×

মুক্তচিন্তা

কোটি বাংলাদেশি বিদেশে চিকিৎসা করাতে পারে না

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ ডিসেম্বর ২০১৭, ০৮:৩৫ পিএম

একদিন প্রতিদিন

\\ দুই \\

দেশের সব মানুষ ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, ভারত বা লন্ডনে গিয়ে চিকিৎসা করাতে পারবে না। কোনো কোনো জটিল রোগের চিকিৎসা বাইরে হলেও আমাদের সাধারণ স্বাস্থ্যসেবা তো দেশেই পেতে হবে। আমাদের সবারই বক্তব্য- এই খাতে যেসব সংকট রয়েছে তার আশু সমাধান আমাদের বের করতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে যে, আমাদের পরিবারের চিকিৎসার ব্যাপারটি স্বদেশেই যেন করতে পারি।

১৩ নভেম্বর ২০১৭, বিকেলে আমি ফেসবুকে এই বিষয়ক একটি পোস্ট দেই। পোস্টটি যা ছিল তার সঙ্গে আরো কিছু কথা যোগ করলে সেটি এমন হতে পারে। ‘আমি ঠিক বুঝি না আমাদের চিকিৎসাসেবার সংকটটা কোথায়? আমার মেয়ে ডাক্তার। ডাক্তারি পড়তে কত কষ্ট করতে হয় সেটি আমি আমার মেয়েকে দেখে আন্দাজ করতে পেরেছি। আইটেম মুখস্থ করা আর সপ্তাহে সপ্তাহে পরীক্ষা দেয়া খুব কঠিনতম একটি লড়াই। সেই লড়াই পার করে সে এখন আন্তর্জাতিক একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করে। তার জীবনের ঝুঁকিগুলো আমি দেখি আর আঁতকে উঠি। আফগানিস্তান থেকে খাইবার পাস দিয়ে সে যখন পাকিস্তানে আসার পথে গোলাগুলিতে পড়ে তখন বুঝেছিলাম ডাক্তারি কত ঝুঁকির পেশা। সিরিয়ায় যখন ছিল তখন টেনশনে থাকতাম। নাইজেরিয়া বা উজবেকিস্তানের কথাও মনে পড়ে। আমার বাবা পাস করা ডাক্তার ছিলেন না। কিন্তু তিনি সারা জীবন বিনামূল্যে হোমিওপ্যাথি ওষুধ দিয়ে মানুষকে সুস্থ করে গেছেন। বাবা চাইতেন আমি ডাক্তার হই। কিন্তু আমার স্কুলে বিজ্ঞান শিক্ষাই ছিল না। ফলে আমার ডাক্তার হওয়া হয়নি। মেয়ে ডাক্তার হয়েছে তাতেই আমি দারুণ খুশি। ওকে দিয়ে আমার বাবার ইচ্ছা সফল হয়েছে সেটাই বড় কথা। এরপর আমার ছোট ভাইয়ের মেয়ে বহ্নি ও নাতনি শামীমা ডাক্তার হয়েছে। ওদের নিয়ে আমি গর্ব করি। হয়তো পিতা ও কন্যার জন্যও ডাক্তারদের আমি ভীষণ সম্মান করি। আমি ডাক্তারদের কাছ থেকে ভীষণ সম্মানও পাই। অনেক চিকিৎসক ডাক্তারের পিতা বলে ফিস নেন না। অনেক ডাক্তার নিজে উঠে এসে বাইরে থেকে চেম্বারে নিয়ে যান। আমরা ১৬ কোটি মানুষ তো এভাবে ওদের চিকিৎসাতেই সচরাচর রোগমুক্ত থাকি। ওরাই তো আমাদের জীবন বাঁচাতে সহায়তা করে। কিন্তু কোনো কোনো সময়ে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার সংকটটা আমি বুঝি না। আমাদের ডাক্তারদের সেবায় সুস্থ থাকার পরও কোনো কোনো সময়ে যে ধরনের সংকটে জড়িয়ে পড়ি তার কথা ভুলে থাকা যায় না।

