×

ফিচার

শিল্পীর বেশে শ্রমিকের বিদেশ পাড়ি

Icon

মেলা প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ জানুয়ারি ২০১৮, ০২:৪০ পিএম

শিল্পীর বেশে শ্রমিকের বিদেশ পাড়ি
শিল্পীর বেশে শ্রমিকের বিদেশ পাড়ি
সাংস্কৃতিক সফরের নামে বিদেশে মানব পাচার এখন গরমাগরম ইস্যু। চিত্র পরিচালক অনন্য মামুনকে আদম ব্যাপারীর চেহারায় দেখে শীতল স্রোত নামছে শিল্পীদের শরীরে। দেশে দেশে ঘুরে শুটিংয়ের আনন্দ ফিকে হতে বসেছে। যা ছিল তলে তলে, তাই লোকের মুখে মুখে। শিল্পীর বেশে শ্রমিকের বিদেশ পাড়ি এবারই প্রথম নয়। জানাচ্ছেন মাহফুুজুর রহমান
২০১৫ সালের ৬ জানুয়ারি প্রায় ৩০ জনের বিশাল বহর নিয়ে ‘মিশন আফ্রিকা’ ছবির টিম পাড়ি জমায় দক্ষিণ আফ্রিকায়। গোলমাল বেঁধেছিল শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেই। সেখানে কোনো মতে ছাড়া পেলেও জোহানেসবার্গ বিমানবন্দরে আদম পাচারের অভিযোগে আটকে যান ছবির শিল্পী রুবেল, ইমন, অমৃতা ও সিদ্দিকসহ অন্যরা। ১৮ ঘণ্টা আটকে থাকার পর মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নেন শিল্পীরা। দেশে ফিরে তারা বোমা ফাটান। ইউনিটে মাত্র ১০ জন ছিলেন শিল্পী-কুশলী। বাকিরা পাচার হচ্ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকায়। এ ঘটনায় শোবিজে তোলপাড় পড়ে যায়। ‘প্রথম দেখা’ ও ‘মিশন আফ্রিকা’ নামের দুটি ছবির কাজ হওয়ার কথা ছিল দক্ষিণ আফ্রিকায়। দুটি ছবির পরিচালক ছিলেন আহমেদ আলী মÐল এবং মারুফ আহমেদ রিজভী। মÐল ‘মিশন আফ্রিকা’র সঙ্গে তার জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেননি। কিন্তু ওই দুটি ছবির প্রযোজক মশিউর রহমানের আরেকটি ছবি নিয়ে ২০১৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়েছিলেন মÐল। ছবিটির নাম ‘প্রবাসীর প্রেম’। ‘প্রবাসীর প্রেমে’র শুটিংয়ে জোহানেসবার্গে উড়ে গিয়েছিলেন নিরব ও পিয়া। প্রায় দুই সপ্তাহ সেখানে শুটিং করেন তারা। প্রবাসী ব্যবসায়ী মশিউর রহমান প্রযোজনার নামে দক্ষিণ আফ্রিকায় আদম পাচার করেছেন বলে অভিযোগ ওঠে। সেই সময় একসঙ্গে ছয়টি ছবি প্রযোজনার ঘোষণা দিয়েছিলেন মশিউর। সবগুলো ছবিই এখন হিমাগারে। এগুলোর কাজ শেষ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। বিদেশে হরদম শুটিং হলেও শুটিংয়ের আড়ালে আদম পাচারের অভিযোগ নতুন নয়। সাংস্কৃতিক সফরের নামে হরদম সীমান্ত পার করে দেয়া হচ্ছে লোকজনকে। শিল্পীর তকমা লাগিয়ে বিমানবন্দর পার করে দিলেই মোটা অঙ্ক আদম ব্যাপারীর পকেটে। শোবিজে বিষয়টি ওপেন সিক্রেট হলেও প্রমাণের অভিযোগে অনেকেই অবাধে মানব পাচারের মতো ঘৃণ্য অপরাধ করে চলেছেন। সাম্প্রতিক এমনি একটি অপকর্মে শোবিজের ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখে পড়েছে। গত ২৪ ডিসেম্বর মালয়েশিয়ায় পুলিশের জালে ধরা পড়েন খুব অল্প সময়ে লাইমলাইটে আসা তরুণ পরিচালক অনন্য মামুন। ৫৭ জন আদমসহ কুয়ালালামপুরে আটক হন মামুন। ২৩ ডিসেম্বর এক কনসার্টে অংশ নিতে আসিফ, নিরব, শখ, মিষ্টি, আইরিন, আঁখি আলমগীরের মতো শিল্পীরা গিয়েছিলেন কুয়ালালামপুর সফরে। কিন্তু দলের সঙ্গে জুড়ে পাচার হয়ে যায় ৫৭ জন। মালয়েশিয়ার বিমানবন্দরেই ১৫ জনকে আটক করা হয়। পরে তাদের তথ্যের ভিত্তিতে সহযোগীসহ মামুনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। মালয়েশিয়ার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাবিষয়ক একটি বিশেষ এবং কঠোর আইনে অনন্য মামুনসহ ১৯ জনকে আটক রাখা হয়েছে। মূলত জঙ্গি এবং রাষ্ট্রীয় শত্রæদের আটক করা হয় এ আইনে। বিশেষ এ আইনে একজন অভিযুক্তকে ২৮ দিন পর্যন্ত বিনা বিচারে আটক রাখার বিধান রয়েছে। তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে ৮ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে। মামুন ধরা পড়ার পর বেরিয়ে আসছে থলের বিড়াল। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান লাইভ টেকনোলজিসের কমর্চারী হয়েই মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমিয়েছিলেন মামুন। মালয়েশিয়ান পুলিশের রিমান্ডে মামুন প্রকাশ করেছেন লাইভ টেকনোলজিসের নাম। এমন খবর প্রকাশিত হয়েছে। এখন প্রশ্ন উঠেছে মামুনের আয়োজনে অনুষ্ঠিত আগের সফরগুলো নিয়েও। গত ১৪ সেপ্টেম্বর মামুনের নেতৃত্বে ওমানে এক জমকালো শো হয়। ‘ঢালিউড বøাস্ট’ অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে তৌফিক ইউনাইটেড কোম্পানি এলএলসি ও তৌফিক ইউনাইটে কোম্পানি এলএলসির ব্যবস্থাপক তৌফিক-উদ-জামান পলাশ। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন অনন্য মামুন ও লাইভ টেকনোলজিস। আর উপস্থাপনা করেন সুরকার তানভীর তারেক ও কলকাতার পায়েল। অনুষ্ঠানে অংশ নেন শাকিব খান, বিদ্যা সিনহা মিম, নিরব, আইরিন, বিপাশা কবির, ডন, কুদ্দুস বয়াতি, আসিফ আকবর, পড়শি, প্রীতম হাসান, সিদ্দিকসহ আরো অনেকে। সেই আলোচিত সফরেও আদম পাচার হয়েছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ এখন শোবিজের অনেকের। যদিও লাইভের মালিকপক্ষের একজন তাদের বিরুদ্ধে আদম পাচারের অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন। কিন্তু তাতে সন্দেহের আগুন নিভে যায়নি। অনন্য মামুনের আদম পাচার কেলেঙ্কারিতে ঢাকার শোবিজ নড়েচড়ে উঠেছে। বছরের পর বছর সাংস্কৃতিক সফরের নামে যে জমজমাট ব্যবসা হচ্ছিল তা সর্বসম্মুখে চলে আসায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন শোবিজের গোপন আদম ব্যবসায়ীরা। উদ্বিগ হয়ে পড়েছেন শিল্পী সমাজও। যাদের আয়ের একটা বড় অংশ আসে প্রবাস থেকে। কনসার্ট ও কালচারাল শো করেই খ্যাতি-বিত্ত-প্রতিপত্তি অনেক শিল্পীর। এই শিল্পীরা ভয়ে কুঁকড়ে উঠেছেন। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন মামুনের। ইতোমধ্যে চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি মামুনকে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করে দায়মুক্ত হয়েছে। কিন্তু শিল্পীরা দায় এড়াবেন কেমন করে! প্রতিবারই কুকর্ম ধরা পড়ার পর আসমান থেকে মাটিতে পতিত হন তারা। অথচ তাদের ঢাল বানিয়েই মানব পাচারের মতো জঘন্য কাজ হচ্ছে দিনের পর দিন। শিল্পীদের সঙ্গেই হেসে-খেলে বিমানে পাড়ি দিচ্ছে শ্রমিকরা। শিল্পীর লেবেল লাগিয়ে ওরা বিদেশের মাটিতে পা ফেলেই হয়ে যাচ্ছে হাওয়া। থেকে যাচ্ছে স্থায়ীভাবে। এসব দেখেশুনে শোবিজের ভাবমূূর্তি পরিচ্ছন্ন রাখতে প্রতিটি কালচারাল টুরের ওপরে প্রশাসনের কঠিন নজরদারির আহŸান জানিয়েছেন সচেতন শিল্পীরা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App