×

পুরনো খবর

গানের প্রতি এই বিতৃষ্ণার কারণ ‘মিউজিক্যাল অ্যানহেডোনিয়া’

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ জানুয়ারি ২০১৮, ০৪:৪৮ পিএম

গানের প্রতি এই বিতৃষ্ণার কারণ ‘মিউজিক্যাল অ্যানহেডোনিয়া’
অ্যালিসন শ্রেডিয়ান একজন অবসরপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার। বর্তমানে তিনি কাজ করছেন মিউজিক পডকাস্টার হিসেবে। প্রতিদিন নানা রকম গান রেকর্ড করা ও সেগুলো ইন্টারনেটে আপলোড করাই তার কাজ। ১২টি পুরনো কলের গানের রেকর্ড রয়েছে তার। প্রতিদিন প্রচুর গান শুনতে হয় তাকে। তবে এত গান শুনলেও কোনো গানই অনুভব করতে পারেন না তিনি। দুঃখের গানে তার মন খারাপ হয় না, আনন্দের গানে মন ভালোও হয় না কিংবা নাচের গান শুনে নেচে ওঠার ইচ্ছা হয় না তার কখনোই। বরং গান শুনতে তার বিরক্তি লাগে।

আমাদের মধ্যে কেউ কেউ আছে যাদের গান ভালো লাগে না;

ভীষণরকম সংগীতপ্রেমী একটি পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন শ্রেডিয়ান। সংগীতের পরিবেশে বড় হওয়া সত্ত্বেও তিনি হলেন বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৩ থেকে ৫ শতাংশ মানুষের একজন যাদের গানের প্রতি রয়েছে একধরনের বিতৃষ্ণা। গানের প্রতি এই বিতৃষ্ণার ভালো নাম ‘মিউজিক্যাল অ্যানহেডোনিয়া’। অ্যানহেডোনিয়া হলো এক ধরনের সমস্যা যাতে কোনো ব্যক্তি কোনো ধরনের আনন্দই উপভোগ করতে পারে না। এটি ডিপ্রেশনের সাথে সম্পর্কিত। তবে মিউজিক্যাল অ্যানহেডোনিয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি অবস্থা। এটি কোনো অসুখ নয়। ডিপ্রেশন কিংবা কোনো শারীরিক কষ্টের সাথেও এটির কোনো সম্পর্ক নেই। যদিও শ্রেডিয়ান বলেন, “কষ্টের বিষয় একটাই। সেটা হলো সবাই আমাকে নিয়ে মজা করে। কারণ তারা আমার অবস্থাটা বোঝে না। সবাই তো গান পছন্দ করে, তাই না?” কেন হয় এই মিউজিক্যাল অ্যানহেডোনিয়া তা জানতে গবেষকরা করেছেন নানা গবেষণা। পূর্ববর্তী একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, যারা গান বা সংগীত উপভোগ করেন তারা যখন গান শোনেন তখন তাদের শরীরের হৃদস্পন্দন বেড়ে যায় এবং তাদের ত্বকের বিদ্যুৎ পরিবাহিতার পরিবর্তন হয়। এক্ষেত্রে তারা উত্তেজক কোনো গান শুনলে তাদের ত্বকের বিদ্যুৎ পরিবাহিতা স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে বেড়ে যায়। কিন্তু গানের প্রতি যাদের বিতৃষ্ণা রয়েছে অর্থাৎ যারা মিউজিক অ্যানহেডোনিক তাদের শরীরে এ ধরনের কোনো পরিবর্তন দেখা যায় না। সম্প্রতি Proceedings of the National Academy of Sciences গবেষণাপত্রে সংগীতের স্নায়বিক প্রতিক্রিয়া নিয়ে নতুন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।

গান একেকজনের উপর ফেলে একেক রকম প্রভাব;

এ প্রতিবেদনের অংশ হিসেবে বার্সালোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৫ জন শিক্ষার্থীকে সংগীতের প্রতি তাদের প্রতিক্রিয়া জানার জন্য কিছু প্রশ্নের উত্তর লিখতে দেওয়া হয়। এরপর সংগীতের প্রতি তাদের প্রতিক্রিয়ার ক্রমানুসারে তাদেরকে মোট তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। একদল যাদের সংগীতের প্রতি কোনো আগ্রহই নেই, আরেক দল যাদের সংগীতের প্রতি মোটামুটি আগ্রহ রয়েছে এবং সর্বশেষ দল যারা সংগীত খুব ভালোভাবে উপভোগ করেন এবং গান না শুনে যাদের একটি দিনও কাটে না। এই ৩ ভাগে ভাগ করার পর গবেষকরা তাদেরকে গান শুনতে দেন। এ সময় কয়েকটি functional magnetic resonance imagery (fMRI) মেশিনের সাহায্যে তাদের মস্তিষ্কের কার্যকলাপ লক্ষ্য করা হয়।

