×

পুরনো খবর

মিষ্টি আলুর গুণগান

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ ডিসেম্বর ২০১৭, ১১:৪২ এএম

শর্করা জাতীয় খাবারের তালিকায় আলু এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই আলুর নানা প্রকারের মাঝে ভিন্ন স্বাদের এক আলুর নাম ‘মিষ্টি আলু’। পুষ্টি উপাদানে ভরপুর এই মিষ্টি আলুতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, খনিজ পদার্থ এবং উপকারী তন্তু। সুস্থ থাকতে, ক্যান্সার মোকাবেলায়, বহুমূত্র রোগ প্রতিরোধে এবং নিয়ন্ত্রণে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে মূত্রথলির নানা জটিলতা রোধে এক প্রাকৃতিক ওষুধ এই মিষ্টি আলু। শুধু তা-ই নয়, হৃদপিণ্ড সুস্থ রাখতে, ত্বক সুন্দর রাখতে, এমনকি চোখ ভালো রাখতেও এটি কাজ করে। এতো উপকারী খাদ্যটিকে অনেকেই হেলাফেলা করে থাকলেও সব জানার পর অন্তত এর কদর বাড়বে।

মিষ্টি আলু

খাদ্য হিসেবে পরিচিতি সে বহুকাল আগের কথা। মানুষ যখন বিভিন্ন গাছ বা ফল বা গাছের মূল, কাণ্ড ইত্যাদি খুঁজে বেড়াতো বেঁচে থাকার তাগিদে, সে সময় এই মিষ্টি আলুকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ শুরু হয়েছে। প্রাগৈতিহাসিক যুগের কিছু প্রমাণ মিলেছে পেরুর গুহা থেকে। প্রায় ১০,০০০ বছর আগে সেখানে মিষ্টি আলু পাওয়া যেত বলে নিশ্চিত হয়েছেন গবেষকগণ। ১৪৯২ সালে, ক্রিস্টোফার কলম্বাস যখন বিশ্ব ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন তখন এই মিষ্টি আলুগুলোকে ইউরোপে নিয়ে যান। এরপর ষোড়শ শতকের দিকে স্প্যানিশদের মাধ্যমে মিষ্টি আলু পৌঁছে যায় ফিলিপাইনে। আফ্রিকা, ভারত, ইন্দোনেশিয়া এবং বাংলাদেশ সহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতেও এই আলু পৌঁছে যায় পর্তুগীজ বণিকদের মাধ্যমে। ঐ সময়েই দক্ষিণ আমেরিকায় মিষ্টি আলুর চাষ শুরু হয়ে গিয়েছিল এবং এখনো যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী খাবার হিসেবে রয়েছে এই মিষ্টি আলুর চল।

নানা বর্ণের মিষ্টি আলু

চীনে প্রতি বছর প্রায় ৮০ মিলিয়ন টন মিষ্টি আলু উৎপাদিত হয়। এছাড়াও আফ্রিকায় ১৪ মিলিয়ন টন, যুক্তরাষ্ট্রে ১ মিলিয়ন টন মিষ্টি আলু উৎপাদিত হয়। মিষ্টি আলুতে পুষ্টি উপাদানসমূহ মিষ্টি আলু পুষ্টিতে ভরপুর এক খাবারের নাম। এতে থাকা পুষ্টি উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে
  • ভিটামিন ‘এ’
  • ভিটামিন ‘সি’
  • ম্যাঙ্গানিজ
  • কপার
  • পেন্টোথেনিক এসিড
  • ভিটামিন ‘বি-৬’
  • পটাসিয়াম
  • হজমকারক আঁশ
  • ফসফরাস
  • ভিটামিন ‘বি-২’
  • ভিটামিন ‘বি-৩’
  • ক্যারোটিন
  • পলিস্যাকারাইড
মিষ্টি আলুর উপকারিতা নানা গুণে ভরপুর এই মিষ্টি আলুর গুণগান করে শেষ করা যাবে না। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি উপকারিতা হলো- ক্যান্সার প্রতিরোধ শুধু মিষ্টি আলুই নয়, সম্পূর্ণ উদ্ভিদটিই ক্যান্সার প্রতিরোধে কাজ করে। রক্তবর্ণের মিষ্টি আলুগুলোতে রয়েছে প্রাকৃতিক অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং টিউমার প্রতিরোধী উপাদান, যা ভেষজ ওষুধ হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। তাইওয়ানে মিষ্টি আলুর পাতাকে প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় রাখা হয়। এর উপর গবেষণা করে দেখা গিয়েছে, মিষ্টি আলুর পাতায় প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’, আলফা-ক্যারোটিন এবং বিটা-ক্যারোটিন, যা ফুসফুসের ক্যান্সারকে প্রতিরোধ করে। উল্লেখ্য, ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ যেকোনো খাবারই প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় রাখা গেলে সহজেই ফুসফুসের ক্যান্সারের ঝুঁকি এড়ানো যায়।

