এদের শুয়ে থাকতে দেখা যায়। তাদের খাবারের জন্য খুব একটা চিন্তা করতে হয় না। অনেকেই স্যান্ডউইচ-বার্গার কিনে দেয় কিংবা চকোলেট কিংবা আরো অনেক কিছু। কোনো কোনো সময় তো তারা খাবারের অফারটা প্রত্যাখ্যানই করে। কারণ বিয়ারের ক্যানটাই তাদের প্রয়োজন, সেজন্য প্রয়োজন খুচরো পেন্স কিংবা পাউন্ড। এদের আচরণে বিনয় আছে। তাদের কথায় তারা নিজেদের অসহায়ত্ব ফুটিয়ে তোলে। তা ছাড়া মানুষের সহমর্মিতার জায়গাটা অন্য কারণে। ব্রিটেন কিংবা ইউরোপের শীত আর আর্দ্রতার কারণে মানুষ এদের প্রতি সহমর্মী হয়। যেভাবেই হোক তারা তাদের অসহায়ত্বের প্রকাশ ঘটায়। এই অসহায়ত্বকে পুঁজি করে এরা তাদের দিন কাটায়। কোলাহলের মাঝেও আপদমস্তক কম্বল দিয়ে মোড়ে দীর্ঘ রাত পাড়ি দেয়। তিন. একটা উন্নত সমাজব্যবস্থায় যেখানে মানুষের বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা আছে, আছে বাসস্থানের নিশ্চয়তা। যুক্তিসঙ্গত কারণে কর্মহীন মানুষগুলোর জন্য আছে সপ্তাহ শেষে অনুদান। কিংবা বেকারদের জন্য চাকরির আশ্বাস, সেই জায়গায় এই গৃহহারা মানুষগুলো কেন যে বেছে নেয় ওই কষ্টের জীবন, তা রীতিমতো বিস্ময়ের। কারণ এই গৃহহারাদের অধিকাংশই তরুণ কিংবা তরুণী। সুযোগ থাকা সত্তে¡ও এরা নিজেদের কাজের জন্য উপযোগী করে তোলে না। তাই তো এদের ছন্দহীন জীবন কিংবা এরা গৃহহারা ভিক্ষুক। এভাবেই দিন কাটানো কিংবা রাত পাড়ি দেয়া মানুষগুলো ব্রিটেনের সভ্যতায় মাঝে মাঝে খবরের শিরোনাম হয়। ব্রিটেনের বিভিন্ন স্থানীয় প্রশাসন (কাউন্সিল) এদের নিয়ে বিব্রত। এদের বিরুদ্ধে শক্ত কোনো অবস্থান নিতে পারে না স্থানীয় কাউন্সিল। এদের বিরুদ্ধে কোনো শক্ত অবস্থান নিলে মানবাধিকার সংস্থাগুলো প্রতিবাদ করবে, মিডিয়া তৎপর হয়ে উঠবে। তাই দেখেও না দেখার ভান করে। বরং এদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করে। কিন্তু এদের নিয়ে স্থানীয় কাউন্সিল সবসময়ই থাকে বিব্রতকর অবস্থায়। সে কারণেই এক অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নেয় সম্প্রতি ব্রিটেনের স্থানীয় একটা প্রশাসন। তারা তাদের শহর থেকে এদের তাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা চালায়। তাই তো ব্রিস্টল কাউন্সিলের কর্মকর্তারা এক প্রকার জোর করে এদের ট্রেনের টিকেট কেটে ট্রেনে তুলে বিভিন্ন শহরে পাঠিয়ে দেয়। বিভিন্ন স্থানীয় প্রশাসন বিভিন্ন সময় এদের গৃহ প্রদানের ব্যবস্থা করলেও এদের অধিকাংশই গৃহমুখী হয় না। রাস্তাকেই যেন এরা করেছে আপন। চার. গৃহহীন মানুষগুলো তাদের অজান্তেই যেন রুক্ষ হয়ে ওঠে। যেহেতু প্রকৃতির বিপরীতে এদের পথচলা, তাই হয়তো এদের অনেকেই হয়ে ওঠে বদমেজাজি, হিংস্র। মনস্তাত্বিক কারণেই এদের কেউ কেউ অপ্রকৃতিস্থ। এমনকি