×

মুক্তচিন্তা

একাত্তর : আমার গৌরবের ঠিকানা

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ ডিসেম্বর ২০১৭, ০৮:৩০ পিএম

বাঙালি জাতির জীবনে সবচেয়ে গৌরব ও অহঙ্কারের বিষয় হলো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। কোনো জাতির জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে শরিক থাকা, সামান্যতম অবদান রাখতে পারা যেকোনো ব্যক্তির জন্য গর্বের ব্যাপার। আমি নিজে গৌরবান্বিত মনে করি এ জন্য যে, বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি এবং সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়ার সুযোগ আমার হয়েছিল। বাংলাদেশকে পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত করার লড়াইয়ে আমার অতি ক্ষুদ্র, কিন্তু প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল।

আমি ছাত্র জীবনেই প্রগতিশীল রাজনীতির সংস্পর্শে আসি। শোষণ-বঞ্চনামুক্ত একটি উদার, গণতান্ত্রিক, সমতাভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়েই ছাত্র আন্দোলনে শরিক হয়েছিলাম। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম নেতা অজয় রায়ের সঙ্গে পরিচয় ও পরিণয় আমার রাজনৈতিক বিশ্বাসকে আরো দৃঢ় করেছিল।

১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শুরুতেই এটা অনেকের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে, পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী সত্তরের নির্বাচনের গণরায় মেনে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেহেতু বাঙালি সেহেতু তার কাছে ক্ষমতা দেয়ার ব্যাপারে পাকিস্তানি শাসক মহলের ছিল প্রচণ্ড অনীহা। নির্বাচনের ফলাফল ছিল শাসকচক্রের বিবেচনার বাইরে। যখন তারা দেখল, বাঙালি ব্যালটের মাধ্যমে পাকিস্তানিদের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে দিয়েছে, তখন তারা বেছে নেয় ষড়যন্ত্রের পথ, চক্রান্তের পথ।

বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পারেন কী ঘটতে চলেছে। একাত্তরের ৭ মার্চ তিনি ঘোষণা দিলেন : এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। যার যা আছে তা নিয়েই প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানিয়ে ঘরে ঘরে দুর্গ বানানোর আহ্বানও জানিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।

২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানিরা অতর্কিতে বাঙালি জাতির ওপর সশস্ত্রভাবে হামলে পড়ার মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। আমরা তখন ময়মনসিংহে ছিলাম। ১ মার্চ থেকেই আমরা আসলে ধীরে ধীরে স্বাধীনতার পথেই হাঁটতে শুরু করেছিলাম। ২৫ মার্চ পর্যন্ত পরিস্থিতি ছিল এক রকম। কিছুটা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-দোদুল্যমানতা ছিল, শেষ পর্যন্ত শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হবে, শান্তিপূর্ণভাবে সংকট নিরসন হওয়ার একটি ক্ষীণ আশা অনেকের মনে জেগে ছিল। কিন্তু ২৫ মার্চের রাত এবং তার পরের সময় আমাদের নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।

পাকিস্তানিদের বাঙালি নিধনপর্ব শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের প্রতিরোধ যুদ্ধও শুরু হয়। তবে সেটা ছিল অসম যুদ্ধ। একটি প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নিরস্ত্র মানুষের ‘যা আছে তা নিয়ে’ মোকাবেলা খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। তবে ওই চরম দুঃসময়েও বাঙালি হতবিহ্বল না হয়ে সাহসের সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করেছে। আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ঘরবাড়ি ছাড়তে হয়েছে।

আমরাও দেশের ভেতরে কয়েক বার আশ্রয় বদল করে জুন মাসে গিয়ে পৌঁছাই আগরতলায়। সেখানে তত দিনে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের অনেক নেতাকর্মী সমবেত হয়েছেন। আগরতলার বিখ্যাত ক্র্যাফট হোস্টেল তখন বাংলাদেশের বাম প্রগতিশীলদের উপস্থিতিতে জমজমাট। মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নেয়ার প্রাথমিক প্রস্তুতি। কারা গেরিলা ট্রেনিং নেবেন তার বাছাই কাজ চলছে। মুক্তিযুদ্ধ বলতে যারা শুধু অস্ত্র হাতে সম্মুখ সমরে অংশ নেয়াকেই বোঝেন তারা বিষয়টি খুব সংকীর্ণ অর্থেই দেখে থাকেন। সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালানোর জন্য যেমন সলতে পাকাতে হয় আগে, তেমনি অস্ত্র হাতের যোদ্ধা তৈরিরও লাগে একটি প্রস্তুতি।

ক্র্যাফট হোস্টেলে আমরা নারী কর্মীরা মূলত সলতে পাকানোর কাজই করেছি। মানুষকে বাঁচতে হলে খেতে হয়। আর এই খাবার তৈরির কাজে প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা জ্ঞান চক্রবর্তী এবং অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরীর নেতৃত্বে আমরা নারী কর্মীরা অংশ নিয়েছি। আমি অবশ্য পুরো সময় আগরতলায় ছিলাম না। স্বামী অজয় রায়ের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা, আসামের গৌহাটি এবং মেঘালয়ের বিভিন্ন শিবিরে থেকেছি এবং নানা ধরনের কাজ করেছি। তখন সবার ছিল প্রচণ্ড অর্থ কষ্ট। আমরা আত্মীয়-পরিজনের কাছ থেকে কিছু অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করেছি। জামাকাপড়, ওষুধপত্র ইত্যাদি সংগ্রহ করে তা বিলিবণ্টন তদারকি করেছি। গৌহাটিতে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার কাজে স্থানীয় ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই) নেতা ফণি বড়ালের আন্তরিক সহযোগিতা পেয়েছি।

শরণার্থী শিবিরগুলোতে হাজার হাজার মানুষ অবর্ণনীয় দুঃখকষ্টের মধ্যে জীবন কাটিয়েছেন। আমরা তাদের কাছে গিয়ে বলেছি, এই দুঃখের রাত অবশ্যই পোহাবে। ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়নসহ গণতান্ত্রিক মানবতাবাদী বিশ্বশক্তির সমর্থন ও সহযোগিতায় আমরা অবশ্যই বিজয় ছিনিয়ে আনব।

একাত্তরের কত স্মৃতি মনে পড়ে। একদিকে উদ্দীপনা জাগে, আবার একটু ভারাক্রান্তও হই। মানুষের মধ্যে তখন দুঃখজয়ের যে অদম্য আকাক্সক্ষা লক্ষ করেছি তা কখনো ভুলব না। মানুষ মানুষের জন্য জীবন উৎসর্গ করার এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছিল তখন। আত্মস্বার্থে নিমগ্ন মানুষ তখন কম দেখেছি। একটি ঘটনার কথা খুব মনে পড়ছে। তখন আমি মেঘালয়ে। অজয় রায় গেছেন দিল্লিতে সিপিআই নেতা ভূপেশ গুপ্তের সঙ্গে দেনদরবার করে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বাড়তি প্রয়োজনীয় সামগ্রী পাওয়া যায় কিনা সেটা নিশ্চিত করতে। সে সময় হঠাৎ আমার কাছে এলেন জামালপুরের কমিউনিস্ট নেতা মন্মথ দে। জানালেন, মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য ২০০ তরুণ একসঙ্গে সীমান্ত অতিক্রম করে এসেছে। ২/৩ দিন ওদের পেটে কোনো দানাপানি পড়েনি। ওদের জন্য খাবার ব্যবস্থা করা জরুরি।

আমার হাতে তখন কোনো নগদ টাকা ছিল না। মন্মথ দার অসহায় করুণ মুখ দেখে খুব খারাপ লাগছিল। কী করা যায় ভাবতে ভাবতে মুহূর্তে আমার মন ভালো হয়ে গেল। আমার গলায় তখন তিন ভরি স্বর্ণের একটি হার ছিল। আগপিছ কিছু না ভেবে হারটি খুলে মন্মথ দার হাতে তুলে দিলাম। তিনি একটু ইতস্তত করছিলেন। আমি বলছিলাম, কোনো সংকোচ করবেন না দাদা। একটি স্বাধীন দেশের পতাকা পাওয়ার স্বপ্ন পূরণের চেয়ে একটি সোনার হার বেশি মূল্যবান নয়। দেশ স্বাধীন হলে সোনার হারের অভাব হয়তো হবে না।

আমরা স্বাধীন দেশের পতাকা ও মানচিত্র পেয়েছি। এ জন্য আমাদের অনেক উচ্চমূল্য দিতে হয়েছে। ৩০ লাখ মানুষের জীবন, ৩ লাখ নারীর সম্ভ্রম, কোটি কোটি মানুষের চরম দুর্গতি-দুর্ভোগ- এ কি কম কথা! অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক-সমতাভিত্তিক যে বাংলাদেশের জন্য আমরা একাত্তরে যুদ্ধে গিয়েছিলাম, সামান্য হলেও ত্যাগ স্বীকার করেছিলাম সে স্বপ্নের বাংলাদেশ ক্রমেই আমাদের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে কিনা- এই প্রশ্নটাই ইদানীং কুরে কুরে খাচ্ছে। তবে আশা হারাই না। আমাদের ধমনীতে শহীদের রক্ত, এ রক্ত পরাভব মানে না।

জয়ন্তী রায় : মুক্তিযোদ্ধা, লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App