আমার নিজের কথাই বলি। বহু বছর আগে একজন প্রখ্যাত চক্ষু চিকিৎসককে আমার চোখ দেখালাম। তিনি বললেন, আমার গ্লুকুমা হয়েছে। ওষুধ দিলেন। এক বছর সেই ওষুধ দিতে থাকলাম। হঠাৎ আমার বন্ধু কাফি আমাকে বাড়ির পাশে কলকাতায় নিহার মুন্সী আই হসপিটালের মানস ঘোষালকে আমার চোখটা দেখাতে বললেন। সেই ডাক্তার আমার চোখ দেখে বললেন, আর যাই হোক তোমার চোখে গ্লুকুমা নেই। গ্লুকুমার চিকিৎসা ছেড়ে ২৫ বছর যাবৎ চোখে ভালোই দেখছি। তবে এরই মাঝে বয়সের জন্য চোখে ছানি হয়েছে এবং তার চিকিৎসা বাংলাদেশেই করিয়েছি। ভালোই আছি। ২০১১ সালে আরামবাগের অফিসে থাকতেই একদিন বুকে ব্যথা লাগল। শরীরটা ঘেমে গিয়েছিল এবং আমি হাসপাতালে গিয়েছিলাম। আমাকে দেখে ডাক্তার বললেন, এখনই এনজিওগ্রাম করে রিং পরাতে হবে। আমি ডাক্তার মহোদয়কে অন্য কোনো চিকিৎসা বা পরীক্ষার বিষয় বোঝাতে পারলামই না। আমি ডিজিটাল এনজিওগ্রাম করে রিংয়ের দিকে গেলামই না। একটি ডিজিটাল এনজিওগ্রাম করালাম। তাতে বলা হলো- আমার ব্লক আছে। কিন্তু আমার মনে হলো শরীরে যেহেতু তেমন কোনো লক্ষণ নেই তখন রিং পরানোরও কোনো কারণ নেই। সেই বছরেরই ১৩ মে ব্যাংকক হাসপাতালের ডাক্তারকে দেখালাম। তিনি ইটিটিসহ কিছু টেস্ট করে বললেন, কেবল ডায়াবেটিসটা নিয়ন্ত্রণে রাখবেন আর কিছু না। তিনি এনজিওগ্রামের নামও নিলেন না। আমি লক্ষ করেছি, আমাদের হৃদরোগ চিকিৎসকরা বুকে ব্যথা শুনলেই এনজিওগ্রাম করান। তার আগে ইটিটি বা ইএসটি করে পরে এনজিওগ্রাম করার কথা বলেন না। এর যে কী কারণ সেটি আমার বোঝারই কথা না। কিন্তু আমি থাই ডাক্তারকে এনজিওগ্রাম বা রিংয়ের কথা উচ্চারণ করতেই শুনলাম না। গত বছর আমার ছেলের হিমোগ্লবিন বেড়ে গেল। টেস্ট করিয়ে ডাক্তার ক্যান্সার সন্দেহ করে চিকিৎসা শুরু করলেন। সে কুয়ালালামপুরে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের হাসপাতালে গিয়ে জানল, ক্যান্সার হওয়ার তথ্যটা ভুল। বিজয়ের মায়ের এপেনডিক্স অপারেশন করে জানা গেল, সেটির দরকারই ছিল না। অকারণে তার এনজিওগ্রামও করা হয়েছে। এপেনডিক্স অপারেশনের পর তিনি কিডনি জটিলতায় পড়লেন। সেই যে জটিলতার শুরু; তিন চারটি হাসপাতাল ও আধা ডজন ডাক্তার বদল করে সুস্থ থাকার কোনো উপায় পাচ্ছি না। এবার তিনি ডায়ালাইসিসে যাচ্ছেন।

আমার এই ধরনের স্ট্যাটাসটি ফেসবুকে দেয়ার পর ১৪ নভেম্বর ১৯১৭ বিকাল অবধি মাত্র ২৪ ঘণ্টায় ৬২২টি লাইক, ১১২টি শেয়ার এবং ৫০টি মন্তব্য পেয়েছে। আমার ফেসবুকের কোনো স্ট্যাটাসে সচরাচর এত আলোড়ন ওঠে না। কোনো কোনোটিতে যদিও এর চাইতে অনেক বেশি প্রতিক্রিয়া হয় তবুও এতে যেসব মন্তব্য আমি পেয়েছি সেটি চমকে ওঠার মতো। অনেকেই তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন। অনেকে বিষয়টিকে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। আমার কাছে মনে হয়েছে যে, প্রসঙ্গটিকে খুবই গুরুত্ব দিয়ে দেখা দরকার। আমরা খুব ভালো করেই জানি যে, দেশের সব মানুষ ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, ভারত বা লন্ডনে গিয়ে চিকিৎসা করাতে পারবে না। কোনো কোনো জটিল রোগের চিকিৎসা বাইরে হলেও আমাদের সাধারণ স্বাস্থ্যসেবা তো দেশেই পেতে হবে। আমাদের সবারই বক্তব্য- এই খাতে যেসব সংকট রয়েছে তার আশু সমাধান আমাদের বের করতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে যে, আমাদের পরিবারের চিকিৎসার ব্যাপারটি স্বদেশেই যেন করতে পারি।

আসুন ফেসবুকে যেসব মন্তব্য পেশ করা হয়েছে সেগুলো একটু দেখি। আমেনা হাসান লিখেছেন, যদি সবাই একইভাবে ভাবতে পারত। ফারহানা খান লিখেছেন, আমরা বাঁচি না তো স্যার, রোজ মরি। কিন্তু কেউ দেখছে না। লঙ্কেশ্বর রায় লিখেছেন, আমিও একই ভুক্তভোগী। মায়া শারমিন আমার মন্তব্যটিকে সত্যি বলে মন্তব্য করেছেন। শেখ মাহবুব জুয়েল লিখেছেন, শুধু পরীক্ষা পাস দেয়ার জন্য সিলেবাস ভিত্তিতে পড়াশোনা বা লেখাপড়া ব্যবস্থার যে কুফল সেটাই হয়তো আমাদের সমস্যার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। মনিরুল হক লিখেছেন, আমারও একই কথা। ১৯৯৬ তে কলকাতার এক ডাক্তার বলেছিল আমরা লন্ডনে একই হাসপাতালে পড়াশোনা করেছি। আমার থেকে (ঢাকার এক ডাক্তারের নাম করে বলেছিল) ভালো রেজাল্ট ছিল তার। তাকে রেখে আপনারা কেন কলকাতায় আসেন। চিকিৎসাসেবা নিয়ে কেন জানি শুধু আমার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে তা লিখলে রিম খানেক কাগজ লাগবে। তবে আমার মনে হয় এই পেশার সঙ্গে যে মানবিক দিকটি আছে তা আমাদের চিকিৎসকরা ভুলে যান। এমন চিকিৎসক আছেন যারা দিনে ১০০-এর ওপরে রোগী দেখেন। তারপরও সরকারি চাকরি করেন। রোগীর ব্যাপারে চিন্তা করার সময় কোথায়। আর বেসরকারি হাসপাতালের কথা না-ই বা বললাম। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে নেয়। মারা যাওয়ার পরও লাইফ সাপোর্টের নামে বিল বানানোর ইতিহাস তো আছেই। খালেদ সাইফুল্লাহ লিখেছেন, সম্প্রতি আমি এ রকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি। নয়ন তাহির লিখেছেন, আমার বাবা মারা গেল মূর্খ বিশেষ অজ্ঞ ডাক্তারদের কারণে। রূপা সিদ্দিকীর মন্তব্য, এই বিভ্রান্তিকর চিকিৎসা ব্যবস্থা ইদানীং বেশিই দেখা যাচ্ছে। একাধিকবার মেডিকেল টেস্ট নিচ্ছে, দুজন ডাক্তার দুরকম পরামর্শ দিচ্ছেন। এর স্বচ্ছতা আনয়ন জরুরি। ফারাহ নাজ সাত্তার লিখেছেন, অন্য সব পেশায় লেখাপড়া না করেও ডিগ্রি দিলে দেশের ক্ষতি হলেও জীবনের ঝুঁকি কম। কিন্তু যেনতেনভাবে পাস করা ডাক্তার হলে এটাই হবে আমাদের দেশে। আগে কত বড় বড় ডাক্তারদের গল্প শুনেছি যারা মুখ দেখে বা হাতের নাড়ি টিপে রোগ ধরতে পারতেন। খুব বেশি টেস্ট ফেস্ট করা লাগত না। এখন সাধারণ অসুখেও গাদা গাদা টেস্ট করাতে হয়। তারপরও উল্টা-পাল্টা চিকিৎসা হয়। আমরা সবাই সব জানি বুঝি কিন্তু কিছুই বদলাতে পারছি না স্যার, আপনার পোস্টটা অনেক আসল তথ্যসমৃদ্ধ আর খুব সময়োপযোগী। এটা শেয়ার করছি কিছু কিছু জায়গায় আমাদের আপসহীন হওয়ার প্রয়োজন আছে। ভারতে কোনো ডাক্তার অতিরিক্ত বেশি বা তাড়াহুড়া করে রোগী দেখার সাহসই করবে না। যদি ভুলপ্র্যাকটিস ধরা পড়ে তো লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে। মিনার মনসুরের মন্তব্য, খুবই গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় হাত দিয়েছেন। আমাদের নীতিনির্ধারকরা যতদিন পর্যন্ত দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর ভরসা রাখবেন না ততদিন পর্যন্ত এ অবস্থা বদলের কোনো আশা দেখি না। এক দুই মাস পরপর যারা চেকআপের জন্য সিঙ্গাপুর-লন্ডন যান তাদের নাম-পরিচয়-পদবি কারো অজানা নয়। সায়েদ জোবায়ের আশার মন্তব্য, টেস্ট করালেই পারসেন্টেজ সঙ্গে বাসার এসি ফ্রিজ সবই তো তাদের দেয়া। মনুষ্যত্বহীন বাকিগুলো ঠিক আছে। নাসিমা আক্তার নিশাও এমন অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। নাসরীন বীণার মন্তব্য, যথার্থ বলেছেন স্যার। ফারজানা কবির ইষিতা লিখেছেন, আমিও ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুপথ দেখে এসেছি। সৈয়দ মোহাম্মদ ইব্রাহিম আমার মন্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন। কাজল রেখা এই অবস্থার জন্য লজ্জা প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে নাজিয়া যুঁথি লিখেছেন, সম্প্রতি আমি ও আমার পরিবার এই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি।