সবাই যেখানে গান শুনে নেচে ওঠেন মিউজিক্যাল অ্যানহেডোনিকরা সেখানে হন বিরক্ত;

আমাদের মস্তিষ্কে ‘রিওয়ার্ড সিস্টেম’ নামে একটি অংশ রয়েছে। এই রিওয়ার্ড সিস্টেমের ফলে আমরা বিভিন্ন কাজ করে আনন্দ পাই। যেমন কেউ খেয়ে আনন্দ পায়, কেউ বিভিন্ন খেলায় জিতে আনন্দ পায়, কেউ গল্পের বই পড়ে আনন্দ পায় কিংবা কেউ গান শুনে আনন্দ পায়। এক্ষেত্রে গবেষণায় দেখা গেছে, যারা গান উপভোগ করে তাদের মস্তিষ্কের শ্রবণ সংক্রান্ত অংশের সাথে মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড সিস্টেম খুব ঘনিষ্ঠভাবে মিলিত। ফলে গান শুনলেই তারা আনন্দ ও তৃপ্তি অনুভব করেন। কিন্তু যারা মিউজিক অ্যানহেডোনিয়াতে ভোগেন তাদের মস্তিষ্কের শ্রবণ সংক্রান্ত অংশের সাথে রিওয়ার্ড সিস্টেমের যোগাযোগ কম। গান শুনলে তাদের মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড সিস্টেমটি কাজ করে না। তাদের রিওয়ার্ড সিস্টেমে কোনো সমস্যা রয়েছে কিনা দেখার জন্য গবেষকগণ তাদেরকে ভিন্ন একটি খেলা খেলতে বলেন। দেখা যায় খেলায় জেতার পর তাদের মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড সিস্টেম ঠিকমতোই কাজ করছে। অর্থাৎ তারা এক্ষেত্রে আনন্দ পাচ্ছেন।

গান মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড সিস্টেমকে উদ্দীপিত করে, ফলে ভালো লাগে আমাদের;

এরপর গবেষকরা শেষ দলটির উপর পরীক্ষা চালান যারা প্রচণ্ড রকম গান ভালোবাসে, যাদের গান না শুনলে একটি দিনও যায় না। এক্ষেত্রে পরীক্ষায় দেখা যায়, গান শুনলে এ ধরনের মানুষের মস্তিষ্কের শ্রবণ সংক্রান্ত অংশ ও রিওয়ার্ড সিস্টেমের মধ্যে অত্যন্ত শক্তিশালী তথ্যের আদান প্রদান ঘটে। এটি নিয়ে ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ুবিজ্ঞানী রবার্ট জ্যাটোর বলেন,
“গান শুনে আপনার মস্তিষ্ক ঠিক কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে তা আপনার গান শোনার অভিজ্ঞতার সাথে সম্পর্কিত। অর্থাৎ আপনার গান শোনার অভিজ্ঞতা যত বেশি হবে আপনার মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড সিস্টেমের কার্যকলাপ তত বেশি সংঘটিত হবে। সেই সাথে আপনিও তত বেশি মজা পাবেন গান শুনে।”
গবেষক দলের একপ্রান্তে বসেছিলেন ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক পল সিলভিয়া। তিনি পছন্দ করেন রক, জাজ, ইলেক্ট্রনিক ইত্যাদি ধাঁচের মিউজিক। তিনি জানান, তিনি যখন গান শোনেন তখন তিনি শরীরে অন্যরকম একটি শিহরণ অনুভব করেন। দিনের মধ্যে অনেকবারই তিনি গান শুনলে এ ধরনের শিহরণ অনুভব করে থাকেন। সংগীতপ্রেমীরা এ ধরনের শিহরণ প্রায়ই অনুভব করে থাকেন। আমরাও কখনো না কখনো গান শুনে এ ধরনের শিহরণ অনুভব করেছি। যেমন কোনো প্রিয় গান কিংবা আমাদের জাতীয় সংগীত শুনলে আমাদের প্রায় সবারই গায়ে অন্য একধরনের শিহরণ জাগে। গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। এই শিহরণকে বলা হয় ‘ফ্রিশন’। দুর্ভাগ্যবশত যারা মিউজিক অ্যানহেডোনিক তাদের ক্ষেত্রে এটি হয় না। তারা গান শুনে এ ধরনের কোনো শিহরণ শরীরে অনুভব করেন না।