কেউ কেউ মানবিক আবেদনটুকুও হারিয়ে ফেলে। আরন বার্লি এরকমেরই একজন গৃহহীন মানুষ ছিলেন। মিডল্যান্ডের ২৩ বছরের ওই গৃহহীন তরুণকে একদিন বাসায় নিয়ে যান এক মমতাময়ী মা ট্রেসি উইলসন। তাকে গরম খাবার দেন, পরে থাকার একটা ব্যবস্থা করে দেন। এবং প্রতি রাতে যাতে এই তরুণ গরম খাবার খেতে পারে সে ব্যবস্থা করেন তার বাসায়। কিন্তু এক রাতে ট্রেসি উইলসনের স্বামী বাসায় ফেরার পর অতর্কিতে তাকে আক্রমণ করে বসে ওই তরুণ। তিনি কোনোরকমে নিজেকে রক্ষা করেন ঠিকই, কিন্তু শয়নকক্ষে গিয়ে দেখেন তার স্ত্রী এবং ছেলে মৃত। ছুরির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত দুজনের নিষ্প্রাণ দেহ। বার্মিংহাম ক্রাউন কোর্টে বিচার চলাকালীন আরন হত্যাকাণ্ড ঘটানোর কথা স্বীকার করলেও কেন এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন, তা প্রকাশ করেননি। ২০১৭ সালের মে মাসে যে পার্কার মানবতার নায়ক হয়ে উঠেছিলেন, সেই পার্কার এ বছরের শুরুতে ম্যানচেস্টার ক্রাউন কোর্টে স্বীকার করেছেন, তিনি সেই ভয়াল রাতে কাউকে সহায়তা দিতে যাননি ম্যানচেস্টার এরিনায়, গিয়েছিলেন তাদের নগদ পাউন্ড, মোবাইল ফোন, ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড হাতিয়ে নিতে। নিয়েছিলেনও। তার জন্য সংগ্রহ করা ৫২ হাজার পাউন্ড ফেরত যাচ্ছে এখন সব দাতার কাছে। পাশাপাশি পার্কারকে প্রস্তুতি নিতেই হচ্ছে জেলে বন্দি জীবন কাটানোর। পাঁচ. প্রিন্স হ্যারি আর ম্যাগেনের বিয়ে হবে এ বছরের মে মাসের ১৯ তারিখ। উইন্ডসর ক্যাসেলের সেইন্ট জর্জ চ্যাপেলে অনুষ্ঠিতব্য এই বিয়েকে উপলক্ষ করে ব্রিটেনের উন্ডসর কাউন্সিল একটা মওকা পেয়েছে। কাউন্সিল লিডার এই সুযোগে হোমলেসদের তার শহর থেকে সরিয়ে দিতে উঠেপড়ে লেগেছেন। রয়েল ফ্যামিলির এই বিয়েকে পুঁজি করে তিনি স্থানীয় পুলিশ বিভাগের মাধ্যমে পরিচ্ছন্ন করতে চান তার কাউন্সিল। কিন্তু এতে বাদ সেধেছে মানবতাবাদী সংগঠন। এমনকি প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মেও উষ্মা প্রকাশ করেছেন। বলেছেন রিমোভ নয়, এদের বাসস্থানের সুযোগ করে দিতে হবে। মানবতা আর মুক্তমতের সুযোগ নিয়ে কতিপয় উগ্রদের একজন সালমান আদবি যেমন ম্যানচেস্টার এরিনার বোমা হামলা চালায়, ঠিক তেমনি মানবতার জয়গান গাওয়া মানুষগুলোর মানবিকতাকে পুঁজি করে এই ব্রিটেনে ঘুরে বেড়াচ্ছে আরন বার্লি কিংবা ক্রিস পার্কারের মতো নৃশংস মানুষও। এদের কারণেই মানবিকতা থমকে দাঁড়ায় যদিও, কিন্তু তবুও তেরেসা মের মতো বলতেই হয়, পুলিশ দিয়ে এদের বিতাড়িত করে শহর পরিচ্ছন্ন করা নয়, এদের বাসযোগ্য উইন্ডসর কাউন্সিলই হতে পারে মানবতার প্রকৃষ্ট সমাধান। ফারুক যোশী : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App