মাহমুদা আমাতুল্লাহ প্রিতু লিখেছেন, আমার চোখের চশমা তাও একজন ডাক্তারের ৫ বছর ভুল চিকিৎসার ফলাফল। তাও আজ আমি ডাক্তারের বোন। মালেকা পারভিনের মন্তব্য, টাকা দিয়ে প্রশ্ন কিনে পরীক্ষা দিয়ে ডাক্তার হওয়া। আর দেশের মন্ত্রী মিনিস্টাররা তো জোরে হাঁচি দিলেও উড়াল দেন বিদেশে। সাধারণ আমজনতার কথা ভাববে কে? স্যার আপনাকে ধন্যবাদ সাধারণ মানুষের একটা অনেক বড় সমস্যা নিয়ে ভাবার জন্য।

লুবনা ইয়াসমিন মন্তব্য করেছেন, আমাদের দেশে লাইনে দাঁড়িয়ে সরকারি হাসপাতালগুলোতে যেতে হবে চিকিৎসার জন্য। বড় বড় হাসপাতালগুলো বিজনেস সেন্টার হয়ে গেছে।

মো. মতিয়ার রহমান ইউডিসি মন্তব্য করেছেন, ডাক্তারির সনদের নামে তারা সেবা না দিয়ে ব্যবসা করছে। আর ভুল চিকিৎসা করে মানুষকে হতাশায় ভোগাচ্ছে। হায়রে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা। এ বিষয়ে সরকারের উচ্চ মহলে আপনার মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করছি। ফেসবুকের মতামতগুলো আমি তুলে ধরছি এ জন্য এসব কথা সাধারণ মানুষের। ওরা সমস্যাগুলো চিহ্নিতও করছে। ফলে সমস্যার প্রতিকারের দিকেও যেতে হলে এই মতামতগুলো প্রকাশিত হওয়া দরকার। আগামীতে আমি আরো কিছু মতামত তুলে ধরব।

ঢাকা, ১৫ ডিসেম্বর ১৭

মোস্তাফা জব্বার : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App