মিষ্টি আলু গাছের ডগা

মিষ্টি আলুর খোসাও অ্যান্টি-অক্সিডেন্টে ভরপুর। এই মিষ্টি আলুর খোসা মাথা, ঘাড়, স্তন, মলাশয় এবং ডিম্বাশয়ের কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি রহিত করে এ সকল ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। হৃদপিণ্ডের যত্ন হৃদপেশির প্রসারণশীলতা বা টান ঠিক রাখতে মিষ্টি আলু খুবই কার্যকর বলে গবেষণায় জানা গিয়েছে। ইঁদুরের উপর গবেষণায় দেখা গিয়েছে, মিষ্টি আলুর ‘ভেসোরিলাক্সেশন ম্যাকানিজম অফ অ্যাকশন’, বা হৃদপিন্ডের প্রকোষ্ঠগুলোর সংকোচন-প্রসারণশীলতা ভাল রাখতে অ্যাসিটাইলকোলিনের মতোই কাজ করে মিষ্টি আলু। ত্বকের সংবেদনশীলতা রক্ষা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ত্বকের জন্য কতটা উপকারী, সেটা সকলেই জানেন। যেহেতু মিষ্টি আলুতে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট রয়েছে, তাই এটি ত্বকের জন্য খুবই উপকারী। এছাড়াও এতে রয়েছে ভিটামিন ‘এ’ এবং ভিটামিন ‘সি’, যা ত্বকের বলিরেখা দূর করে এবং ত্বককে করে তুলে আরও প্রাণবন্ত।

মিষ্টি আলুর গাছ

মিষ্টি আলু শুধু ত্বক সুন্দর রাখতেই কাজ করে না, বরং এটি ক্ষত নিরাময়েও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আগুনে পোড়া ক্ষত এবং আঘাতে হওয়া ক্ষত রোধে ওষুধের পাশাপাশি মিষ্টি আলু গ্রহণ করা হলে খুব দ্রুত ক্ষত নিরাময় সম্ভব। এছাড়াও যাদের র‍্যাশ বা অ্যালার্জিজনিত সমস্যা রয়েছে তাদের জন্যেও মিষ্টি আলু খুবই উপকারী। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ নামেই যার মিষ্টি জড়িয়ে রয়েছে, তা কীভাবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করবে এমন প্রশ্ন মনে আসা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু বহুকাল আগে থেকেই ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে মিষ্টি আলু ব্যবহৃত হয়ে আসছে। একটি গবেষণা করা হয়েছিল ডায়াবেটিক রোগীদের উপর। গবেষণায় অংশগ্রহণকারী ১৪০ জন ডায়াবেটিস রোগীকে প্রতিদিন ৪ গ্রাম করে মিষ্টি আলু খেতে বলা হয়। ৩-৫ মাস পর দেখা গেল তাদের ডায়াবেটিস পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে!