কিছু গান আমাদের শরীরে শিহরণ জাগায়;

গবেষক সিলভিয়া জানান,”আমি এই ধরনের শিহরণগুলো খুব উপভোগ করি।” তিনি আরো বলেন, গানের মাধ্যমে মানুষ তার মনের যে আবেগটিকে প্রকাশের চেষ্টা করে সেটা এই শিহরণের মাধ্যমেই বোঝা যায়। এর ফলেই কোনো কোনো গান শুনে আমরা কেঁদে ফেলি। সিলভিয়া জানান, তিনি গবেষণায় দেখেছেন যাদের গান শুনে শরীরে এ ধরণের শিহরণ হয় তারা সাধারণত খোলা মনের মানুষ হন। নতুন নতুন অভিজ্ঞতার প্রতি তাদের থাকে অনেক আগ্রহ। এ ধরনের মানুষ নতুন নতুন গান শুনতে ভালোবাসেন, নতুন নতুন বাদ্যযন্ত্র বাজাতে ভালোবাসেন। গানের এই বিতৃষ্ণা নিয়ে আবিষ্কার গবেষকদের মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড সিস্টেম নিয়ে অন্যান্য অনেক গবেষণার সুযোগ করে দিয়েছে। স্নায়ুবিজ্ঞানী জ্যাটোর বলেন,
“মিউজিক্যাল অ্যানহেডোনিয়াতে যেমন মানুষ সংগীত ছাড়া অন্য সব কিছুর প্রতি প্রতিক্রিয়া দেখায়, তেমনি এমনও কিছু মানুষ রয়েছে যারা সংগীত ছাড়া অন্য কোনো কিছুর প্রতি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। এ গবেষণার ফলে তারা হয়তো এখন সংগীতের মাধ্যমে তাদের রিওয়ার্ড সিস্টেমকে কাজে লাগাতে পারবে। হয়তো তারা সংগীতের মাধ্যমেই তাদের মনের অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে ভবিষ্যতে।”
জ্যাটোর জানান, তার এই আবিষ্কারের ফলে যারা মিউজিক্যাল অ্যানহেডোনিয়াতে ভুগছেন তাদের সাথে তাদের বন্ধু ও পরিবারের বন্ধন আরো দৃঢ় হয়েছে। তাদের বন্ধু ও পরিবারের সদস্যরা বুঝতে পেরেছেন কেন তাদের প্রিয় মানুষটি গান পছন্দ করে না, কেন সে গান শুনলে বিরক্তি বোধ করে।

মিউজিক্যাল অ্যানহেডোনিয়া কোনো মানসিক সমস্যা নয়;

আমাদের মধ্যে হয়তো অনেকেরই এমন কোনো বন্ধু রয়েছে যে গান পছন্দ করে না। কিংবা কোনো গান শুনলে যার কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না বরং বিরক্তি লাগে। আমরা যারা গান পছন্দ করি, কোনো গান শুনে আমাদের যখন নেচে উঠতে ইচ্ছা করে ঠিক তখন সেই বন্ধুটি হয়তো গানটি শুনে বিরক্ত হয়। ফলে আমরা হয়তো এতদিন সেই বন্ধুটিকে অসামাজিক, মানসিক রোগী কিংবা এলিয়েন ভেবে এসেছি। কিন্তু এখন থেকে এমনটা আর নয়। মিউজিক্যাল অ্যানহেডোনিয়া কোনো বিশেষ মানসিক সমস্যা নয়। এটি বর্ণান্ধতার মতোই একটি স্বাভাবিক সমস্যা। তাই আপনার বন্ধুটির যদি এমন সমস্যা থাকে তবে এটি নিয়ে মজা না করে নিজে সমস্যাটিকে বুঝুন এবং সেই সাথে তাকেও জানিয়ে দিন সমস্যাটি সম্পর্কে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App