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রয়েছে মিষ্টি আলুর ভূমিকা

মিষ্টি আলুর পাতাও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মিষ্টি আলুর পাতায় রয়েছে বিভিন্ন পলিফেনল, যেগুলো দেহের গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে। একটি গবেষণায় এর পাতার গুঁড়া টাইপ-২ ডায়াবেটিস আক্রান্ত ইঁদুরের উপর ৫ সপ্তাহ ধরে প্রয়োগ করে দেখা গিয়েছে, এটি গ্রহণে দেহে গ্লুকাগনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। যা খাবারের পরে রক্তে চিনির মাত্রা বাড়াকে প্রতিরোধ করে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি মিষ্টি আলু গ্রহণের একটি বড় উপকারিতা হলো এটি দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। ইঁদুরের উপর গবেষণায় দেখা গিয়েছে মাত্র সাতদিন মিষ্টি আলু গ্রহণ করেই সেগুলোর রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা আরও ভাল কাজ করছে! দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখা মিষ্টি আলুতে থাকা ভিটামিন ‘এ’ চোখের জন্য খুবই উপকারী। এছাড়াও মিষ্টি আলুতে রয়েছে অ্যান্থোসায়ানিন, যা চোখের রেটিনার রঞ্জক কোষের বৃদ্ধি ও রক্ষায় কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। আলসার প্রতিরোধ পেটের পীড়ায়, পাকস্থলীর ক্যান্সার প্রতিরোধেও মিষ্টি আলুর জুড়ি মেলা ভার। শুধু তা-ই নয়, মিষ্টি আলু গ্যাস্ট্রিক আলসার প্রতিরোধেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যাদের আলসার রয়েছে তারা যদি প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় মিষ্টি আলু রাখেন, তাহলে আলসার প্রতিকারে কাজ করে। এই তথ্যও ইঁদুর নিয়ে করা গবেষণা থেকে প্রাপ্ত। তবে এতে অক্সালেট থাকায় কিডনি এবং পিত্তথলির সমস্যা থাকলে মিষ্টি আলু কম গ্রহণ করাই শ্রেয়। ওজন নিয়ন্ত্রণ খেয়েও ওজন কমানো যায়– ব্যাপারটি অবিশ্বাস্য হলেও সত্য। মিষ্টি আলুতে ক্যালরির পরিমাণ কম থাকলেও রয়েছে জটিল কার্বোহাইড্রেট, যা পুষ্টিগুণে পূর্ণতা দেয়। এতে রয়েছে স্থূলতা নিরাময়কারী উপাদান, যা দেহে চর্বি জমতে দেয় না। কীভাবে খাবেন? এতো পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাদ্যটি কীভাবে খেলে পুষ্টি উপাদানগুলো ঠিকঠাকভাবে পাবেন, তা জানাটা খুব জরুরি। রান্না করে বা শুধু সেদ্ধ করে মিষ্টি আলু খাওয়া যায়। তবে যেভাবেই খাওয়ার উপযোগী করুন না কেন, বেশিক্ষণ সময় নেয়া যাবে না। সেদ্ধ করা মিষ্টি আলুতে সবচেয়ে ভালোভাবে পুষ্টি উপাদানগুলো পাওয়া যায়। যেভাবে সেদ্ধ করা স্বাস্থ্যসম্মত খোসাসহ মিষ্টি আলুকে ১/২ টুকরা করে কেটে নিন। এবার একটি পাত্রে পানি নিয়ে তাতে আলুর টুকরোগুলো ৭ মিনিট ধরে সিদ্ধ করুন। ৭ মিনিট সেদ্ধ করলে মিষ্টি আলুর সবচেয়ে ভালো স্বাদ পাওয়া যায় এবং এর পুষ্টিগুণ বৃদ্ধি পায়।

হালকা সেদ্ধ মিষ্টি আলু

যদি আরও একটু স্বাদ আনতে চান, তাহলে এর সাথে দারুচিনি, লবঙ্গ এবং জায়ফল দিয়ে নেবেন। এতে করে স্বাদ বাড়ার সাথে সাথে পুষ্টিগুণও বাড়বে। খেতে পারেন পুড়িয়েও ২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ৫ মিনিট পুড়িয়েও খেতে পারেন মিষ্টি আলু। গবেষণায় দেখা গিয়েছে এভাবে প্রস্তুতকৃত মিষ্টি আলুতে বিটা-ক্যারোটিন আলুর সর্বত্র সঠিক মাত্রায় অবস্থান নিতে পারে। তাহলে আর দেরি কেন? আজ থেকেই দৈনিক খাদ্যতালিকায় যুক্ত করুন পুষ্টিতে ভরপুর এই মিষ্টি আলু।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App